মাইলস্টোনে বিধ্বস্ত এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের খুঁটিনাটি

এফটি-৭ বিজিআই বিমানটি প্রায় ১৪.৮৮ মিটার দীর্ঘউইকিপিডিয়া

গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩১ জন (এ লেখার সময় পর্যন্ত)। আহত হয়েছেন ১৬৫ জন। ২২ জুলাই, মঙ্গলবার সকালে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের বিবৃতিতে এ তথ্য জানা গেছে।

অত্যন্ত দুঃখজনক এই ঘটনায় আলোচনায় এসেছে সংশ্লিষ্ট বিমানটি। এই বিমানটির গঠন কেমন, কেন এটি এভাবে বিধ্বস্ত হলো, এতে কী ধরনের জ্বালানি ছিল এবং তা কতটা মারাত্মক—এরকম নানা প্রশ্ন উঠে আসছে বারবার। এই লেখায় এরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে।

এফটি-৭ বিজিআই: কোত্থেকে, কীভাবে এল বাংলাদেশে

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যে উঠে এসেছে, এই বিমানটির মডেল এফ-৭ বিজিআই। তবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিমানটির মডেল এফটি-৭ বিজিআই। সংবাদ মাধ্যমে উল্লেখিত ‘প্রশিক্ষণ বিমান’ ভাষাটি নিয়ে আইএসপিআরের বরাত দিয়ে প্রথম আলো লিখেছে, ‘মাইলস্টোনের ঘটনায় কিছু সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে, বিমানটি একটি প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। আমরা বিনীতভাবে আবারও জানাতে চাই, এটি ছিল যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী একটি যুদ্ধবিমান। বিমানটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল।’

আরও পড়ুন

অর্থাৎ এটি একটি যুদ্ধবিমান। এই বিমানের পূর্বসূরির খোঁজ করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে। ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি বিখ্যাত যুদ্ধবিমান মিগ-২১ (MiG-21) ছিল আকাশযুদ্ধের কিংবদন্তি। এর নকশার ওপর ভিত্তি করে চীন তৈরি করে তাদের নিজস্ব যুদ্ধবিমান চেংদু জে-৭ (Chengdu J-7)। সেটাও ১৯৬৪ সালের কথা। আর এই জে-৭ এরই উন্নত সংস্করণ হলো এফটি-৭ বিজিআই।

বিমানটির শক্তির উৎস হলো চীনের তৈরি লিয়াং ওপেন-১৩এফ (Liyang Wopen-13F) আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন। সাধারণ অবস্থায় এই ইঞ্জিন ৪৪.১ কিলোনিউটন থ্রাস্ট (ধাক্কা) তৈরি করে।

চীন মূলত নিজেদের বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য জে-৭ তৈরি করে। বহু পরে এসে এর বিভিন্ন সংস্করণ বিশ্বের নানা দেশের কাছে বিক্রি করে। এর মধ্যে আছে পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ইরান, মিশর, নাইজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, নামিবিয়া ইত্যাদি দেশ। হয়তো বুঝতে পারছেন, এই বিমানগুলোর মূল ক্রেতা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো। আর এই বিমানের বিভিন্ন সংস্করণের সাধারণ মডেল হলো এফ-৭।

নিশ্চিত করে দিন-তারিখ বলার উপায় নেই, তবে জানা যায় ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে বা ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে চীন এই বিমান রপ্তানি শুরু করে। প্রথম এই বিমান কিনে নেয় আলবেনিয়া ও তানজানিয়া।

এর বহু পরে এসে, ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে এই বিমানের উন্নত ও আধুনিক সংস্করণ এফটি-৭ বিজিআই নিয়ে এক চুক্তি হয়। দ্য ইকোনোমিক টাইমস-এর তথ্যানুসারে, এই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে বিমানগুলো হস্তান্তর করা হয়। এর পরপরই জে-৭/এফ-৭ সিরিজের বিমান উৎপাদন বন্ধ করে দেয় চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন।

বিমানটির শক্তির উৎস হলো চীনের তৈরি লিয়াং ওপেন-১৩এফ (Liyang Wopen-13F) আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন

অর্থাৎ এফটি-৭ বিজিআই (FT-7BGI) মডেলটি বিশেষভাবে মূলত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়। এটি এই সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক এবং সর্বশেষ সংস্করণ। বিজিআই-এর পূর্ণরূপ হলো বাংলাদেশ গ্লাস ককপিট ইমপ্রুভড (Bangladesh Glass-cockpit Improved)। এ থেকে বোঝা যায়, এটি বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী বানানো, অর্থাৎ কাস্টম মেড।

২০২৩ সালে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের জে-৭ বিমানগুলোকে অবসরে পাঠিয়েছে।

আরও পড়ুন
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত
ছবি: মীর হোসেন

বাংলাদেশের এফটি-৭ বিজিআই বিমানের অ্যানাটমি

এফটি-৭ বিজিআই বিমানটি প্রায় ১৪.৮৮ মিটার (৪৮ ফুট ১০ ইঞ্চি) দীর্ঘ। এর উচ্চতা ৪.১ মিটার (১৩ ফুট ৫ ইঞ্চি)। আর পাখার বিস্তার (Wingspan) প্রায় ৮.৩২ মিটার (২৭ ফুট ৪ ইঞ্চি)।

বিমানটির মূল কাঠামো ডেল্টা উইং বা ত্রিকোণাকার পাখার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই বিশেষ নকশার কারণে এটি উচ্চগতিতে, বিশেষ করে শব্দের চেয়ে দ্রুত বা সুপারসনিক গতিতে ওড়ার সময় বায়ুর বাধা কমিয়ে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারে। এই কারণেই এফটি-৭ বিজিআই ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২,৭০০ কিলোমিটার বা ম্যাক ২.২ গতিতে উড়তে পারে, যা শব্দের গতির দ্বিগুণেরও বেশি। খালি অবস্থায় এর ওজন প্রায় ৫,২৯২ কেজি, তবে অস্ত্র ও জ্বালানিসহ এটি সর্বোচ্চ ৯,১০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়তে পারে।

এই সিরিজের বিমানগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে বা ক্র্যাশ করেছে। বিশেষ করে পাকিস্তান, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া ও ইরানে জে-৭ বা এফ-৭ সিরিজের বহু বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাস আছে।

বিমানটির শক্তির উৎস হলো চীনের তৈরি লিয়াং ওপেন-১৩এফ (Liyang Wopen-13F) আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন। সাধারণ অবস্থায় এই ইঞ্জিন ৪৪.১ কিলোনিউটন থ্রাস্ট (ধাক্কা) তৈরি করে। কিন্তু প্রয়োজনে আফটারবার্নার চালু করলে এর শক্তি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৫ কিলোনিউটন। এই প্রচণ্ড শক্তির জোরেই বিমানটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮০-২০০ মিটার বেগে সোজা ওপরের দিকে উঠে যেতে পারে। এই বিমান সর্বোচ্চ প্রায় ১৮,২০০ মিটার বা ৬০,০০০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।

বিমানের ‘উন্নতি’র একটা বড় অংশ দেখা যায় এর ‘গ্লাস ককপিট’-এ। আগের সংস্করণগুলো যেখানে পুরাতন অ্যানালগ মিটার ছিল, সেখানে এফটি-৭ বিজিআইর ককপিটটি পুরোপুরি ডিজিটাল। এখানে রয়েছে তিনটি রঙিন মাল্টি-ফাংশনাল ডিসপ্লে বা এমএফডি, যেখানে পাইলট বিমানের গতি, উচ্চতা, জ্বালানির পরিমাণ, ইঞ্জিনের অবস্থা এবং রাডারের তথ্যসহ সব একসঙ্গে দেখতে পান। এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আগের সংস্করণগুলোর তুলনায় আধুনিক। হ্যান্ডস-অন থ্রটল-অ্যান্ড-স্টিক (HOTAS) প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পাইলটকে বিমানের মূল নিয়ন্ত্রণ স্টিক থেকে হাত সরাতে হয় না; স্টিকের ওপরে থাকা বিভিন্ন সুইচ ব্যবহার করেই অস্ত্র নিক্ষেপ, রাডার নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য জরুরি কাজ করা যাত।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে একজন পাইলট নিহত হন। ছবিতে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে
ছবি: ডেইলি স্টার

এফটি-৭ বিজিআই-এর ‘চোখ’ বলা যায় কেএলজে-৬এফ (KLJ-6F) পালস ডপলার রাডারকে। এই রাডার ব্যবস্থা প্রায় ৮০-৮৬ কিলোমিটার দূর থেকে লক্ষ্যবস্তু বা কোনো বস্তু শনাক্ত করতে পারে। একসঙ্গে একাধিক লক্ষ্যবস্তুকে ট্র্যাক করতে পারে এটি। দুর্ঘটনা, যেমন বিমানে আগুন লাগলে বা কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে পাইলট যেন নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন, সে জন্য এতে রয়েছে মার্টিন-বেকার এমকে-১০এল ইজেকশন সিট। এখানে শেষের ‘এল’ দিয়ে বোঝানো হয়, ইজেকশন সিটটি তুলনামূলক হালকা, ইজেকশনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক। একটি হ্যান্ডেল টানার সঙ্গে সঙ্গে পাইলটের আসনটি বিমান থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্যারাশুট খুলে দেয়।

কেন এত দুর্ঘটনা

এই সিরিজের বিমানগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে বা ক্র্যাশ করেছে। বিশেষ করে পাকিস্তান, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া ও ইরানে জে-৭ বা এফ-৭ সিরিজের বহু বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাস আছে। রয়টার্স-এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ইরানের চেংদু এফ-৭ বিমানটি ইস্পাহানের আনারাক প্রদেশে বিদ্ধস্ত হয়েছে ২০২২ সালের ৩ জুন। এ ঘটনায় দুই পাইলট নিহত হয়েছেন। ওদিকে চীনের হিউবেই প্রদেশে চেংদু জে-৭ বিমান বিদ্ধস্তের একটি ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ৯ জুন। এতে পাইলট সিট ইজেক্ট করে বেঁচে যান। এরকম আরও বহু ঘটনার ইতিহাস খুঁজলেই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশেই ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে এই সিরিজের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে তিনবার। আর সর্বশেষে এই ঘটনা ঘটল গত ২১ জুলাই।

এই জ্বালানির অণুগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যে অল্প পরিমাণ ফুয়েলেই বিপুল শক্তি তৈরি হয়। যেমন এক লিটার জেট ফুয়েল পোড়ালে তৈরি হয় প্রায় ৩৫ মেগাজুল শক্তি। গাড়ির জ্বালানিতে উৎপন্ন হয় ৯-১৬ মেগাজুল শক্তি।

প্রশ্ন হলো, কেন এই বিমানে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে? এর কারণ, এফটি-৭ বিজিআই সংস্করণটিতে গ্লাস ককপিট, উন্নত রাডার এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকলেও এর মূল ভিত্তি বা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা কাঠিয়ে ওঠা যায়নি। এই বিমানের মূল নকশা ১৯৬০-এর দশকের। এটি সোভিয়েত যুগের মিগ-২১ এর ভিত্তিতে নির্মিত, এ কথা আগেই বলেছি। মূল নকশাটি পুরনো হওয়ায় বিমানটি চালানো তুলনামূলকভাবে চ্যালেঞ্জিং এবং এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কিছুটা বেশি।

আরও পড়ুন

এর অন্যতম কারণ বিমানটির অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন। ডেল্টা উইং নামের এর যে ত্রিকোণাকার পাখা আছে, সেগুলো দ্রুতগতিতে বেশ কাজের হলেও স্বল্প গতিতে—বিশেষ করে অবতরণের সময়—ঝামেলায় পড়ে যায়। এ সময় বিমানটির পাখার ওপরের বায়ুপ্রবাহ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, এমনকি ‘ফ্লো সেপারেশন’ও ঘটতে পারে। এই ‘ফ্লো সেপারেশন’ কথাটার অর্থ, ডানা বাতাস থেকে খানিকক্ষণের জন্য বিচ্ছিন্ন পর্যন্ত হয়ে পড়তে পারে। এতে পাইলট বিমানকে দ্রুত ওপরে ওঠানো বা নিচে নামানোর চেষ্টা করলে বিমান সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয় না, একটু গড়িমসি করে। বোঝানোর জন্য সহজ করে লেখা হচ্ছে কথাটা, ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘পিচিং স্ট্যাবিলিটি’ কমে যাওয়া। অর্থাৎ এ সময় বিমান নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে পাইলটকে অনেক বেশি মনোযোগ ও দক্ষতার সঙ্গে, ধীরে ধীরে বিমানটা নামিয়ে আনতে হয়। ওদিকে ডেল্টা উইংইয়ের আসপেক্ট রেশিও—মানে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত কম হওয়ায় হঠাৎ গতি কমে গেলে, বিমান নিচে পড়তে শুরু করলে বা ‘স্টল’ পরিস্থিতি তৈরি হলে ওটার ফের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কঠিন। স্টল পরিস্থিতি মানে, বিমানের পাখা সাড়া দিচ্ছে না বা বাতাসকে নিচের দিকে ধাক্কা দিয়ে যথেষ্ট দ্রুত বিমানকে ওপরে তুলতে পারছে না, এমন অবস্থা। এই হলো বিমান পুরোপুরি ঠিক থাকাকালীন পরিস্থিতি।

প্রথম আলোর খবরে আইএসপিআর-এর বরাতে ২১ জুলাই বিধ্বস্ত বিমানটির সমস্যাকে ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই যান্ত্রিক ত্রুটি ঠিক কী, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

বিধ্বস্ত এফটি-৭ বিজিআই: জ্বালানি হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর

যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সাধারণ গাড়ির পেট্রোল, ডিজেল বা অকটেনের মতো হয় না। এগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী, দাহ্য এবং কার্যক্ষম। এফটি-৭ বিজিআই বিমানেও একইরকম শক্তিশালী জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে একে বলে অ্যাভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল, সংক্ষেপে বলা হয় জেট ফুয়েল। এটি মূলত কেরোসিনজাত এক ধরনের পরিশোধিত তেল। এর রাসায়নিক গঠন এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়া বিশেষভাবে যুদ্ধবিমানের উপযোগী।

কথা হলো, কেরোসিন কী? এক ধরনের উচ্চমানের হাইড্রোকার্বন মিশ্রণ। হাইড্রোকার্বন মানে, কার্বন আর হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত অণু, একধরনের জৈবযৌগ। কেরোসিনজাত এই জেট ফুয়েলে ৮ থেকে ১৬টি কার্বন একসঙ্গে যুক্ত থাকে (C8-C16)—এমন অণু থাকে।

আরও পড়ুন

এই জ্বালানির অণুগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যে অল্প পরিমাণ ফুয়েলেই বিপুল শক্তি তৈরি হয়। যেমন এক লিটার জেট ফুয়েল পোড়ালে তৈরি হয় প্রায় ৩৫ মেগাজুল শক্তি। গাড়ির জ্বালানিতে উৎপন্ন হয় ৯-১৬ মেগাজুল শক্তি। বুঝতেই পারছেন, গাড়ির জ্বালানির চেয়ে এটা কত বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই জ্বালানির ফ্ল্যাশ পয়েন্ট (অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় এটি বাষ্প হয়ে আগুন ধরতে পারে) মাত্র ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। আর মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ দেহ-তাপমাত্রার কাছাকাছিই এটি জ্বলে উঠতে পারে। ফলে এই জ্বালানি অত্যন্ত দাহ্য এবং যেকোনো দুর্ঘটনায় মুহূর্তে ভয়াবহ আগুন তৈরি হতে পারে।

বিমান যদি বিধ্বস্ত হয় বা জ্বালানি ট্যাংকে সামান্য ফাটলও দেখা দেয়, তখন জ্বালানি বেরিয়ে আসে। আর এই জ্বালানি বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায়। আমরা জানি, অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়াই আসলে দহন।

জ্বালানি দহন বা ইঞ্জিনের পুরো মেকানিজমটা এখানে বিস্তারিত লিখছি না। অতিসরলীকরণ করে বললে, বিমানের টার্বোজেট ইঞ্জিনে বাতাসকে প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত করে তাপ ও চাপ বাড়ানো হয়। এরপর সেই গরম বাতাসে স্প্রে করা হয় এই জ্বালানি। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে তীব্র দহন শুরু হয়—বলা যায়, বিস্ফোরণের মতো অবস্থা। এই প্রক্রিয়ায় গ্যাসীয় পদার্থগুলো প্রবল বেগে ইঞ্জিনের পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর এই প্রতিক্রিয়াই বিমানকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়, নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে। এই সূত্র বলে, প্রতিটি কাজেরই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এইভাবেই মাত্র কয়েক লিটার জ্বালানিতে সুপারসনিক বেগে উড়তে পারে।

যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সাধারণ গাড়ির পেট্রোল, ডিজেল বা অকটেনের মতো হয় না

এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভালো, কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠে, দুর্ঘটনায় এটি হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক। বিমান যদি বিধ্বস্ত হয় বা জ্বালানি ট্যাংকে সামান্য ফাটলও দেখা দেয়, তখন জ্বালানি বেরিয়ে আসে। আর এই জ্বালানি বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায়। আমরা জানি, অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়াই আসলে দহন। অর্থাৎ জ্বালানি এই সময় পুড়তে শুরু করে। আর এই আগুনের তাপমাত্রা ৯৮০ থেকে ১১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই তাপমাত্রায় ধাতব কাঠামো পর্যন্ত গলে যেতে পারে, আর মানুষের শরীরের কী অবস্থা হবে, তা আলাদা করে বলার তো প্রয়োজন নেই। এ কারণেই বিমান দুর্ঘটনার সময় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুহূর্তেই বিস্ফোরণ ঘটে। মানুষ, বিভিন্ন অবকাঠামো—সবকিছু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। এই নির্মমতার বাস্তব রূপ পাঠক ইতিমধ্যেই দেখেছেন। কোনো ভাষায় এটি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সূত্র: প্রথম আলো, রয়টার্স, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, আইক্যাস ডট অর্গ, এয়ারফোর্স টেকনোলজি ডটকম, দ্য ইকোনোমিক টাইমস, দ্য ডেইলি স্টার, মার্টিন বেকার, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন