মোবাইল ব্যবহার কি কিশোরদের জন্য সত্যিই ক্ষতিকর

বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত প্রশ্ন—স্মার্টফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষকেরা নিজেরাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছেন। অনেকের আশা ছিল, বিজ্ঞানীরা হয়তো এ ব্যাপারে একটা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। গবেষণাটি শুরু হয়েছিল সহমত তৈরির আশায়, কিন্তু শেষ হয়েছে বিতর্ক দিয়ে।

ইতালির ইউনিভার্সিটি অব মিলান-বিকোকার অধ্যাপক ভ্যালেরিও ক্যাপরারো ও তাঁর শতাধিক সহকর্মী মিলে স্মার্টফোন ব্যবহারের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে একটি সর্বসম্মত বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। এই দলের গবেষকেরা ১১টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। তাঁরা মোট ২৬টি দাবি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। এই দাবিগুলো নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির জনাথন হেইটের লেখা দ্য অ্যানাক্সিয়াস জেনারেশন (The Anxious Generation) বই থেকে। এই বইটি যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি অনেক গবেষক আবার এর তীব্র সমালোচনাও করেছেন। হেইট নিজেও এই গবেষণার সহলেখক ছিলেন।

বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ এই বিষয়ে কাজ করেন। সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো বাস্তবসম্মত নয়। তবে আমরা অনেক দিক বিবেচনায় নিয়ে যতটা সম্ভব বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছি।

গবেষকেরা প্রতিটি দাবির পক্ষে বা বিপক্ষে মত জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি প্রমাণ কতটা শক্তিশালী, সেটাও আলাদাভাবে রেটিং করেছিলেন। কিছু বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে ঐকমত্য দেখা গিয়েছে। যেমন, ৯৯ শতাংশ বিজ্ঞানী একমত হয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপের দিকে গেছে। ৯৮ শতাংশ বলেছেন, অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। আর ৯৪ শতাংশের বেশি একমত যে, নিজেকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা, সবসময় সুন্দর দেখাতে চাওয়া এবং অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার মতো বিষয়গুলো কিশোরীদের মানসিক চাপে ফেলছে।

আরও পড়ুন

তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। তা হলো, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দাবিগুলোর পক্ষে যে প্রমাণ রয়েছে তা শুধু সহসম্পর্কযুক্ত, কার্যকারণ নয়। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। যখন কোনো দুটি জিনিসের মধ্যে সহসম্পর্ক থাকে, তখন তারা একসঙ্গে ঘটে বা পরিবর্তিত হয়। যেমন, স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বেড়ে যাওয়া। এর মানে এই নয় যে একটির কারণেই অন্যটি ঘটছে। হতে পারে অন্য কোনো কারণে দুটি ঘটনাই ঘটেছে বা কাকতালীয়ভাবে একসঙ্গে ঘটেছে ঘটনাটা। কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্ক মানে একটি জিনিস সরাসরি অন্যটির কারণে হয়েছে। এককথায়, আমরা শুধু দেখছি, স্মার্টফোন ব্যবহারের সঙ্গে কিছু সমস্যার সম্পর্ক আছে, কিন্তু একে অপরের কারণ কিনা, তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। বিষয়টা স্পষ্ট করতে আরও গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার প্রয়োজন। এ কারণে গবেষকদের অর্ধেকের একটু বেশি—মাত্র ৫২ শতাংশ—স্কুলে ফোন নিষিদ্ধ করা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে বয়সসীমা নির্ধারণের মতো কঠোর নীতির পক্ষে মত দিয়েছেন।

তবে গবেষণাপত্রের লেখকেরা মনে করেন, শুধু কারণ ও সম্পর্কের প্রমাণ না থাকার মানে এই নয় যে নীতিনির্ধারকদের বসে চিন্তিত হয়ে বসে থাকা উচিত। নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় অল্প তথ্যের আলোকেই। অপেক্ষা করতে করতে যেন পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়ে যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর এতেই শুরু হয়েছে মূল বিতর্ক। যাঁরা এই গবেষণায় অংশ নেননি, তাঁদের অনেকেই এর ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, যুক্তরাজ্যের বাথ স্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিট এটচেলস বলেছেন, ২৮৮ জন বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও মাত্র ১২০ জন এতে অংশ নেন। এটচেলসের মতে, এমন সমীক্ষায় সাধারণত অংশ নেন তাঁরাই, যাঁরা স্মার্টফোনের নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারে আগে থেকেই চিন্তিত। এতে ফলাফল ‘বায়াসড’ হয়ে যেতে পারে। তিনি আরও জানতে চেয়েছেন—এই বিশেষজ্ঞদের বাছাই কীভাবে হয়েছে? 

৯৯ শতাংশ বিজ্ঞানী একমত হয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপের দিকে গেছে। ৯৮ শতাংশ বলেছেন, অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক সোনিয়া লিভিংস্টোনও এর সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, এই গবেষণায় যেসব দাবি বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলো একপাক্ষিক। তাঁর প্রশ্ন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি বন্ধুত্ব তৈরি করে না? কারো কি আত্মবিশ্বাস বাড়ে না? এই দিকগুলো নিয়ে প্রশ্নই করা হয়নি কেন?’ তাঁর মতে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা যদি ভারসাম্যহীন হয়, তবে সেটি বিজ্ঞানই নয়।

আরও পড়ুন

অবশ্য ক্যাপরারো বলছেন, ‘বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ এই বিষয়ে কাজ করেন। সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো বাস্তবসম্মত নয়। তবে আমরা অনেক দিক বিবেচনায় নিয়ে যতটা সম্ভব বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছি।’

এসব বিতর্কের মধ্যেও একটি জিনিস স্পষ্ট—কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সবাই চিন্তিত। তবে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর একমাত্র কারণ কি না, তা নিয়ে মতভেদ থেকেই যাচ্ছে।

এসব বিতর্ক সত্ত্বেও একটি বিষয় পরিষ্কার—কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বর্তমানে উদ্বেগের বিষয়; আর স্মার্টফোনের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও প্রশ্নটা উপেক্ষা করার মতো নয়।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

আরও পড়ুন