যুক্ত্ররাষ্ট্রে বসে কীভাবে আফ্রিকায় অপারেশন করলেন ডক্টর প্যাটেল

ডাক্তার নিজ হাতে অস্ত্রোপচার না করে ব্যবহার করেন একটা রোবট

ডাক্তার আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। রোগী আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলার এক হাসপাতালে। দুজনের দূরত্ব প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার। ফ্লোরিডা থেকে ডাক্তার রোগীর সফলভাবে অপারেশন করেছেন। এটা কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। চিকিৎসা প্রযুক্তির এক অবিশ্বাস্য সাফল্য সম্প্রতি দেখা গেছে। 

অ্যাঙ্গোলার বাসিন্দা ফার্নান্দো দা সিলভা ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর শরীরে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হওয়া এই রোগের চিকিৎসার জন্য সার্জারির প্রয়োজন ছিল। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার বিখ্যাত সার্জন বিপুল প্যাটেল। তিনি প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে সার্জারি করলেন। তাতে সফলও হলেন। আর চিকিৎসার মাধ্যমে খুলে গেল চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন দুয়ার। কিন্তু এত দূর থেকে কীভাবে কাজটা করলেন ডাক্তার? 

আসলে ডাক্তার নিজ হাতে অস্ত্রোপচার না করে ব্যবহার করেন একটা রোবট। সেই রোবটকে দূর থেকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। অ্যাভাটার মুভির প্রথম পার্টে মানুষ বিশালার রোবটের মধ্যে বসে রোবটটিকে পরিচালনা করেন। রোবটের ভেতরের মানুষটি নিজের ছোট হাতে ঘুষি পাকালে বিশালাকার রোবটও ঘুষি পাকায়। আবার মানুষটি দৌড় দিলে দৌড় লাগায় দানবাকার রোবট। ওই একই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে এই চিকিৎসায়।

বিপুল প্যাটেল এ পর্যন্ত প্রায় ১৮-২০ হাজার রোবটিক সার্জারি করেছেন। তবে সাধারণত তিনি রোগীর সঙ্গে একই ঘরে থাকা কনসোল থেকে অপারেশন করেন।

এই ধরনের রোবটিক সার্জারিতে সার্জন সরাসরি রোগীকে স্পর্শ করেন না। তিনি একটি বিশেষ কনসোলে বসেন। সেখান থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল হাতলগুলো তিনি নাড়াচাড়া করেন। আর হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা রোবটের ছোট ছোট হাতগুলো ঠিক সেভাবেই নড়াচড়া করে রোগীর শরীরে নিখুঁতভাবে অস্ত্রোপচার চালায়। ডক্টর প্যাটেল যখন হাত নাড়ান, রোবটের হাতগুলোও ঠিক সেভাবেই নড়ে।

আরও পড়ুন

এই যুগান্তকারী প্রক্রিয়াটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রান্সকন্টিনেন্টাল রোবটিক টেলিসার্জারি’। ডক্টর প্যাটেল ফ্লোরিডায় তার কনসোলে বসে একটি থ্রিডি স্ক্রিনে সবকিছু দেখছিলেন। তার হাতের প্রতিটি নড়াচড়া সমুদ্রের নিচ দিয়ে যাওয়া ফাইবার-অপটিক কেবলের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে অ্যাঙ্গোলার অপারেটিং রুমে থাকা রোবটের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল। ফাইবার-অপটিক প্রযুক্তি অন্যান্য যোগাযোগ পদ্ধতির চেয়ে অনেক দ্রুত এবং অনেক দূরে ডেটা পাঠাতে পারে। 

বিপুল প্যাটেল এ পর্যন্ত প্রায় ১৮-২০ হাজার রোবটিক সার্জারি করেছেন। তবে সাধারণত তিনি রোগীর সঙ্গে একই ঘরে থাকা কনসোল থেকে অপারেশন করেন। কিন্তু এই প্রথম এত দূর থেকে সার্জারি করলেন এবং সফলও হলেন। তিনি জানান, এবার ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাতের নড়াচড়া এবং রোবটের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে তেমন কোনো বিলম্ব বা দেরি অনুভব করেননি। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা বিশ মিনিট।

ডক্টর প্যাটেল যখন হাত নাড়ান, রোবটের হাতগুলোও ঠিক সেভাবেই নড়ে

এই ধারণাটি নতুন মনে হলেও আসলে অনেক পুরোনো। প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রে রোবট দিয়ে অস্ত্রোপচার হয় ১৯৮৫ সালে। তখন ব্যবহার হয়েছিল ‘পুমা ৫৬০’ নামে একটি রোবট। সেবার রোবটের সাহায্যে মস্তিষ্কের টিউমার অপারেশন করা হয়। পরে ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ‘দ্য ভিঞ্চি’ নামের একটি সার্জিকাল রোবটকে অস্ত্রপচারের অনুমোদন দেয়। এখন এই প্রযুক্তি নানা ধরণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ক্যানসার, হৃদরোগ এমনকি কিডনির জটিল সমস্যায়ও ব্যবহৃত হয় রোবটিক সার্জারি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় ১২ লাখ রোবোটিক অস্ত্রোপচার হয়। তবে দূর থেকে এমন সার্জারির করে প্রথম বড় সাফল্য এসেছিল ২০০১ সালে। ‘লিন্ডবার্গ অপারেশন’ নামে পরিচিত সেই সার্জারিতে ফ্রান্সের একজন রোগীর পিত্তথলি অপসারণ করেছিলেন নিউইয়র্কে থাকা একজন সার্জন। তবে ফ্লোরিডা থেকে অ্যাঙ্গোলার এই অপারেশনের দূরত্ব এক নতুন মাইলফলক তৈরি করেছে।

ডক্টর প্যাটেল যে রোবটটি ব্যবহার করেছেন, সেটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত সার্জিক্যাল রোবট ‘দা ভিঞ্চি সার্জিক্যাল সিস্টেম’। এই সিস্টেম ব্যবহারে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের একজন ডক্টর প্যাটেল।

আরও পড়ুন
স্থানীয় টিমের হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন হয়নি। এবং দা সিলভার সার্জারি সম্পূর্ণ সফল হয়। ডক্টর প্যাটেলের বিশ্বাস, এই রোবটিক প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের সার্জারি করার সুযোগ করে দেবে।
প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রে রোবট দিয়ে অস্ত্রোপচার হয় ১৯৮৫ সালে

অপারেশনের সময় তিনি আমেরিকায় থাকলেও তাঁর একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম রোগীর পাশে অ্যাঙ্গোলার অপারেটিং রুমে উপস্থিত ছিলেন। ডক্টর প্যাটেল বলেন, ‘রোগী যেখানে থাকে, আমার একটি টিম সবসময় সেখানে উপস্থিত থাকে। যদি কোনো কারণে টেলিযোগাযোগে সমস্যা হতো, তাহলে আমার স্থানীয় টিম সঙ্গে সঙ্গে অপারেশনের দায়িত্ব নিত এবং নিরাপদে তা শেষ করত।’ 

তবে সৌভাগ্যবশত, স্থানীয় টিমের হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন হয়নি। এবং দা সিলভার সার্জারি সম্পূর্ণ সফল হয়। ডক্টর প্যাটেলের বিশ্বাস, এই রোবটিক প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের সার্জারি করার সুযোগ করে দেবে। ফলে কম উন্নত এলাকার মানুষও ভবিষ্যতে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবে। তারাও পাবে সেরা ডাক্তারদের সেবা। তাঁর আশা, এই প্রযুক্তি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো জরুরি পরিস্থিতিতেও মানুষের জীবন বাঁচাতে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি একদিন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাকাশে থাকা নভোচারীদেরও পৃথিবীতে বসে চিকিৎসা করা সম্ভব হবে।

সূত্র: নাসা টেক পোর্ট, নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন, ২০০১, গ্লোবাল রোবটিক্স ইনস্টিটিউট ও দ্য উইক জুনিয়র

আরও পড়ুন