‘শেষ পর্যন্ত আমরাও আসলে নক্ষত্রের ধূলি’— মার্টিন রিজ, ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ

মার্টিন রিজ হলেন ব্রিটিশ রাজদরবারের শেষ জ্যোতির্বিদ। তিনি ব্রিটিশ রাজপরিবারে নিযুক্ত রয়েল অ্যাস্ট্রোনমার। এককালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।

ব্রিটিশ এই কসমোলজিস্ট ও জ্যোতিঃপদার্থবিদের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জুন, ইংল্যান্ডের ইয়র্ক শহরে। তাঁর পড়ালেখা কেমব্রিজে, গণিতে। ১৯৭৩ সাল থেকে সেখানেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তাত্ত্বিক হিসেবেই তিনি খ্যাতি পেয়েছেন—বিশেষ করে তাঁর মৌলিক বৈজ্ঞানিক অনুমানগুলোর জন্য। রয়েল অ্যাস্ট্রোনমারের পদ ছাড়াও তিনি বিশ্বের পুরোনো বিজ্ঞান একাডেমি রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। উচ্চশক্তির জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান, গ্যালাক্সির গঠন এবং কসমোলজিতে অবদান রাখার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে উলফ প্রাইজসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী।

মার্টিন রিজের এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জার্মান পদার্থবিদ, অধ্যাপক ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক স্টিফান ক্লেইন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার

স্টিফান ক্লেইন: প্রফেসর রিজ, রয়েল অ্যাস্ট্রোনমার হিসেবে আপনার দায়িত্ব কী?

মার্টিন রিজ: এটা আসলে স্রেফ একটি সম্মানসূচক উপাধি। ১৬৭৫ সালে রয়েল অবজারভেটরি অব গ্রিনিচ পরিচালনার জন্য এই পদ তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে এর দায়িত্ব এত সীমিত যে মৃত্যুর পরও যে কাউকে এই পদ দেওয়া যায়।

স্টিফান ক্লেইন: কোয়াসার নিয়ে আপনার গবেষণা বিগ ব্যাংয়ের সপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হাজির করেছে। রানিকে কি কখনো ‘কোয়াসার কী’ তা ব্যাখ্যা করেছেন?

মার্টিন রিজ: আমরা কখনো এ বিষয়ে আলোচনা করিনি। সুযোগ পেলে তাঁকে বলতাম, গ্যালাক্সিগুলোর কেন্দ্রের বিশাল কৃষ্ণগহ্বরগুলো গ্যাস শুষে নেয়। আর গ্যাস কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যাওয়ার আগে মহাবিশ্বের যেকোনো বস্তুর চেয়ে তীব্রতর আলো বিকিরণ করে। সেই বিকিরণ ট্রিলিয়ন সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল।

আরও পড়ুন

স্টিফান ক্লেইন: বিগ ব্যাংয়ের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

মার্টিন রিজ: একসময় আমাদের সামনে প্রশ্ন উঠেছিল, পৃথিবী থেকে যত দূরে তাকাই, তত বেশি কোয়াসার কেন দেখা যায়? আমার সহকর্মী ডেনিস সিয়ামার সঙ্গে আমি দেখিয়েছি, এর সঠিক উত্তর পাওয়া যায় বিগ ব্যাং তত্ত্ব থেকে। কারণ অধিকাংশ কোয়াসার গঠিত হয়েছিল আদিম মহাবিশ্বে। আর মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আমাদের থেকে বহুদূরে সরে যাচ্ছে। আমরা এই আবিষ্কারটা করেছিলাম ১৯৬৫ সালে।

স্টিফান ক্লেইন: বর্তমানে আমরা জানি, কোয়াসার মহাবিশ্বের প্রাচীনতম দৃশ্যমান বস্তুগুলোর একটি। সম্প্রতি কমপক্ষে ১৩শ কোটি বছর আগে গঠিত কোয়াসার আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ঘটনাটি আপনাকে কীভাবে আকর্ষণ করে?

মার্টিন রিজ: একটি অতিবৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরের প্রান্তে পদার্থবিজ্ঞান সত্যিই চমকপ্রদ। আমরা সেখানে আইনস্টাইনের তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখতে পারি। সেখানে এর অবিশ্বাস্য প্রভাব দেখা যায়। গ্যাসের ঘূর্ণির ওপরে ও নিচে, পদার্থের স্রোত অতি উচ্চ বেগে মহাবিশ্বে নিক্ষিপ্ত হয়। সায়েন্স ফিকশন লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক (২০০১: আ স্পেস অডিসি) একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই জেটগুলি কি অতি উন্নত কোনো সভ্যতার সৃষ্টি হতে পারে?

মার্টিন রিজের বইয়ের প্রচ্ছদ

স্টিফান ক্লেইন: গ্যালাক্টিক সংকেত?

মার্টিন রিজ: সম্ভবত।

স্টিফান ক্লেইন: কিন্তু কোয়াসারগুলি যদি মহাবিশ্বের জন্মের কিছু সময় পরেই গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের নিকটবর্তী কোনো সভ্যতার বিকাশের জন্য খুব কম সময় ছিল।

মার্টিন রিজ: এটি একটি সমস্যা বটে। তবে অন্যান্য, অপেক্ষাকৃত নতুন অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরও জেট নিঃসরণ করে।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি কি সবসময় মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করতে চেয়েছিলেন?

মার্টিন রিজ: মোটেও না। আমি আসলে গণিতবিদ হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, আমি শুধু গণিতের জন্য পড়তে চাই না। তাই এমন একটি ক্ষেত্র খুঁজছিলাম, যেখানে আমি যা শিখেছি তা প্রয়োগ করতে পারব। এরপর আমি প্রায় অর্থনীতিবিদ হওয়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম! কিন্তু এক বছর পর, তখন সবে কোয়াসার আবিষ্কৃত হয়েছে, এটাই আমার পছন্দ হয়ে গেল।

স্টিফান ক্লেইন: আমিও একবার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার বয়স যখন পঁচিশ বছর, তখন নক্ষত্রগুলোকে আমার কাছে অনেক দূরে মনে হয়েছিল। অথচ আমাদের চোখের সামনেই গবেষণা করার জন্য এত আশ্চর্যজনক জিনিস রয়েছে।

মার্টিন রিজ: নক্ষত্রগুলো আসলে আপনার ধারণার চেয়েও আমাদের অনেক কাছাকাছি। পৃথিবীর সব কিছুর মতোই নক্ষত্রও একই প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন দ্বারা পরিচালিত, শুধু এদের অবস্থাটা চরম। তা ছাড়া মহাবিশ্বই আমাদের পরিবেশ। যত মানুষই পৃথিবীতে বসবাস করুক না কেন, আমরা সবাই একই নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছি। আর শেষ পর্যন্ত আমরাও আসলে নক্ষত্রের ধূলি।

আরও পড়ুন

স্টিফান ক্লেইন: পৃথিবীর সব কিছুর মতোই, আমরা বিলুপ্ত মহাজাগতিক বস্তুর অবশেষ দিয়ে গঠিত।

মার্টিন রিজ: ঠিক। সব মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে নক্ষত্রের ভেতরে গঠিত হয়েছিল। আপনি যদি একটু কম রোমান্টিক হন, তাহলে মানুষকে নাক্ষত্রিক নিউক্লিয়ার বর্জ্যও বলতে পারেন।

স্টিফান ক্লেইন: মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এটি অবশ্যই একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময়। আপনার সহকর্মী চার্লস বেনেট বলেছেন,  মহাবিশ্বতত্ত্ব একটা বিপ্লবের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

মার্টিন রিজ: নিঃসন্দেহে তাই। নতুন টেলিস্কোপ এবং সুপারকম্পিউটারের প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার কারণে আমরা এখন মহাবিশ্বের বিবর্তন কমপক্ষে বারোশ কোটি বছর পেছনেও অনুসরণ করতে পারি। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে, কীভাবে প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলো একটি অগঠিত অবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কীভাবে নক্ষত্রগুলো বর্তমান সময় পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে। আমি আরও উত্তেজিত এই কারণে যে গত দশ বছর ধরে আমাদের সৌরজগতের বাইরে একের পর এক গ্রহ আবিষ্কার করছি। আশা করি শিগগিরই আমরা পৃথিবীর মতো গ্রহ খুঁজে পাব।

স্টিফান ক্লেইন: এই লক্ষ্য নিয়েই নাসা পরবর্তী ফেব্রুয়ারিতে কেপলার স্পেস প্রোব উৎক্ষেপণ করার পরিকল্পনা করছে।

মার্টিন রিজ: এটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করবে। বর্তমান যন্ত্রগুলি শুধু বৃহস্পতির আকারের বিশাল গ্রহ শনাক্ত করতে পারে। অবশ্যই, সেখানেও জীবন থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আরও আকর্ষণীয় ব্যাপার হবে, এমন একটি গ্রহ, যার অবস্থাটা পৃথিবীর একদম শুরুর সময়কার অবস্থার মতো।

স্টিফান ক্লেইন: এর সম্ভাবনা কতটুকু?

মার্টিন রিজ: আমরা আমাদের মতো গ্রহ খুঁজে পেতে পারি, কিন্তু আমার সন্দেহ, আগামী বিশ বছরে আমরা প্রমাণ পাব যে তাদের বায়োস্ফিয়ার আছে। তবু আমি বাজি ধরব যে আকাশগঙ্গায় কোথাও না কোথাও জীবন আছে এবং অন্যান্য গ্যালাক্সিতে জীবনের সম্ভাবনা আরও বেশি।

স্টিফান ক্লেইন: আমাদের সেরা টেলিস্কোপও মহাবিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে না। ওই অঞ্চল এত দূরে যে তাদের আলো মহাবিশ্বের উৎপত্তির পর থেকে আমাদের কাছে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট সময় হয়নি।

মার্টিন রিজ: এটি সমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাহাজের মাস্তুলে চড়ার মতো। আপনি শুধু দিগন্ত পর্যন্ত দেখতে পাবেন, কিন্তু আপনাকে ধরে নিতে হবে যে এর বাইরেও সমুদ্রটা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

আরও পড়ুন

স্টিফান ক্লেইন: কোব (COBE) ও ডব্লিউএমএপি (WMAP) স্যাটেলাইটের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের ধারণা করতে হবে যে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের চেয়ে হাজার গুণ বড়। সেই অদেখা অঞ্চলে কী ঘটতে পারে?

মার্টিন রিজ: এই স্যাটেলাইটগুলোর পরিমাপ থেকে জানা যায়, দিগন্তের বাইরেও দৃশ্যমান মহাবিশ্বের মতো একই রকম অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করে। তবে আমরা এখনও নিশ্চিত নই।

কোব স্যাটেলাইট

স্টিফান ক্লেইন: এই বিশালতার পরিপ্রেক্ষিতে বহিঃজাগতিক জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ কীভাবে সম্ভব? জীবনের উদ্ভবের সম্ভাবনা অতি নগণ্য হতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্বের অগণিত সৌরজগত বিবেচনা করলে এটি বারবার ঘটেছে বলেই মনে হয়।

মার্টিন রিজ: ঠিক বলেছেন। আমরা আশা করি, আগামী দুই দশকে জৈবিক পরীক্ষার মাধ্যমে আরও জানতে পারব—কীভাবে প্রাণহীন পদার্থ থেকে জীবন সৃষ্টি হয়। তবু আমাদের গ্যালাক্সিতে আমরা যে একা, সেটাও যৌক্তিকভাবে অসম্ভব নয়।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি একবার বলেছিলেন যে আপনি এটি পছন্দ করবেন। কেন?

মার্টিন রিজ: কারণ সেখানে অন্যদের উপস্থিতি আমাদের মহাজাগতিক আত্মবিশ্বাস কিছুটা হরণ করবে। অন্যদিকে, জীবনে পরিপূর্ণ একটি গ্যালাক্সি অবশ্যই অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

স্টিফান ক্লেইন: কিন্তু মানবতা কি এই মহাজাগতিক সংস্থার খবর সামলাতে প্রস্তুত?

মার্টিন রিজ: আমি মনে করি না যে এই অভিজ্ঞতা ট্রমাটিক হতে হবে। এর সাংস্কৃতিক প্রভাব আমেরিকা আবিষ্কারের প্রভাবের কাছাকাছি হতে পারে।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি কি সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করেন?

মার্টিন রিজ: এতে অনেক ধারণা আমাকে উদ্দীপ্ত করে। তাই আমি আমার ছাত্রদের দ্বিতীয় শ্রেণির বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার চেয়ে প্রথম শ্রেণির সায়েন্স ফিকশন পড়ার পরামর্শ দিই।

স্টিফান ক্লেইন: স্তানিস্লাভ লেমের উপন্যাস সোলারিস-এ বিজ্ঞানীরা একটি দূরবর্তী গ্রহে একটি অদ্ভুত মহাসাগর আবিষ্কার করে। পরে প্রমাণ পাওয়া গেল যে সেটা একটি বুদ্ধিমান জীব। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় খুঁজে পায় না। কারণ মানুষের সঙ্গে এই জীবনরূপের পার্থক্য অনেক বেশি। এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্যকল্প।

মার্টিন রিজ: এমন জীবনরূপ ও বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে, যাদের আমরা এখনো চিনতে পারি না। কিন্তু এটাও সম্ভব যে অন্যান্য সভ্যতা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের বোঝার মতো করে বার্তা পাঠাতে পারে। তবে আমাদের খুব সরল জীবনরূপ বা তাদের অবশেষের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শুধু তাই হলেও তা একটি চমৎকার আবিষ্কার হবে। তাই আমি বহিঃজাগতিক জীবন অনুসন্ধানের সব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি।

সোলারিস উপন্যাসের প্রচ্ছদ

স্টিফান ক্লেইন: এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলে—মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেন এমন যে এতে জীবন সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে?

মার্টিন রিজ: সত্যি। আমরা এমন অসংখ্য মহাবিশ্ব কল্পনা করতে পারি, যেখানে জীবন সৃষ্টি আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্ব অতি সূক্ষ্ম ভারসাম্যপূর্ণ। যেমন এতে যদি কম মৌলিক কণা থাকত, তাহলে কোনো জটিল গঠন সৃষ্টি হত না। অথবা এতে যদি অত্যধিক পদার্থ থাকত, তাহলে গোটা মহাবিশ্ব দ্রুতই নিজেই ভেঙে পড়ত। আর মহাকর্ষের শক্তি যদি সামান্য বেশি হতো, তাহলে তারাগুলো অনেক ছোট হতো এবং জীবন সৃষ্টির আগেই নিভে যেত।

স্টিফান ক্লেইন: এই অবিশ্বাস্য ভারসাম্য, যা সবকিছু সম্ভব করে তোলে, আধুনিক কসমোলিজর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না।

মার্টিন রিজ: এটি একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ: আমরা কি এই ধ্রুবকগুলো ব্যাখ্যা করতে পারি, নাকি শুধু মেনে নিতে হবে।

স্টিফান ক্লেইন: আইনস্টাইন, হাইজেনবার্গ এবং অন্যান্য পদার্থবিদরা সবকিছুর তত্ত্ব বা থিওরি অব এভরিথিং খুঁজেছেন। তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।

মার্টিন রিজ: তবে বেশির ভাগ বিজ্ঞানী এখনও আশা করেন যে একদিন তাঁদের এই স্বপ্ন পূরণ হবে।

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন
উইকিমিডিয়া

স্টিফান ক্লেইন: আপনি অন্য একটি সমাধানের পক্ষে...

মার্টিন রিজ: আমি কোনো কিছুরই পক্ষপাতিত্ব করি না। শুধু সব সম্ভাবনার জন্য মন খোলা রেখেছি।

স্টিফান ক্লেইন: একটি সম্ভাবনা হলো, আমাদের মহাবিশ্ব অনেকগুলোর মধ্যে একটি মাত্র। এর ভাইবোন আছে।

মার্টিন রিজ: হ্যাঁ।

স্টিফান ক্লেইন: এর বেশির ভাগই জীবন ধারণের অনুপযোগী। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বসহ কিছু মহাবিশ্বে প্রাকৃতিক ধ্রুবকগুলো এমনভাবে সাজানো আছে যে সেখানে জীবন সম্ভব।

মার্টিন রিজ: এটা অনেকটা যেমন আপনি ভালো দেখতে কাস্টম-মেড স্যুটের প্রয়োজন বোধ করেন না। একটি বড় কাপড়ের দোকানে গেলেই আপনি আপনার মাপের জ্যাকেট পেয়ে যাবেন। তেমনই, অসংখ্য মহাবিশ্বের মধ্যে একটি এমন হবেই, যেখানে জীবন সৃষ্টির উপযোগী পরিবেশ থাকবে।

আরও পড়ুন

স্টিফান ক্লেইন: মহাবিশ্ব সৃষ্টিকে একটি বিশাল দোকান হিসেবে বর্ণনা—এমনটা আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, কে বা কী এসব সৃষ্টি করেছে?

মার্টিন রিজ: কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্বের গঠন কোনো পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে হয়নি, বরং বিগ ব্যাংয়ের সময় সেটা আকস্মিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি ইনফ্লেশন তত্ত্বের কথা বলছেন, যার বিভিন্ন রূপ আছে। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো, সময়ের শুরুতে মহাবিশ্ব হঠাৎ করে ফুলে উঠেছিল। প্রথমে এটি একটি পরমাণুর চেয়েও ছোট ছিল, কিন্তু তারপর হুট করে সেটা বর্তমান আকারের কাছাকাছি হয়ে গেছে।

মার্টিন রিজ: ঠিক তাই। সাবঅ্যাটমিক জগতে এলোমেলো ওঠানামা বা কম্পন থাকে, যাকে বলা হয় কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। গোটা মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হচ্ছিল, তখন এই ওঠানামাগুলোও মহাজাগতিক পরিসরে বেড়ে গিয়েছিল।

স্টিফান ক্লেইন: বলা যায়, এটিই মহাবিশ্বের পরবর্তী সব কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করে। দশ বছর আগে আমি যখন ইনফ্লেশন তত্ত্ব নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল তাঁরা একে একটি আকর্ষণীয় অনুমান হিসেবেই দেখে, কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। তারপর থেকে কি এ মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে?

মার্টিন রিজ: আপনি যে দুটি স্যাটেলাইটের কথা বললেন, সেগুলো মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ সম্পর্কে নতুন তথ্য দিয়েছে। এই বিকিরণ তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পরে। তখন থেকে গোটা মহাবিশ্ব এই বিকিরণে ডুবে আছে। এটি বিগ ব্যাংয়ের এক প্রকারের আফটার গ্লো (অবশেষ) এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানা প্রাচীনতম তথ্য ধারণ করে। নতুন পরিমাপগুলো ইনফ্লেশন তত্ত্বের কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী নিশ্চিত করেছে।

স্টিফান ক্লেইন: এবং ইনফ্লেশন তত্ত্বের কিছু সংস্করণ অনুযায়ী শুধু একটি নয়, অনেকগুলো বিগ ব্যাং হয়েছিল। আর প্রতিটির সঙ্গে একটি নতুন মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে। এই সব মহাবিশ্ব পাশাপাশি বিদ্যমান। আমাদের মহাবিশ্ব তাহলে বহু মহাবিশ্ব বা মাল্টিভার্সের একটি অংশ মাত্র।

মার্টিন রিজ: হ্যাঁ। জীবনের উদ্ভব সম্ভব করে, এমন প্রাকৃতিক নিয়মগুলো তখন শুধু আমাদের ছোট্ট অঞ্চলেই প্রযোজ্য হবে।

স্টিফান ক্লেইন: যে উপায়ে কেওটিক ইনফ্লেশন তত্ত্ব একটি মহাবিশ্বের জন্ম বর্ণনা করে, তা অবাক করার মতো: শূন্য স্থান এমন এক শক্তি দিয়ে পরিপূর্ণ, যা নির্দিষ্ট শর্তে ইনফ্লেশন শুরু করতে পারে। তারপর একটি মহাবিশ্ব এমনভাবে ফুলে ওঠে, যেন শূন্যতা থেকে একটি বিশ্বের জন্ম হলো। আইনস্টাইনের সমীকরণ এই ফলাফল দেয়। তবুও এই ধারণাটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

মার্টিন রিজ: ‘শূন্যতা’ বা ‘কোনোকিছু না থেকে’ থেকে বলার বদলে আমাদের ‘ভ্যাকুয়াম’ বা ‘শূন্যস্থান’ থেকে বলা উচিত। কারণ শূন্য স্থান মানে কিছুই না থাকা নয়। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরেও স্থান উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে এবং একটি নতুন মহাবিশ্বও গঠন করতে পারে।

স্টিফান ক্লেইন: এই নতুন মহাবিশ্বের তখন আমাদের সঙ্গে কোনো সংযোগ থাকবে না...

মার্টিন রিজ: না।

স্টিফান ক্লেইন: তাহলে আমরা কীভাবে জানব যে এটি আদৌ আছে?

মার্টিন রিজ: আমরা অন্য মহাবিশ্বগুলো কখনো সরাসরি দেখতে পারব না। কিন্তু কেওটিক ইনফ্লেশন তত্ত্ব অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীও করে—যেমন আমাদের মহাবিশ্বে মহাকর্ষের প্রকৃতি সম্পর্কে—যা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। এগুলো যদি সব সত্যি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে পুরো তত্ত্বটি সঠিক। সর্বোপরি, আপনি কৃষ্ণগহ্বরও দেখতে পান না, কিন্তু সেগুলো যে সত্যিই আছে, সে ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি।

স্টিফান ক্লেইন: একটি নতুন মহাবিশ্বে তার জন্মের মুহূর্তে নিজস্ব সময়ের শুরুও হয়। এখানেই আমার কল্পনাশক্তির সীমা শেষ হয়ে যায়। এমন তত্ত্বগুলো আপনি কীভাবে উপলব্ধি করেন?

মার্টিন রিজ: আমি ছবি আঁকার চেষ্টা করি, অথবা শুধু কল্পনা করি—আমার সাধ্যমতো। আমার জন্য গাণিতিক সূত্রের চেয়ে ছবি নিয়ে কাজ করা সহজ। তাই এখানে আমাদের একটি মহাবিশ্ব থাকবে, সেখানে আরেকটি, এবং প্রতিটি তার ভাইবোনের কাছে একটি ছোট কৃষ্ণগহ্বরের মতো দেখাবে।

স্টিফান ক্লেইন: মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে মানুষকে কি এই কঠিন সত্যটা মানতে হবে যে আমাদের মস্তিষ্ক আসলে এই বাস্তবতা পুরোপুরি বোঝার জন্য তৈরি হয়নি?

মার্টিন রিজ: নিশ্চিতভাবেই তাই। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব যেমনটা দাবি করে, সেরকম চার মাত্রার স্থান কল্পনা করতে আমরা সবাই সমস্যায় পড়ি। আরও সাম্প্রতিক মহাজাগতিক মডেল, যেমন স্ট্রিং তত্ত্ব, মহাবিশ্বকে দশ বা তারও বেশি মাত্রায় বর্ণনা করে! আমাদের মস্তিষ্ক আফ্রিকার সাভানায় বেঁচে থাকার জন্য তৈরি, মহাবিশ্বতত্ত্ব বা কসমোলজি নিয়ে চিন্তা করার জন্য নয়। কিন্তু ভুলে যাবেন না: আমরা অত্যন্ত বিমূর্ত কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায়ও একই সমস্যা পাই, তবু আমরা সেখানে বিস্ময়কর রকম সফল। আমাদের সব ইলেকট্রনিকসই পদার্থবিদদের কোয়ান্টাম ঘটনা গণনা করার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

স্টিফান ক্লেইন: দেখা যাচ্ছে যে ‘বোঝা’র দুটি অর্থ আছে। এক অর্থে আমরা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা বুঝি—অর্থাৎ আমরা এর নিয়ম প্রয়োগ করতে পারি। কিন্তু আমরা এমন গাড়িচালকের মতো যারা গাড়ি চালাতে পারে, কিন্তু হুডের নিচে কী ঘটছে তার কোনো ধারণা নেই। যেমন কেউ জানে না যে, একটি ইলেকট্রন বিভিন্ন অবস্থার সুপারপজিশন বলতে আসলে কী বোঝায়। সে অর্থে বলতে গেলে, আমরা আসলে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা বুঝি না।

মার্টিন রিজ: আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু এটাও বিস্ময়কর ব্যাপার যে আমরা কোয়ান্টাম মেকানিকস বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতো ক্ষেত্রে এত সাফল্য অর্জন করেছি, যা আমাদের দৈনন্দিন বোধগম্যতা থেকে অনেক দূরে। আসলে হয়তো এমন কোনো সীমারেখা আছে, সব সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও যা আমাদের মন কখনোই অতিক্রম করতে পারবে না। নিউটনের সময় নিউটনীয় পদার্থবিদ্যাকে অত্যন্ত জটিল মনে করা হতো, অথচ আজকের যেকোনো মোটামুটি মেধাবী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই এটি বুঝতে পারে। কিন্তু আমি খুব সন্দিহান যে স্কুলশিক্ষার্থীর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিকস সত্যিকার অর্থে শেখানো আদৌ সম্ভব।

স্টিফান ক্লেইন: হয়তো আইনস্টাইন ঠিকই ভেবেছিলেন যে একটি মহাজাগতিক পরিকল্পনা আছে। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক যে এটি উপলব্ধি করার জন্য উপযুক্ত নয়, সেটাও সত্যি হতে পারে।

মার্টিন রিজ: কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। অন্যদিকে, আমাদের মহাবিশ্বের শর্তগুলো পুরোটাই আকস্মিকও হতে পারে। কারণ এই মহাবিশ্ব অনেকগুলোর মধ্যে মাত্র একটি। কিন্তু আপনি যেমন বললেন, এটি সেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে যে বৃহত্তর কাঠামো বা মাল্টিভার্সের নিয়মগুলো কোথা থেকে এল। এ সমস্যাটির সমাধান হবে না, ঝুলে থাকবে।

স্টিফান ক্লেইন: গত দশকে কসমোলজির উল্কার বেগে অগ্রগতি সম্পর্কে আমার ধারণা ঠিক এরকম। যখনই একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়, তখনই পাঁচটি নতুন প্রশ্ন উদয় হয়। সেগুলো আরও কঠিন।

মার্টিন রিজ: এটাই বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রকৃতি। আমাদের জ্ঞানের সীমানা যত প্রসারিত হয়, অজানার সঙ্গে তার সীমানা তত লম্বা হয়। আজ আমরা যে অনেক প্রশ্ন নিয়ে সংগ্রাম করছি, দশ বছর আগে সেগুলো আমরা জিজ্ঞাসাও করতে পারতাম না। শুধু ডার্ক এনার্জির কথাই ভাবুন...

আরও পড়ুন
আমি চার্চ অব ইংল্যান্ডের সদস্য হিসেবে বড় হয়েছি। আমি শুধু আমার গোত্রের রীতিনীতি অনুসরণ করি। গির্জা আমার সংস্কৃতির অংশ; আমি এর আচার-অনুষ্ঠান এবং সঙ্গীত পছন্দ করি।

স্টিফান ক্লেইন: একটি রহস্যময় বল, যা মহাবিশ্বকে বিস্তৃত করছে। আমাদের পরিচিত কোনো শক্তির সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

মার্টিন রিজ: এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৮ সালে। আপনি যেমন বললেন, আমরা এর প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমরা শুধু এটুকুই জানি যে এটি সবকিছুতে ছড়িয়ে আছে এবং খুবই শক্তিশালী। আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন—মহাবিশ্ব কী দিয়ে গঠিত, তাহলে ডার্ক এনার্জিকেই সবচেয়ে বেশি পাবেন। এটি মহাবিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দখল করে আছে। আর বাকি এক-চতুর্থাংশের বেশির ভাগই ডার্ক ম্যাটার নামের একটি পদার্থ, যা কোনো বিকিরণ করে না। তাই এটি অদৃশ্য। এ সম্পর্কে আমরা শুধু এটুকু জানি যে এটি বাইরের মহাকাশের কাঠামো নির্ধারণ করে। কিন্তু ডার্ক ম্যাটার আসলে কী, আমরা তার কিছুই জানি না। আর পদার্থের পরিচিত রূপগুলো? সেগুলো দিয়ে মহাবিশ্বের মাত্র ৪ ভাগের মতো গঠিত হয়েছে।

স্টিফান ক্লেইন: এটি এমন যেন আমরা একটি চকলেট কেকের ওপর বসে আছি এবং এর আইসিং (বা ক্রিম) সম্পর্কেও খুব কম জানি।

মার্টিন রিজ: হ্যাঁ।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তুকে কীভাবে কল্পনা করেন?

মার্টিন রিজ: এটি অবশ্যই কণার একটি প্রবাহ, যা ক্রমাগত পৃথিবী—এবং আমাদের দেহও—ভেদ করে চলে যাচ্ছে। সম্ভবত এই ছায়া জগতে কোনো সূক্ষ্ম গঠন নেই। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এই কণাগুলো একত্রিত হয় না। তাই ডার্ক ম্যাটার একধরনের সর্বব্যাপী গ্যাস, যা নির্দিষ্ট স্থানে কিছুটা ঘনীভূত হয়ে মহাকর্ষীয় টান সৃষ্টি করে। সেটাই দৃশ্যমান পদার্থকে একত্রিত করে গ্যালাক্সি গঠন করে। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না।

স্টিফান ক্লেইন: তাই যদি হয়, তাহলে আমরা প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্বের মতো কিছু নিয়েই কাজ করছি: একদিকে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি এবং অন্যদিকে পদার্থের পরিচিত রূপের মধ্যে কোনো মিথস্ক্রিয়া নেই—একমাত্র মহাকর্ষ ছাড়া।

মার্টিন রিজ: ‌আমাদেরও এটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে একক কণার স্তরে মহাকর্ষ খুব দুর্বল। তাই পদার্থের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যান্য বলের (বিদ্যুৎচুম্বকীয় বা পারমাণবিক বল) তুলনায় তা প্রায় নগণ্য। কিন্তু এর ব্যাপ্তি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই মহাজাগতিক পরিসরে মহাকর্ষই সব মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি যখন প্রথম জানলেন যে মহাবিশ্বের বেশির ভাগ অংশই আমাদের পরিচিত শক্তি ও পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তখন কি হতাশ হয়েছিলেন?

মার্টিন রিজ: না। মহাবিশ্বের সবকিছুরই বিকিরণ করবে বা আলো দেবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি তা করে না।

স্টিফান ক্লেইন: বিজ্ঞানের একটি কাজ হলো আমাদেরকে নিজেদের অনুমানগুলো থেকে মুক্ত করা।

মার্টিন রিজ: ঠিক তাই।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি কি নিয়মিত গির্জায় যান?

মার্টিন রিজ: আমি চার্চ অব ইংল্যান্ডের সদস্য হিসেবে বড় হয়েছি। আমি শুধু আমার গোত্রের রীতিনীতি অনুসরণ করি। গির্জা আমার সংস্কৃতির অংশ; আমি এর আচার-অনুষ্ঠান এবং সঙ্গীত পছন্দ করি। আমি যদি ইরাকে বড় হতাম, তাহলে মসজিদে যেতাম।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি কি এর সঙ্গে আপনার বৈজ্ঞানিক বিশ্বদর্শনের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ অনুভব করেন?

মার্টিন রিজ: মোটেও না। আমার মনে হয়, যারা ধর্মের বিরোধিতা করে, তারা আসলে এটা বোঝে না। বিজ্ঞান ও ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে। অবশ্য আমি মনে করি না যে তাদের পরস্পরকে বলার অনেক কিছু আছে। আমি সবচেয়ে পছন্দ করব যদি বিজ্ঞানীরা ‘ঈশ্বর’ শব্দটিও ব্যবহার না করেন।

স্টিফান ক্লেইন: তবু বিজ্ঞান ও ধর্মের একই মৌলিক অনুপ্রেরণা: বৃহত্তর বাস্তবতার অংশ হওয়া নিয়ে আমাদের বিস্ময়।

মার্টিন রিজ: এটা সত্য। কিন্তু মৌলিক পদার্থবিদ্যা দেখায় যে পৃথিবীর সহজতম জিনিসগুলোও বোঝা আমাদের জন্য কতটা কঠিন। কেউ যখন দাবি করে যে সে কোনো গভীর বাস্তবতার চাবিকাঠি পেয়েছে, সেটা আমাকে বেশ সন্দিহান করে তোলে।

স্টিফান ক্লেইন: গির্জায় যা প্রচার করা হয়, আপনি কি তা বিশ্বাস করতে পারেন?

মার্টিন রিজ: না। আমি জানি যে আমরা এখনো হাইড্রোজেন পরমাণুও পুরোপুরি বুঝি না—তাহলে আমি কীভাবে কোনো মতবাদে বিশ্বাস করব? আমি একজন অনুশীলনকারী খ্রিস্টান, কিন্তু বিশ্বাসী নই।

স্টিফান ক্লেইন: বিজ্ঞানী হিসেবে আপনার মধ্যে বিশ্বাসের প্রতি তেমন কোনো জোরালো প্রবণতা নেই। আপনার মধ্যে বৈপরীত্য নিয়েও তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায় না। প্রায়ই একই সময়ে দুটি পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার জন্য আপনি সহকর্মী বিজ্ঞানীদের মধ্যে পরিচিত। অন্যরা যখন প্রাকৃতিক ধ্রুবকগুলো সুযোগের ফল নাকি নয়, কিংবা মহাবিশ্ব একটি নাকি অনেকগুলো—এই প্রশ্নগুলো নিয়ে তীব্র বিতর্কে লিপ্ত, তখনও আপনার মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখা যায় না।

মার্টিন রিজ: কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্বে আসক্ত হওয়াকে অযৌক্তিক মনে করি আমি। বরং আমি চাই বিভিন্ন ধারণা ঘোড়দৌড়ের মতো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক এবং আমি দেখি কোনটি জেতে।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি বুদ্ধিবৃত্তিক জুয়াড়ি।

মার্টিন রিজ: না, আমি সঠিক উত্তর খুঁজছি। এই প্রচেষ্টায় আবেগ খুব সহায়ক নয়।

আরও পড়ুন
আপনি শুধু সেই ঘটনাগুলোর সম্ভাবনা সঠিকভাবে গণনা করতে পারেন, যা প্রায়ই ঘটে। যেমন বজ্রপাত বা লটারি জেতা। আমি গত কয়েক দশকের পরিচিত হুমকিগুলোর ভিত্তিতে হিসাব করেছি।

স্টিফান ক্লেইন: কোনো বিষয়ে কি আপনি আবেগী হন?

মার্টিন রিজ: হ্যাঁ, রাজনৈতিক ইস্যুতে। আমি মোটামুটি পুরোনো ফ্যাশনের সমাজতন্ত্রী হিসেবে বড় হয়েছি। ক্রমবর্ধমান অসমতা এবং তৃতীয় বিশ্বকে বিশ্বায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে আমাদের ব্যর্থতা নিয়ে খুব চিন্তিত। শুধু আফ্রিকার কথাই ভাবুন: সেখানে দারিদ্র্য দূর করার জন্য সব সম্পদ আছে, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না।

স্টিফান ক্লেইন: আপনি মানবজাতির ব্যাপারে আরও খারাপ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আপনি অনুমান করেছেন, আমাদের সভ্যতা এই শতাব্দীটুকু টিকে থাকার সম্ভাবনা ৫০ ভাগের বেশি নয়। এই সংখ্যাটি কীভাবে পেলেন?

মার্টিন রিজ: এটি স্রেফ একটি অনুমান। আপনি শুধু সেই ঘটনাগুলোর সম্ভাবনা সঠিকভাবে গণনা করতে পারেন, যা প্রায়ই ঘটে। যেমন বজ্রপাত বা লটারি জেতা। আমি গত কয়েক দশকের পরিচিত হুমকিগুলোর ভিত্তিতে হিসাব করেছি। যেমন স্নায়ুযুদ্ধের সময় একটি পারমাণবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা মোটেও কম ছিল না। পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভয়ঙ্করভাবে সুরক্ষিত ছিল। আমরা শুধু অবিশ্বাস্য ভাগ্যবান ছিলাম। আজকের সিস্টেমগুলো ভালো। কিন্তু আগামী পঞ্চাশ বছরে সুপারপাওয়ারগুলোর মধ্যে নতুন একটি সংঘাত হতে পারে। এ ছাড়াও, সেই সময়ে যেসব ঝুঁকি ছিল না—যেমন জিনগতভাবে পরিবর্তিত অণুজীবের ঝুঁকি—এখন সেগুলোও আছে। আমি আমার অনুমানকে খুব হতাশাবাদী মনে করি না।

স্টিফান ক্লেইন: তাহলে আপনি বাজি ধরে রাখছেন যে আগামী বিশ বছরে জৈব অস্ত্রের হামলা বা জৈবপ্রযুক্তি দুর্ঘটনায় দশ লক্ষ বা তার বেশি মানুষ মারা যাবে? আপনি এতে এক হাজার পাউন্ড বাজি ধরেছেন।

মার্টিন রিজ: হ্যাঁ, অবশ্যই। আশা করি আমি বাজি হারব।

স্টিফান ক্লেইন: আপনার সহকর্মীরা আপনার ভবিষ্যদ্বাণীতে কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন?

মার্টিন রিজ: প্রায় সবাই আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। সেটা আমাকে অবাক করেছে। আমার কাছে এটা অনস্বীকার্য মনে হয় যে একবিংশ শতাব্দীর হুমকিগুলো মূলত মানুষের কাছ থেকেই আসছে এবং তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আর আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় আছি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তিকেই বিপন্ন করছি—এটাও কিন্তু পুরোটা গল্প নয়। বিশ্ব ক্রমশ আরও বেশি সংযুক্ত হয়ে ওঠার কারণে আরও কিছু বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

স্টিফান ক্লেইন: ইন্টারনেট কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে?

মার্টিন রিজ: এটি শুধু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিতই করে না, বরং পক্ষপাতিত্বকে শক্তিশালী করতে সক্ষম। ছোট ছোট গোষ্ঠী যারা চরম মতাদর্শ ধারণ করে, তারা এখন সারা বিশ্বে সমমনা মানুষ খুঁজে পেতে পারে, সংগঠিত হতে পারে এবং সহজেই প্রযুক্তিগত জ্ঞান অ্যাক্সেস করতে পারে। গণমাধ্যম যেকোনো বিভ্রান্তিমূলক কর্মের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। তাই এখন কয়েকজন মানুষও বিশাল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এটি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। যেমন একটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ সমাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেখানে সবাই সবাইকে পর্যবেক্ষণ করবে। সরকার নয়, আপনার সহনাগরিকেরা আপনার সব কাজ দেখবে।

স্টিফান ক্লেইন: ভয়ঙ্কর ধারণা।

মার্টিন রিজ: কিন্তু মানুষ এতে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে। এখানে ইংল্যান্ডে আমরা ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রশ্নগুলো নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত। আমরা সম্ভাব্য অনেক বিপর্যয়কর ঘটনার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিই না—এবং সেগুলো প্রতিরোধে যথেষ্ট বিনিয়োগও করি না।

স্টিফান ক্লেইন: বিজ্ঞানীরা এটা পরিবর্তন করতে কী করতে পারেন?

মার্টিন রিজ: তাঁরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দিতে পারেন। নাগরিক হিসেবে তাদের আরও সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন

স্টিফান ক্লেইন: আপনি কি মনে করেন যে বিজ্ঞানীরা অন্যান্য নাগরিকদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেন?

মার্টিন রিজ: তারা বিষয়গুলোকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। যেমন জ্যোতিঃপদার্থবিদ হিসেবে আমি দীর্ঘ সময়ের পরিসের চিন্তা করতে অভ্যস্ত। অনেক মানুষের কাছে ২০৫০ সাল এত দূরের বলে মনে হয় যে তা তাদের কল্পনার বাইরের বলে মনে হয়। কিন্তু আমি সব সময়ই সচেতন যে আমরা চার বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের ফল—এবং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্তত ততটা দীর্ঘ হবে। আপনার যদি মনে থাকে যে আমাদের পরে আরও কত প্রজন্ম আসতে পারে, তাহলে বর্তমানের অনেক প্রশ্নের প্রতি আপনার ভিন্ন মনোভাব তৈরি হয়। তখন আপনি বুঝতে পারবেন, কত কিছু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

স্টিফান ক্লেইন: আমরা যদি নিজেদের ভবিষ্যত নষ্ট না করি: আপনার কি পরবর্তী চারশ কোটি বছরের কোনো ধারণা আছে?

মার্টিন রিজ: বর্তমানে আমরা মানুষেরা নিশ্চিতভাবেই সৃষ্টির শীর্ষে নই। আমাদের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান প্রজাতি পৃথিবীতে বসবাস করবে। তারা খুব শীঘ্রই আবির্ভূত হতে পারে। আজকাল বিবর্তন আর ডারউইনের বর্ণনা করা ধীর প্রাকৃতিক বিকাশ দিয়ে পরিচালিত হয় না, বরং সেটা পরিচালিত হয় মানব সংস্কৃতি দিয়ে। তাই একটি পরামানবীয় বুদ্ধিমত্তা (পোস্ট হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স) হয়তো আমাদের নিজেদের হাতেই তৈরি হতে পারে। আমি আশা করি, আমাদের উত্তরসূরিরা বিশ্ব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে।

* স্টিফান ক্লেইনের নেওয়া সাক্ষাৎকার সংকলন উই আর অল স্টারডাস্ট বই থেকে নেওয়া