সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী সায়েন্স–এ প্রকাশিত, গাছের ওপর খরার প্রভাব নিয়ে করা বৈশ্বিক গবেষণায় যে পাঁচ মূল গবেষক নেতৃত্ব দিয়েছেন, আপনি তাদের অন্যতম। প্রায় ২০ হাজার গাছের বর্ষবলয় বিশ্লেষণ করে এ গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। শুরুতেই জানতে চাই, এত বড় গবেষণা কীভাবে সম্পন্ন হলো?
মিজানুর রহমান: শুরুতে বলি, এই গবেষণায় আমি ছাড়াও যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা হলেন নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার জুইডেমা, ব্রাজিলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যাম্পিনাসের অধ্যাপক পিটার গ্রোয়েনেন্ডি, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার অধ্যাপক ভেলেরি ট্রাউট ও অধ্যাপক ফ্লোরিন বাবস্ট। গবেষকেরা সারা বিশ্বের বিভিন্ন ক্রান্তীয় অরণ্যে গিয়ে প্রায় ২০ হাজার গাছের বর্ষবলয় সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন। শতাধিক গবেষক এবং বহু দেশের সহযোগিতায় বহু বছরের পরিকল্পনা, ফিল্ডওয়ার্ক এবং পরীক্ষাগার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বিশাল গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে।
বর্ষবলয় বিশ্লেষণ করে খরার প্রভাব বোঝার পদ্ধতি নিয়ে অনেকেই জানেন না। আপনি কি ব্যাপারটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করবেন?
মিজানুর রহমান: বর্ষবলয় বিশ্লেষণ করে খরার প্রভাব বোঝার পদ্ধতি নিয়ে বলার আগে বর্ষবলয় কি সে বিষয়ে একটু বলে নিতে চাই। সাধারণভাবে বললে, বয়স্ক গাছকে আড়াআড়িভাবে করাত দিয়ে কাটলে ভেতরে গাঢ় রঙের যে বৃত্তাকার বলয় দেখা যায়, তা গুনে গাছের বয়স সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেই বৃত্তাকার বলয়কে বলা হয় গাছের বর্ষবলয় বা ট্রি রিংস। আরও বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, বর্ষবলয় হলো গাছের কাণ্ডে উৎপন্ন বার্ষিক কাঠ স্তর, যা ক্যম্বিয়ামের মৌসুমি ক্রিয়ার ফলে তৈরি হয়। প্রতিটি বর্ষবলয় মূলত দুটি অংশ নিয়ে গঠিত—প্রারম্ভিক কাঠ বা আর্লিউড (যা অনুকূল মৌসুমে বর্ষার শুরুর দিকে গঠিত, বড় ও পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট কোষ নিয়ে গঠিত) এবং পরবর্তী কাঠ বা লেটউড (যা অননুকূল মৌসুমে বা শরতকালে গঠিত, ছোট ও ঘন প্রাচীরবিশিষ্ট কোষ নিয়ে গঠিত)। আর্লিউড হালকা রঙের, আর লেটউড গাঢ় রঙের হয়। একই বছরে গঠিত গাঢ় রং এবং হালকা রঙের কাঠের ভিন্নতার জন্যই প্রতি বছর একটি করে গাঢ় রঙের বৃত্তাকার বলয় দেখা যায়। একে আমরা বলি বর্ষবলয়।
গাছপালা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্রহণ করে। এই কার্বন ডাই–অক্সাইডের একটি অংশ বহু দশক ধরে গাছের কাণ্ডে সংরক্ষিত থাকে। ক্রান্তীয় অরণ্যে এই দীর্ঘমেয়াদি কার্বন সংরক্ষণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে। তবে খরার সময় গাছের কাণ্ডের বৃদ্ধি সাধারণত ধীর হয়ে যায়। এতে কাঠে কম কার্বন ডাই–অক্সাইড সংরক্ষিত হয়। এখন পর্যন্ত জানা ছিল না যে খরার সময় ক্রান্তীয় বনাঞ্চলে গাছের কাণ্ডের বৃদ্ধি ঠিক কতটা কমে যায়। কাঠের বর্ষবলয় একটি চমৎকার উপায় এই পরিমাণ নির্ধারণের জন্য। কারণ, এতে গত শতাব্দীর গাছের বৃদ্ধির আর্কাইভ সংরক্ষিত থাকে।
গত ১০০ বছরে সব ক্রান্তীয় অরণ্যে বিভিন্ন মাত্রার যত খরা হয়েছে, আমরা প্রথমে সেই বছরগুলো শনাক্ত করেছি। আমরা খরার বছরের গাছের বর্ষবলয়ের প্রস্থ পরিমাপ করেছি, পাশাপাশি খরার দুই বছর আগে এবং দুই বছর পরের বলয়ের প্রস্থও পরিমাপ করেছি। খরার বছরে গাছের বৃদ্ধি আগের দুই বছরের গড় বৃদ্ধির তুলনায় কতটা হ্রাস পেয়েছে, তা নির্ধারণ করেছি। এছাড়াও, খরার পরের দুই বছরের বৃদ্ধি খরার বছরের তুলনায় কত বেশি, তা পরিমাপ করেছি। ফলে গাছ কত দ্রুত খরার প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে, তা মূল্যায়ন করা গেছে।
ক্রান্তীয় অরণ্যের বিস্তৃতি ও বৈশিষ্ট নিয়ে কিছু বলুন।
মিজানুর রহমান: ক্রান্তীয় অরণ্য হলো এমন বনভূমি যা কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তির মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এবং সারা বছর গরম ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে এখানে ঘনবসতিপূর্ণ বৃক্ষরাজি গড়ে ওঠে। এই অরণ্যগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রা (গড়ে ২০°–৩৫° সেলসিয়াস), প্রচুর বৃষ্টিপাত (প্রায় ২০০০-৪০০০ মিলিমিটার বা তারও বেশি) এবং চিরসবুজ, উঁচু ও বহুবিধ প্রজাতির গাছপালা থাকে। এই বনভূমিকে পৃথিবীর প্রধান কার্বন ভাণ্ডার এবং জীববৈচিত্র্যের হটস্পট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমাজন রেইনফরেস্ট (ব্রাজিল), কঙ্গো রেইনফরেস্ট (আফ্রিকা) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রান্তীয় অরণ্যের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের বনভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করেছেন? কোন বনভূমি এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল?
মিজানুর রহমান: আমি বনবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অরণ্য থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এই গবেষণার জন্য আমি হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন এবং শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বনে ফিল্ডওয়ার্ক পরিচালনা করেছি। আমার সহকর্মী, প্রফেসর মাহমুদা ইসলাম—যিনি এই গবেষণার সহ-গবেষক—নমুনা সংগ্রহের পুরো সময়জুড়ে সহযোগিতা করেছেন। তা ছাড়া আমার স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, গবেষণা সহকারী এবং স্থানীয় মাঠ সহায়করা ফিল্ডওয়ার্কে আমাকে অত্যন্ত সহায়তা করেছেন। বাংলাদেশ বন বিভাগ আমাকে নমুনা সংগ্রহের জন্য বনাঞ্চলে প্রবেশের আইনগত অনুমতি এবং নমুনা সংগ্রহে সহায়তা করেছে । আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
খরার প্রভাব বিভিন্ন গবেষণাস্থানে কী একই রকম ছিল?
মিজানুর রহমান: খরার প্রভাব বিভিন্ন গবেষণাস্থানে ভিন্ন রকম ছিল। প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্থানে গাছের কাণ্ড বৃদ্ধির হার বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক বেশি (১০% বেশি) হ্রাস পেয়েছে। এটি মূলত উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে ঘটেছে। যেমন উত্তর-পূর্ব ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায়। এসব অঞ্চলে খরার প্রভাব আরও তীব্র হতে পারে। কারণ, গাছ দ্রুত পাতা ঝরিয়ে ফেলে এবং মাটিতে আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা কম থাকে। অন্যদিকে, আর্দ্র অঞ্চলে যেমন আমাজনের বনগুলোতে, খরার প্রভাব তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল। এছাড়া কাণ্ড বৃদ্ধির ওপর খরার প্রভাব অ্যানজিওস্পার্ম (আবৃতবীজী উদ্ভিদ) ও জিমনোস্পার্মের (নগ্নবীজী উদ্ভিদ) মধ্যে ভিন্ন ছিল। জিমনোস্পার্মে খরাজনিত ক্যাভিটেশনের প্রবণতা বেশি এবং অ-গঠনমূলক কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম হওয়ায় তাদের ওপর খরার প্রভাব ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশে খরায় গাছের বৃদ্ধি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। যেমন, ১৯৯৯ সালের খরার বছরে বাংলাদেশের রেমা-কালেঙ্গা বনে চিক্রাশিগাছের বৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
১৯৯৯ সালের রেমা-কালেঙ্গা বনের চিক্রাশিগাছের ঘটনা কি বাংলাদেশের অন্যান্য বনভূমিতেও একই রকম প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়?
মিজানুর রহমান: রেমা-কালেঙ্গা বনের চিক্রাশিগাছের ঘটনা বাংলাদেশের অন্যান্য বনভূমিতেও একই রকম প্রভাব পড়তে পারে। আরেকটি গবেষণায় কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে আমরা বাজনা গাছের ওপর খরার একই রকম প্রভাব দেখতে পেয়াছি। শুষ্ক অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রভাব আরও বেশি হতে পারে।
আপনাদের গবেষণায় দেখা গেছে, খরার বছরে অতিরিক্ত প্রায় ০.১% গাছ মারা যেতে পারে। পরিবেশে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে?
মিজানুর রহমান: মৃত গাছ সালোকসংস্লেষণ করে কার্বন শোষণ করতে পারে না, ফলে বনভূমির মোট কার্বন শোষণক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া পচে যাওয়া মৃত কাঠ থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। এই ০.১% সংখ্যাটি ছোট মনে হলেও, যদি তা বিশ্বের সব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে মোট নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ জার্মানির মতো দেশের বার্ষিক নিঃসরণের সমান হতে পারে। আবার সেই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গাছের বৃদ্ধির মাধ্যমে পুনরায় শোষিত হতে দশকের পর দশক সময় লেগে যেতে পারে। তাছাড়া, নির্দিষ্ট গাছের মৃত্যু সেই গাছের ওপর নির্ভরশীল প্রাণী, পাখি, পোকা-মাকড় ও অণুজীবের জন্য খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাব তৈরি করতে পারে। ফলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। গাছপালা কমে গেলে বাষ্পীভবন-উৎক্ষেপণ (Evapotranspiration) কমে যায়, যা মেঘ গঠন ও বৃষ্টিপাতের ধরণকে প্রভাবিত করতে পারে। স্থানীয় পানিচক্রের পরিবর্তনও আনতে পারে।
খরার পরও কিছু স্থানে গাছের বৃদ্ধিতে প্রভাব সামান্য ছিল। কিন্তু আপনি বলছেন, ভবিষ্যতে এই স্থিতিশীলতা থাকবে না। এর কারণ কী?
মিজানুর রহমান: কারণ, বর্তমানে অনেক গাছ খরার চাপ সামলাতে সক্ষম হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় অভিযোজনের মাধ্যমে। যেমন, কাণ্ডের পানি পরিবহন ব্যবস্থা (জাইলেম) বেশি সংখ্যক সংকীর্ণ নালী তৈরি করে, যাতে কিছু নালী বন্ধ হলেও বাকিগুলো দিয়ে পানি চলাচল অব্যাহত থাকে। কিন্তু যদি ভবিষ্যতে খরার তীব্রতা (Severity) এবং ঘনত্ব (Frequency) বেড়ে যায়, তাহলে এই অভিযোজন ক্ষমতা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে।
বারবার এবং তীব্র খরা হলে গাছের পানি পরিবহন ব্যবস্থা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গাছের কার্বোহাইড্রেট সঞ্চয় কমে যাবে, ফলে পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা হ্রাস পাবে। দীর্ঘমেয়াদে মৃত্যুহার বাড়বে এবং বন কাঠামো ও প্রজাতি-সংমিশ্রণ বদলে যেতে পারে। অর্থাৎ, খরা সহনশীলতার যে স্থিতিশীলতা এখন দেখা যাচ্ছে, তা ভবিষ্যতের কঠিন জলবায়ু পরিস্থিতিতে ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে।
খরার সময় স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও জীববৈচিত্র্য সবচেয়ে বড় কোন ঝুঁকির মুখে পড়ে?
মিজানুর রহমান: খরার সময়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। পানির ঘাটতির কারণে কৃষি, পশুপালন ও জীবিকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। বনাঞ্চলে জলাভাবের কারণে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফুল ও ফল উৎপাদন কমে যায়, যা বন্যপ্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয় সংকট তৈরি করে। নদী, হ্রদ ও জলাশয়ের পানি কমে যাওয়ায় জলজ প্রাণীর বাসস্থান নষ্ট হয়। একইসঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে রোগ ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ বেড়ে গিয়ে বন ও কৃষি বিপর্যস্ত করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এসব প্রভাব স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
বাংলাদেশের বনাঞ্চল খরা মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত? খরা–সহনশীল গাছের প্রজাতি রোপণ বা বন ব্যবস্থাপনায় কী পরিবর্তন আনা দরকার?
মিজানুর রহমান: একদমই প্রস্তুত নয়। খরার প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে হলে প্রথমে খরার প্রভাবকে পরিমাণগতভাবে নিরূপণ করতে হবে এবং খরা কীভাবে বনের কাঠামো ও কার্যকারিতা প্রভাবিত করে, তার প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। এরপর আমরা খরার প্রভাব মোকাবিলায় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে পারব। যদিও কৃষি ফসলের ওপর খরার প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, বাংলাদেশের বনভূমির ওপর খরার প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণা খুবই সীমিত। শুধু খরা–সহনশীল গাছের প্রজাতি রোপণ করা খরার প্রভাব মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। দরকার বন নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন।
বর্তমানে বাংলাদেশে বন সংরক্ষণের উদ্যোগগুলো কি যথেষ্ট কার্যকর?
মিজানুর রহমান: বর্তমানে বাংলাদেশে বন সংরক্ষণের জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য স্থাপন, পুনঃবনায়ন, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সহ-ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য। এই উদ্যোগগুলো কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যেমন, অবৈধভাবে গাছ কাটা কমেছে। বন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য কিন্তু শুধু তা নয়। বন ব্যবস্থাপনার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বন থেকে সর্বাধিক বাস্তুতন্ত্র সেবা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে কার্বন সঞ্চয়ও অন্তর্ভুক্ত।
আপনার মতে, নীতিনির্ধারকদের এখন কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি?
মিজানুর রহমান: বন নিধন রোধ করাই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বন ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।
বাংলাদেশের বন থেকে সর্বাধিক বাস্তুতন্ত্র সেবা পাওয়ার জন্য নীতিনির্ধারকদের উচিত নীতি প্রণয়ন বা সংশোধন করা, যা বর্তমানে তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি। গাছের ঘনত্ব এবং প্রজাতির বৈচিত্র্য সরাসরি বাস্তুতন্ত্র সেবার সঙ্গে সম্পর্কিত। একক বা কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির মাধ্যমে পুনঃবনায়ন এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে না। বনের দেশীয় প্রজাতির গাছের ঘনত্ব বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
আমি পানামার শুষ্ক ও আর্দ্র বন এবং ব্রাজিলের আমাজন বনে নমুনা সংগ্রহের জন্য একাধিক ফিল্ডওয়ার্ক পরিচালনা করেছি। আমি দেখেছি, সেসব বন আমাদের বনের তুলনায় অনেক বেশি ঘন আর উঁচু। সেখানে বনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে—চারাগাছ স্তর, কিশোর গাছ স্তর (সেপ্লিং), মধ্যবর্তী স্তর, পূর্ণবয়স্ক গাছ, সর্বোচ্চ স্তরের গাছ। বাংলাদেশি বনে কীভাবে বিভিন্ন স্তরের দেশীয় প্রজাতির গাছের বিকাশ ঘটানো যায়, সে বিষয়ে নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। দেশের সব ধরনের বনে গাছের এই উলম্ব স্তরবিন্যাস গড়ে তুলতে স্থান ও প্রজাতির নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি প্রাণীজ জীববৈচিত্র্যের জন্যও একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ন্যাচারাল রিজেনারেশনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণার অগ্রাধিকার এই দিকেই প্রথমে দেওয়া উচিত।
নীতি প্রণয়নের সময় জলবায়ু পরিবর্তন এবং খরার মতো চরম জলবায়ুগত ঘটনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। গবেষণার অগ্রাধিকার ক্ষেত্রভিত্তিকভাবে নির্ধারণ করা উচিত। সমস্যা চিহ্নিত করা, তাতে গুরুত্ব দেওয়া, গবেষকদের যুক্ত করা, ফলাফল অনুসরণ করা এবং মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করা।
বাংলাদেশ বন বিভাগ এবং বন গবেষণা ইনস্টিটিউটকে যেকোনো গবেষণা কর্মসূচি পরিকল্পনায় সমন্বয় করতে হবে। বিদেশি তহবিলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় বাজেটে বন গবেষণাকে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। বন বিভাগের গবেষণা শাখাকে দেশের স্বনামধন্য গবেষকদের সম্পৃক্ত করে শক্তিশালী করা জরুরি।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বন–গবেষণা কতটা সমন্বিত, এবং কোথায় ঘাটতি আছে?
মিজানুর রহমান: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বন–গবেষণা এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং কার্বন সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে যৌথ গবেষণা প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েছে। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় ঘাটতিও রয়ে গেছে। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদি এবং ধারাবাহিক তথ্যসংগ্রহ ও ডেটাবেস তৈরির অভাব রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গবেষণা পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায়ই প্রকল্পভিত্তিক ও খণ্ডকালীন, যা দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিত কৌশল গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক বন–গবেষণায় যাতে আরও কার্যকর ও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্য যৌথ গবেষণার অবকাঠামো ও অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং দক্ষ জনবল তৈরিতে বিনিয়োগ করা জরুরি।
এত বড় আন্তর্জাতিক গবেষণায় অংশ নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
মিজানুর রহমান: এই গবেষণার সূত্র ধরে বিশ্বের বেশ কিছু খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমি তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে আগে থেকেই চিনতাম, আর কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কাজের সূত্রে। গত চার বছরে তাঁদের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমি ধারাবাহিকভাবে শিখেছি। প্রতিটি মিটিংয়ের আগে যথাযথ প্রস্তুতি নিতাম, যাতে আলোচনায় অর্থবহভাবে অবদান রাখতে পারি। এই অভ্যাস আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি দ্রুত ও কার্যকরভাবে শেখার ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করা ছিল অনুপ্রেরণাদায়ী এবং সত্যিই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে সাধারণ মানুষকে আপনি কী বার্তা দিতে চান?
মিজানুর রহমান: জলবায়ু পরিবর্তন ও খরার মতো চরম জলবায়ুগত ঘটনার হুমকি থেকে আমাদের জীবন রক্ষার জন্য বন সংরক্ষণ ও যত্ন নেওয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে আমাদের সবার উচিত দায়িত্বশীল দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা।
তরুণ গবেষক বা শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
মিজানুর রহমান: তরুণ গবেষক এবং শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী গড়তে অবদান রাখবে। তাদের জন্য একটাই পরামর্শ—সৃজনশীল হও। কারও সঙ্গে নয়, প্রতিযোগিতা করো প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। কাজে ও চিন্তায় সৎ হও। তাহলে তুমিই পারবে পৃথিবীর অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে।