স্বাস্থ্যসেবা যেভাবে বদলে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ কথাটি শুনলে প্রায়ই একটি প্রজন্মের মনে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির কোনো নেতিবাচক সত্তার ছবি ভেসে ওঠে। ঘটনাটা কি সত্যিই এমন?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে এই লেখার মধ্যে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা না করাই ভালো। এর সঙ্গে আরও চলে আসবে মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং ইত্যাদি। তবে কিছুটা ধারণা নেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন একটি ব্যবস্থা, যা যান্ত্রিক প্রোগ্রাম দ্বারা তথ্য–উপাত্ত থেকে শিখতে পারে এবং সে অনুসারে কাজ করতে পারে, এমনকি মানুষ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যদিকে এর সঙ্গে মেশিন লার্নিং নিয়ে যদি একটু বলা যায়, তা হলো এই যান্ত্রিক সত্তা (পড়ুন অ্যালগরিদম) যখন সময়ের সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ করে নিজে নিজেই অনেক কিছু শিখে ফেলে এবং নিজের কর্মদক্ষতা বাড়াতে থাকে, তখন ভয় লাগারই কথা—কল্পবিজ্ঞানে দেখানো কাহিনির মতো যদি এই ‘বেশি শিখে ফেলা’ যন্ত্র অথবা প্রোগ্রাম বেঁকে বসে!
এখন কথা হলো, এই ‘বেঁকে বসার’ জন্য কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করেনি। এর মূল উদ্দেশ্য সেই স্কুলে লেখা রচনার মতো—মানবজাতির কল্যাণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা কার্যকারিতা কিংবা সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এ রকম প্রযুক্তিনির্ভর সেবার উদাহরণ আমাদের চারদিকে খুঁজলে অসংখ্য পাওয়া যাবে। এই অনেক উদাহরণের মধ্যে একটু স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেখা যাক যে কীভাবে তা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দ্বারা অভাবনীয় উন্নতির ছোঁয়া পাচ্ছে!
আচ্ছা, যদি এমন হয় যে কাশি শুনেই আপনার স্মার্টফোনের কোনো অ্যাপ বলে দিল, আপনার কোভিড-১৯ হলো কি না! অবাস্তব মনে হলেও এমনই একটি এআই–ভিত্তিক প্রযুক্তি তৈরি করেছে অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। ভেবে দেখুন, রোগ শনাক্তকরণ কতটা সহজ ও সুলভ হয়ে উঠতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক ও সফল প্রয়োগের মাধ্যমে। আপনার হাতের কাছের এ রকম একটি ছোট উদাহরণ হলো ‘হেলথ ট্র্যাকার ডিভাইস’, যেগুলো আপনারা স্মার্টওয়াচ হিসেবে পরেন অনেকে। আকর্ষণীয় এই ছোট ডিভাইসগুলো কিন্তু খুব ছোট পরিসরে এআই ব্যবহার করা শুরু করেছে আপনার স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই আপনাকে দিতে পারে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরামর্শ, রাখতে পারে রেকর্ড ইত্যাদি। ইলন মাস্ক সাহেবের নিউরালিংকের নাম যদি শুনে থাকেন, এটি এমন একটি এআই–সংযুক্ত ব্রেন ইমপ্ল্যান্ট (মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করানো হবে সরাসরি নির্দেশ প্রেরণ কিংবা নিউরাল সিগন্যাল গ্রহণের জন্য), যার অমিত সম্ভাবনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মূলত তৈরি হচ্ছে আলঝেইমার ডিজিজের মতো নিউরাল ডিজঅর্ডার বা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অসুস্থতাকে উদ্দেশ করে। তবে এর ব্যবহার আরও ব্যাপক হতে পারে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ওপর নির্ভর করে। ইতিমধ্যে নিউরালিংক ঘোষণা দিয়েছে, কীভাবে এআই দিয়ে এই যন্ত্র যেকোনো ভাষাকে মানুষের কাছে বোধগম্য করে তুলবে, সেই ভাষা কষ্ট করে শেখার প্রয়োজন ছাড়াই। তা ছাড়া শরীরে অবস্থানরত অবস্থায় নির্দিষ্ট শারীরিক অসুস্থতাকে শনাক্ত করে তা হয়তো রিপোর্ট করতে পারবে অদূর ভবিষ্যতেই। এ রকম আরও অনেক গবেষণাকাজ হচ্ছে এআই পরিচালিত ইমপ্ল্যান্ট ও সফটওয়্যার নিয়ে, যেগুলো আপনাকে হয়তো দিতে পারে তাৎক্ষণিক সেবা কিংবা পরামর্শ। ঠিক সে রকম আরেকটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বডি ইমপ্ল্যান্ট হরমোন রেগুলেটরের কথা—এই ডিভাইসগুলো আপনার শরীরে বসানো থাকবে এবং আপনার সিস্টেমে কোনো হরমোন ঠিকভাবে ক্ষরিত না হলে সেটা ডিটেক্ট করবে। এ ক্ষেত্রে প্রোগ্রাম নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে এবং ডিভাইসটি আপনার শরীরের প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট হরমোন ইনজেক্ট করে দেবে। স্মার্ট ডিভাইস ও এআইয়ের মিশেলে আপনার স্মার্টফোনের ক্যামেরাটি হয়ে উঠতে পারে পোর্টেবল মেডিকেল ইমেজিংয়ের মাধ্যম। ছবিটি ডিভাইস নিজে কিংবা আরও ক্ষমতাশালী নেটওয়ার্ক দ্বারা বিশ্লেষণ করে হয়তো রোগ নির্ণয় করে দিতে পারবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষণের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পাবলিক হেলথ বা গণস্বাস্থ্য গবেষণানির্ভর তথ্যগুলো দিয়ে বেশ কিছু জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এমনকি তা পলিসি মেকিং, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে কাজে লাগতে পারে।
রোগনির্ণয় ছাড়াও খুঁজলে পাওয়া যাবে স্বাস্থ্যসেবায় এআইয়ের বহুল ব্যবহার। ক্লিনিক্যাল ডিসিশনগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি, মেডিকেল ডেটাগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, বিশ্লেষণের গতি বৃদ্ধি ইত্যাদি সুফল আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। এখন যদি একটু গবেষণার দিকে নজর দিই, বহু সরকারি–বেসরকারি শিক্ষা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিশাল অঙ্কের অর্থ ও মেধা ঢালছে কীভাবে নতুন নতুন এআই–ভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি সুফল বয়ে নিয়ে আসা যায়। সেজন্য নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার করা, হেলথ মনিটরিং, ড্রাগ ডেলিভারি, মানে কীভাবে ওষুধকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় ইত্যাদি গবেষণার সক্ষমতা ও গতি এআই আসার পর অভূতপূর্বভাবে বেড়ে গেছে। রোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা পরিকল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগ ও রোগীর পূর্ব ইতিহাস, আনুষঙ্গিক অনেক তথ্য ইত্যাদির সঠিক ও সময়োপযোগী বিশ্লেষণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যা কিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত কোনো ব্যবস্থা দিয়ে সহজে ও দ্রুততার সঙ্গে করা সম্ভব।
স্যার আইজাক আসিমভের মতো অনেক বাঘা বাঘা কল্পবিজ্ঞান লেখকের গল্পে ‘চিকিৎসক রোবট’–এর কথা উঠে এসেছে। অনেক রকমের এই রোবটের মধ্যে সার্জন রোবট রয়েছে বর্তমানে, যেগুলো অপারেশন টেবিলে সুচারুভাবে করে যাচ্ছে এমন সব সার্জারি, যা হয়তো মানুষের পক্ষে করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। তবে কালের বিবর্তনে এআই পরিচালিত চিকিৎসক রোবটগুলোর অনেক উন্নতি হয়েছে ও হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অনেকে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে ও রোগীর সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে পারে। কিছু রোবট আছে কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা, ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, অল্পবিস্তর কথা বলা, ফিজিক্যাল থেরাপিতে সাহায্য করা—এসব কাজ মানুষের বদলে করতে পারে। এমনকি মানসিক চিকিৎসা কিংবা মৃত্যুপথযাত্রী প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকা রোগীর সাহচর্যে থেকে কিছুটা কষ্ট লাঘবের কাজেও এআই ও রোবটিকসের ব্যবহার হচ্ছে।
সাইবর্গকে কেউ যদি চিনে থাকেন, তাহলে হয়তো জানবেন, ডিসি কমিকসের এই চরিত্র একটি দুর্ঘটনায় নিজের হাত–পা হারায় এবং তার বৈজ্ঞানিক বাবা একটি অতি উন্নত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি দিয়ে ছেলের শরীর পুনর্গঠন করেন এবং সে অতিমানবীয় ক্ষমতা লাভ করে সাইবর্গে পরিণত হয়। এখন আমাদের আশপাশে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কোনো কারণে শারীরিক অপূর্ণতা বরণ করে নেন কোনো দুর্ঘটনা কিংবা জন্মগত ত্রুটির কারণে। এ রকম সাইবর্গের মতো আর্টিফিশিয়াল শারীরিক অঙ্গ সংযোজন কিংবা প্রতিস্থাপন করে কিন্তু সেসব মানুষকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, যদিও সেটা অতিরঞ্জিত সুপারপাওয়ারসম্পন্ন হবে না। বর্তমানে এ রকম কৃত্রিম অঙ্গ, যেমন হাত, পা, চোখ ইত্যাদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মিশেলে তৈরি করা যায়, যেগুলো অনেক ক্ষেত্রে আসল অঙ্গের কাছাকাছি কাজ করে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষণের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পাবলিক হেলথ বা গণস্বাস্থ্য গবেষণানির্ভর তথ্যগুলো দিয়ে বেশ কিছু জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। এমনকি তা পলিসি মেকিং, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে কাজে লাগতে পারে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে উন্মোচিত হওয়া আয়ের পন্থাও অনেক টেক কোম্পানিকে আগ্রহী করেছে এই খাতে গবেষণা ও বিনিয়োগ করতে। যেমন গুগলের ‘ডিপমাইন্ড’, আইবিএমের ‘ওয়াটসন ফর হেলথ’–এর মতো আরও অনেক এআই–ভিত্তিক প্রযুক্তি রয়েছে, যেগুলো বিপুল পরিমাণে ‘হেলথ ডেটা’ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে নতুন নতুন স্বাস্থ্যসেবা উদ্ভাবনের জন্য। প্রযুক্তি নিয়ে যেহেতু কথা, এর ঝুঁকিগুলো একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তথ্য অপব্যবহার, তথ্য হারানো ইত্যাদি আশঙ্কা ছাড়াও আরও কিছু দিক আছে, যার কারণে এআইকে এখনো অনেক দূর এগোতে হবে সুষ্ঠুভাবে নির্ভুল অবস্থানে থেকে সেবা প্রদান করার সামর্থ্য লাভ করার জন্য। সেবার ক্ষেত্রে কৃত্রিমতার মাত্রাছাড়া ব্যবহার যেন আমাদের মানবিকতার স্পর্শকে একেবারে শূন্য করে না ফেলে।
এখন আমাদের আশপাশে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কোনো কারণে শারীরিক অপূর্ণতা বরণ করে নেন কোনো দুর্ঘটনা কিংবা জন্মগত ত্রুটির কারণে।
এআইয়ের সবচেয়ে বড় সম্ভাব্য সুবিধাগুলোর একটি হলো চিকিৎসকের প্রয়োজন ছাড়াই মানুষকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করা। গবেষকেরা কাজ করে যাচ্ছেন চিকিৎসা বা গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিকে এআই দিয়ে আরও দক্ষ ও সক্ষম করে তুলে সর্বোচ্চ মানের সেবাটুকু বের করে নিয়ে আসতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে স্বাস্থ্যসেবা হয়ে উঠেছে আরও গতিশীল ও কার্যকর। এর মাধ্যমে রোগীর চাহিদাগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এতে করে সুস্থ থাকার জন্য নির্দেশনা ও সহায়তা আরও ভালোভাবে প্রদান করা সম্ভব হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও উন্নত করা যায়—এ বিষয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অসীম সম্ভাবনার দ্বার খোলা রয়েছে আমাদের তরুণসমাজের জন্য। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি আমরা শিগগিরই এবং স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি, টুলস, অ্যাপ, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ইত্যাদি গবেষণার নতুন ক্ষেত্রের সৃষ্টি হবে, যা মাথায় রেখে আমাদের এখন থেকেই কাজ শুরু করাটা সত্যিকার বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন বলা চলে।