বিমান দুর্ঘটনা কেন হয়

উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তছবি: মীর হোসেন

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সোমবার এ কথা জানায়। বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির মুখে পড়ে। প্রশ্ন হলো, বিমানে সাধারণত কী ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যায়?

আধুনিক বিমান হাজারো জটিল যন্ত্রাংশের এক বিস্ময়কর সমন্বয়। যান্ত্রিক ত্রুটি মানে, সেন্সর, সফটওয়্যার, কন্ট্রোল সিস্টেম বা যেকোনো কিছুর ত্রুটিকেই বোঝায়। একটি বিশাল ধাতুর পিণ্ড কীভাবে হাজার হাজার ফুট উপরের আকাশে উড়ে বেড়ায়, তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু মাঝেমধ্যে আধুনিক এই প্রযুক্তিও ব্যর্থ হয়। ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বিমান দুর্ঘটনার কারণ বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে একটি বিমান কীভাবে আকাশে ওড়ে।

একটি বিমানের ডানায় বিশেষ আকৃতি থাকে যাকে বলা হয় এয়ারফয়েল। এই ডানার উপরের অংশ নিচের অংশের চেয়ে বেশি বাঁকানো থাকে। যখন বিমান দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়, তখন ডানার উপর দিয়ে বাতাস নিচের দিকের চেয়ে দ্রুত প্রবাহিত হয়। বার্নুলির নীতি অনুযায়ী, দ্রুত প্রবাহিত বাতাসের চাপ কম হয়। ফলে ডানার নিচের অংশে বেশি চাপ এবং উপরের অংশে কম চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপের পার্থক্যই বিমানকে উপরের দিকে ঠেলে দেয়। একে বলা হয় লিফট। একইসঙ্গে ইঞ্জিনের থ্রাস্ট বা ঠেলা বিমানকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর ড্র্যাগ বা বাতাসের বাধা এবং ওজন বিমানকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।

আরও পড়ুন

এই চারটি বল যখন সুষম থাকে, তখন বিমান নিরাপদে উড়তে পারে। কিন্তু কোনো একটি বলের ভারসাম্য নষ্ট হলেই শুরু হয় সমস্যা। সেই সমস্যাটা অনেক সময় গুরুতরও হয়ে উঠতে পারে। বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি, মানবিক ভুল, আবহাওয়াগত সমস্যা এবং বাহ্যিক কারণ।

হাইড্রোলিক সিস্টেম বিকল হওয়াও একটি বড় সমস্যা। বিমানের রুডার (উল্লম্বভাবে বিমানের গতিপথ পরিবর্তন করতে ব্যবহৃত হয়), এইলেরন, এলিভেটর এবং ফ্ল্যাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয় হাইড্রোলিক চাপের মাধ্যমে।

যান্ত্রিক ত্রুটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিন বিকল হওয়া। একটি জেট ইঞ্জিন মূলত একটি গ্যাস টারবাইন। এতে রয়েছে কম্প্রেসর, কম্বাশন চেম্বার এবং টারবাইন। কম্প্রেসর বাতাসকে চাপ দিয়ে কম্বাশন চেম্বারে পাঠায়। সেখানে জ্বালানির সাথে মিশে জ্বলে ওঠে এবং প্রচণ্ড গতিতে গ্যাস বের হয়ে যায়। এই গ্যাসের চাপই বিমানকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কম্প্রেসরের ব্লেড ভেঙে গেলে, জ্বালানি সিস্টেমে সমস্যা হলে বা টারবাইনে অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি হলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

হাইড্রোলিক সিস্টেম বিকল হওয়াও একটি বড় সমস্যা। বিমানের রুডার (উল্লম্বভাবে বিমানের গতিপথ পরিবর্তন করতে ব্যবহৃত হয়), এইলেরন, এলিভেটর এবং ফ্ল্যাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয় হাইড্রোলিক চাপের মাধ্যমে। এই সিস্টেমে তেল বা বিশেষ তরল অত্যন্ত উচ্চ চাপে (প্রায় ৩০০০ পিএসআই) প্রবাহিত হয়। এই তরলের চাপেই পাইলট স্টিয়ারিং করতে পারে। যদি হাইড্রোলিক লাইনে ছিদ্র থাকে বা পাম্প বিকল হয়, তাহলে পাইলট বিমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। একইভাবে, বৈদ্যুতিক সিস্টেমে শর্ট সার্কিট বা পাওয়ার ফেইলর হলে বিমানের কম্পিউটার ও সেন্সরগুলো ভুল তথ্য দিতে শুরু করে বা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, যা অটোপাইলট সিস্টেমকে বিভ্রান্ত করতে পারে এবং পাইলটকে ভুল পথে চালিত করে দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে একজন পাইলট নিহত হন। ছবিতে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে
ছবি: ডেইলি স্টার
আরও পড়ুন

বিমানের কাঠামোগত ত্রুটিও মারাত্মক হতে পারে। বিমানের ধাতব অংশ বারবার চাপ ও টান সহ্য করার কারণে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। একে বলা হয় মেটাল ফ্যাটিগ। প্রতিটি উড্ডয়নের সময় বায়ুর চাপে বিমানের কাঠামো সামান্য প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। হাজার হাজার বার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ফলে ধাতুর ভেতরে অতি ক্ষুদ্র ফাটল তৈরি হতে পারে। সেটাই একসময় বড় আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি উড্ডয়নের সময় হুট করে ডানা বা ফিউজেলাজ ভেঙে পড়তে পারে। এছাড়া, লবণাক্ত বা আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বিমানের ধাতব অংশে মরিচা বা ক্ষয় হতে পারে, যা এর শক্তি কমিয়ে দেয়। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো শনাক্ত করা না গেলে, তা কাঠামোগত ব্যর্থতার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বিমান চালনার নিরাপত্তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিপিএস নেভিগেশন, কলিশন এভয়েডেন্স সিস্টেম এবং উন্নত রাডার ব্যবস্থা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমিয়েছে।

আরেকটি বড় কারণ হলো জ্বালানি ব্যবস্থায় সমস্যা। জ্বালানি ট্যাংকে ফুটো, জ্বালানি পাম্প বিকল হওয়া বা জ্বালানি লাইনে বরফ জমে যাওয়ায় ইঞ্জিনে তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যাকে 'ফুয়েল স্টারভেশন' বলা হয়। এছাড়া ইঞ্জিনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশ, যেমন টারবাইন ব্লেড বা বিয়ারিং, অতিরিক্ত তাপ বা ব্যবহারের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙে যেতে পারে, যা ভয়াবহ বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত করতে পারে। যদিও একটি ইঞ্জিন বিকল হলে অন্য ইঞ্জিন দিয়ে বিমান চালানো সম্ভব, কিন্তু বিরল ক্ষেত্রে একাধিক ইঞ্জিন বিকল হলে পরিস্থিতি বিপর্যয়কর হয়ে ওঠে।

বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার বা চাকা সংক্রান্ত ত্রুটিও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। অবতরণের সময় ল্যান্ডিং গিয়ার যদি সঠিকভাবে বেরিয়ে না আসে বা লক না হয়, তাহলে বিমানকে পেটের ওপর ভর দিয়ে রানওয়েতে অবতরণ করতে হয়, যা 'বেলি ল্যান্ডিং' নামে পরিচিত। এর ফলে আগুন ধরে যাওয়া বা বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। টায়ার ফেটে যাওয়া বা ব্রেক সিস্টেমে ত্রুটিও অবতরণের সময় বিমানকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন

আবার বিমানের ভেতরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং অক্সিজেন সিস্টেমের ত্রুটিও পরোক্ষভাবে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। কেবিনের ভেতর বাতাসের চাপ কমে গেলে বা ডিপ্রেসারাইজেশন ঘটলে যাত্রীদের পাশাপাশি পাইলটরাও হাইপোক্সিয়া বা অক্সিজেনের অভাবে জ্ঞান হারাতে পারেন। পাইলট অচেতন হয়ে পড়লে একটি সচল বিমানও ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে।

যান্ত্রিক ত্রুটি ছাড়াও মানবিক ভুল, আবহাওয়াগত সমস্যাসহ আরও কিছু বাহ্যিক কারণেও একটি বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে।

মানবিক ভুলের মধ্যে রয়েছে পাইলটের সিদ্ধান্তহীনতা, ভুল বিচার এবং অভিজ্ঞতার অভাব। উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে। পাইলটকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রানওয়েতে অবতরণের সময় বিমানের গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৫০-২০০ কিলোমিটার থাকে। এই সময় সামান্য ভুলও বিপজ্জনক হতে পারে। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের ভুল নির্দেশনাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। রাডারে ভুল তথ্য দেখা বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে দুটি বিমান একই এলাকায় চলে আসতে পারে।

জ্বালানি ট্যাংকে ফুটো, জ্বালানি পাম্প বিকল হওয়া বা জ্বালানি লাইনে বরফ জমে যাওয়ায় ইঞ্জিনে তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যাকে 'ফুয়েল স্টারভেশন' বলা হয়।

আবহাওয়াগত সমস্যার মধ্যে রয়েছে বজ্রঝড়, ঘূর্ণিঝড়, কুয়াশা এবং বরফ। বজ্রঝড়ের সময় প্রচণ্ড বাতাস প্রবাহিত হয় যাকে বলা হয় উইন্ড শিয়ার। এই বাতাস বিভিন্ন দিকে এবং বিভিন্ন গতিতে প্রবাহিত হয়। ফলে বিমানের উপর অসম চাপ পড়ে এবং পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। বজ্রপাত বিমানে আঘাত করলেও ক্ষতি হতে পারে, যদিও আধুনিক বিমানগুলো বিদ্যুৎ নিরোধক উপাদান দিয়ে তৈরি।

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বিমান চালনার নিরাপত্তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিপিএস নেভিগেশন, কলিশন এভয়েডেন্স সিস্টেম এবং উন্নত রাডার ব্যবস্থা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমিয়েছে। তবে অনেকে মনে করেন, বিমান দুর্ঘটনা সম্পূর্ণভাবে এড়ানো সম্ভব নয়। তার কারণ যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাব। সে কারণে ক্রমাগত গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে বিমান চালনাকে আরও নিরাপদ করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন গবেষকরা। তবে এখনো বিমান যেকোনো বাহনের তুলনায় নিরাপদ। আধুনিক বিমানের এক্সিডেন্টের হার খুব কম।

সূত্র: এনটিএসবি, আইআরএমইন্ডিয়া ডট ওআরজি, ফ্লাই উইথ কারেজ ডট কম, প্রথম আলো

আরও পড়ুন