ভবিষ্যৎ বদলে দেবে যে দশ প্রযুক্তি

মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

প্রযুক্তির দুনিয়ায় প্রতি বছরই নতুন অগ্রগতি আসে। তবে কিছু প্রযুক্তি থাকে একেবারেই আলাদা। সেগুলো শুধু গবেষণার বিষয় নয়, বরং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সাম্প্রতি সেরকম ১০ প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে। এগুলো আমাদের স্বাস্থ্য, শক্তি, পরিবেশ ও সমাজের অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।

 

১. স্ট্রাকচারাল ব্যাটারি কম্পোজিটস

প্রথমেই রয়েছে স্ট্রাকচারাল ব্যাটারি কম্পোজিটস। এটি এমন এক উপাদান যা একসঙ্গে দুটি কাজ করে। কোনো কিছুর কাঠামো তৈরি করে আবার বিদ্যুৎও সংরক্ষণ করে। ভাবুন তো, কোনো গাড়ি বা বিমানের মূল পুরো দেহটাই যদি ব্যাটারি হয়ে যায়! তাহলে যানবাহন অনেক হালকা হবে। শক্তি সাশ্রয় হবে এবং কার্বন নিঃসরণও কমবে। ইলেকট্রিক গাড়ি বা ড্রোনের জগতে এ প্রযুক্তি বিপ্লব আনতে পারে। তবে এর নিরাপত্তা ও উৎপাদন প্রযুক্তি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। 

আরও পড়ুন

২. অসমোটিক পাওয়ার সিস্টেমস

এটি বিদ্যুৎ তৈরির একটি নতুন পদ্ধতি। দুটি ভিন্ন ধরনের পানির লবণাক্ততার পার্থক্য থেকে এই বিদ্যুৎ তৈরি হয়। যেমন, সমুদ্রের নোনা পানি ও নদীর মিষ্টি পানি যেখানে মেশে, সেখানে একটি চাপ তৈরি হয়। সেই চাপকে কাজে লাগিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এই ধারণাটি প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তবে এখন ন্যানো-মেমব্রেন প্রযুক্তির কারণে এটি বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে। এই শক্তি হবে পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য।

অসমোটিক পাওয়ার সিস্টেমস
এসিএস

৩. উন্নত পারমাণবিক শক্তি

এটি পারমাণবিক শক্তির নতুন রূপ। এখন ছোট আকারের মডিউলার রিঅ্যাক্টর (SMR) তৈরি হচ্ছে। এছাড়া নিউক্লিয়ার ফিউশন নিয়েও দ্রুত এগোচ্ছে গবেষণা। ফিউশন প্রযুক্তি সফল হলে এটি বিশ্বের জ্বালানি সংকটের যুগান্তকারী সমাধান দেবে।

আরও পড়ুন

৪. প্রকৌশলিত জীবন্ত থেরাপি

চতুর্থ প্রযুক্তি হলো প্রকৌশলিত জীবন্ত থেরাপি। এই পদ্ধতিতে শরীরের ভেতরের কোষ বা ব্যাকটেরিয়াকে ‘ক্ষুদে ফ্যাক্টরি’ বানানো হয়। এই ফ্যাক্টরি শরীরের ভেতরেই প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি করে। ফলে চিকিৎসা অনেক সাশ্রয়ী হয়। বারবার ইনজেকশন নেওয়ার ঝামেলাও কমে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে ওষুধ উৎপাদনের খরচ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

৫. জিএলপি-১ ওষুধের নতুন ব্যবহার

ওষুধগুলো মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও স্থূলতা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এগুলো অন্য রোগেও কাজ করছে। আলঝেইমার বা পারকিনসনসের মতো স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় এটি কার্যকর হতে পারে। এই ওষুধ মস্তিষ্কের প্রদাহ কমায়। বিশ্বে ৫৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ ডিমেনশিয়ায় ভুগছে। এই ওষুধ তাদের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে উঠতে পারে।

ডায়াবেটিস ও স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয় জিএলপি-১ ওষুধ
গেটি ইমেজ

৬. স্বয়ংক্রিয় বায়োকেমিক্যাল সেন্সিং

এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যা নিজ থেকেই রাসায়নিক পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারে। যেমন, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা পানিতে দূষণের পরিমাণ নির্ণয় করা। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরিধানযোগ্য গ্লুকোজ মনিটর এরই মধ্যে বেশ সফল। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি আরও বড় পরিসরে ব্যবহৃত হবে।

আরও পড়ুন

৭. গ্রিন নাইট্রোজেন ফিক্সেশন

সার উৎপাদনের জন্য যে অ্যামোনিয়া তৈরি করা হয়, তা প্রায় ৫০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদনে সাহায্য করে। কিন্তু এর একটি বড় সমস্যাও আছে। এটি বৈশ্বিক শক্তির প্রায় ২ শতাংশ খরচ করে। পাশাপাশি প্রচুর কার্বন নির্গমন ঘটায়। নতুন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে এখন নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি সম্ভব হবে। এটি কৃষিকে আরও টেকসই করে তুলবে।

ন্যানোজাইম প্রাকৃতিক এনজাইমের মতোই কাজ করে
ক্রিয়েটিভ-এনজাইম

৮. ন্যানোজাইম

এগুলো পরীক্ষাগারে তৈরি ন্যানো-উপাদান। কাজ করে প্রাকৃতিক এনজাইমের মতোই। তবে প্রাকৃতিক এনজাইম উৎপাদন বেশ ব্যয়বহুল ও জটিল। ন্যানোজাইম তুলনামূলকভাবে সস্তা ও স্থিতিশীল। ক্যানসার চিকিৎসা থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা যাবে।

 

৯. কলাবরেটিভ সেন্সিং

সেন্সর এখন প্রায় সব জায়গায় ব্যবহৃত হয়। ভবিষ্যতে এই সেন্সরগুলো একে অপরের সঙ্গে নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবে। এগুলো একসঙ্গে মিলে সমষ্টিগতভাবে কাজ করবে। যেমন, শহরের ট্রাফিক ক্যামেরা ও পরিবেশ সেন্সর একসঙ্গে যানজট ও দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।

 

১০. জেনারেটিভ ওয়াটারমার্কিং

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি বা লেখা শনাক্ত করা এখন বেশ কঠিন। এই প্রযুক্তি ডিজিটাল কনটেন্টে একটি অদৃশ্য চিহ্ন যুক্ত করে দেয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, কোনটি আসল এবং কোনটি এআই দিয়ে তৈরি। ডিপফেক ও ভুয়া খবরের যুগে বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরাতে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এই দশটি প্রযুক্তি আগামী কয়েক বছরেই বাস্তবে রূপ নিতে পারে। এগুলো চিকিৎসা ও শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। একই সঙ্গে কিছু সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নও তুলবে। তাই শুধু প্রযুক্তি আবিষ্কার করলেই হবে না। এর নিরাপদ ব্যবহার ও নীতিমালা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।

লেখক: নেটওয়ার্ক কানেক্টর, টিচ ফর অল

সূত্র: টপ ১০ ইমার্জিং টেকনোলজিস অব ২০২৫, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম