মোবাইল নম্বরের শুরুতে +৮৮০ বসাতে হয় কেন

আমরা যখন কাউকে কল করি, তখন ০১৭/০১৮/০১৯… এভাবে নম্বর লিখি। মজার ব্যাপার হলো, সামনের এই শূন্যটা (০) না দিলেও কল যায়। (বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যাহোক, এই শূন্য রহস্য নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।) আপনারা যদি কেউ বাল্ক এসএমএস (একসঙ্গে বহু মানুষকে মেসেজ পাঠানো) পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে জানেন, আমরা এক্সেল ফাইলে নাম্বারটা লিখি। সামনের শূন্যটা (০) সেখানে না দিলেও চলে। এসএমএস চলে যায়।

অর্থাৎ ১৭/১৮/১৯…—এরকম ১০ সংখ্যার মোবাইল নম্বরটাই আমাদের আসল নম্বর। কথাটা ভিন্নভাবে বললে বলতে হবে, আমরা যখন কাউকে ফোন করি, তখন ১০ সংখ্যার মোবাইল নম্বরটিই যথেষ্ট। সামনের ০-টা বিশেষ কোড। আন্তর্জাতিক কলের ক্ষেত্রে এই কোড আরেকটু বড়।

এই কোড কী কাজে লাগে? বিদেশ থেকে আপনার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু যদি আপনাকে মোবাইলে কল দেয়, তখন সামনে +৮৮০ বসাতে হয়। না বসালে কল আসবে না ঠিকভাবে।

এবারে আসল প্রশ্ন, কেন? কেন দেশের বাইরে থেকে কল করতে গেলে আমাদের নম্বরের আগে জুড়ে দিতে হয় +৮৮০-এর মতো একটি কোড? এই কোড কতটা জরুরি? চলুন, বিষয়টার ভেতরের কাহিনি জেনে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন

সংখ্যায় লেখা ঠিকানা

পুরো ব্যাপারটা বোঝার জন্য মোবাইল নম্বরকে আমাদের বাসার ঠিকানার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ধরুন, আপনি বিদেশে থাকা কোনো বন্ধুকে চিঠি পাঠাবেন। খামের ওপরে কী লিখবেন? নিশ্চয়ই শুধু বাসার নম্বর আর রাস্তার নাম লিখবেন না। কারণ, শুধু ওটুকু লিখলে চিঠিটা সেই বাসা বা রাস্তায় পৌঁছাবে না। আপনাকে লিখতে হবে এলাকার নাম, শহরের নাম, পোস্টকোড এবং সবচেয়ে জরুরি—দেশের নাম।

মোবাইল নম্বরও ঠিক একইভাবে কাজ করে। এটি আপনার মোবাইলের জন্য বরাদ্দ করা ডিজিটাল ঠিকানা। এই ঠিকানার শেষের ৮টি সংখ্যা আপনার বাসার নম্বরের মতো। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় ‘সাবস্ক্রাইবার নম্বর’। এই সংখ্যাটা ইউনিক বা অনন্য, নির্দিষ্ট করে শুধু আপনাকে শনাক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর আগের ২টি সংখ্যাকে বলা হয় অপারেটর কোড। যেমন ১৭, ১৮ বা ১৯। আমরা জানি, ১৭ দিয়ে বাংলাদেশে গ্রামীণফোনকে চিহ্নিত করা হয়, ১৮ দিলে বোঝায় রবি, ১৯ দিলে বোঝায় বাংলালিংক। হয়তো খেয়াল করেছেন, গ্রামীণফোন এখন নতুন করে ১৪ অপারেটর কোডটি ব্যবহার করছে, বাংলালিংক ব্যবহার করছে ১৩। ফলে মোবাইল নম্বর শুরু হচ্ছে (সামনের ০ বাদ দিয়ে) ১৩……..—এভাবে।

সামনের শূন্যটা আসলে বাংলাদেশের কান্ট্রি কোড +৮৮০-এর অংশ। একইভাবে ভারতের কান্ট্রি কোড +৯১, যুক্তরাষ্ট্রের +১। ঠিক ধরেছেন, কান্ট্রি কোড দিয়ে বোঝায় দেশের নাম। +৮৮০ দিয়ে বোঝায় বাংলাদেশ।

কেউ যখন বিদেশ থেকে কোনো নম্বরে কল করেন, তখন এই পুরো ঠিকানাটি দরকার হয়। নাহলে বিশ্বজুড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ফোনের ভিড়ে ওই কলটি পথ হারিয়ে ফেলবে। বুঝতেই পারবে না, কোন দেশে যেতে হবে।

আরও পড়ুন

কান্ট্রি কোড কোত্থেকে আসে

হয়তো প্রশ্নটা ইতিমধ্যেই মনে মনে ভেবে ফেলেছেন আপনি। কে ঠিক করল যে বাংলাদেশের কোড হবে ৮৮০, ভারতের ৯১, আর যুক্তরাষ্ট্রের ১? এই কাজটি করে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন বা আইটিইউ (ITU)। এটি জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা। মজা করে বলতে পারেন, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অভিভাবক (কর্তৃপক্ষ)।

সারা বিশ্বে যাতে ফোনকল ব্যবস্থা নির্বিঘ্নে এবং সুশৃঙ্খলভাবে চলে, তা নিশ্চিত করাই আইটিইউর কাজ। এই সংস্থার আইটিইউ-টি (ITU-T) বিভাগটি টেলিকমিউনিকেশন স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সেক্টর নামেও পরিচিত। এই বিভাগ ই.১৬৪ (E.164) নামে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালা মেনেই গঠিত হয় সারা বিশ্বের সব মোবাইল নম্বর। এই নীতিমালার অংশ হিসেবেই প্রতিটি দেশকে এক বা একাধিক স্বতন্ত্র ‘কান্ট্রি কোড’ দেওয়া হয়।

 

+৮৮০-এর অ্যানাটমি

এবার আমাদের কান্ট্রি কোড +৮৮০-এর প্রতিটি অংশের অর্থ খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমেই আছে একটা যোগ চিহ্ন। এই ছোট্ট চিহ্নটির কাজ অনেক বড়। এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল আক্সেস কোড’। আপনি যখন কোনো নম্বরের আগে এই + চিহ্ন ব্যবহার করেন, তখন মূলত ফোনের নেটওয়ার্ককে বোঝাতে চান, এই কল দেশের বাইরে যাবে। এটি একটি সর্বজনীন প্রতীক।

এরপর আসে ৮৮০ বা কান্ট্রি কোড। এই কোডের পেছনের ঘটনা হলো, আইটিইউ ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী গোটা বিশ্বকে ৯টি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করেছে। এর মধ্যে ৮ নম্বর জোনটি পূর্ব এশিয়ার জন্য সংরক্ষিত। এই জোনের মধ্যে ‘৮০’ সংখ্যাটি বিশেষভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে বাংলাদেশকে বোঝাতে। অর্থাৎ ৮৮০ বোঝায়, পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ। (এখানে বলে রাখি, এমনিতে ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অংশ। তবে মোবাইল নম্বরের বিভাগ অনুসারে, উত্তর আমেরিকার জন্য ১, আফ্রিকার জন্য ২, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের জন্য ৩, উত্তর ইউরোপের জন্য ৪, লাতিন আমেরিকার জন্য ৫, ওশেনিয়ার জন্য ৬, রাশিয়া ও কাজাখস্তানের জন্য ৭—ইউএসএসআরের বাকি অংশটা ৩ ও ৯-এর আওতায় পড়বে, পূর্ব এশিয়া ৮ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার জন্য বরাদ্দ ৯। এর মধ্যে বাংলাদেশ পড়েছে ৮-এর ভাগে।)

আরও পড়ুন

যেভাবে বিশ্বজুড়ে মোবাইল কল করা হয়

ধরুন, আপনি বিদেশে বসে আছেন। +৮৮০ দিয়ে শুরু একটি নম্বরে ডায়াল করলেন। এবারে কী ঘটবে?

প্রথমেই আপনি যে দেশে আছেন, সেই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক + চিহ্ন দেখে বুঝে ফেলে, কলটি একটি আন্তর্জাতিক কল। এরপর সেটি এই কলকে পাঠিয়ে দেবে সে দেশের ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েতে (IGW)। এই গেটওয়ে হলো আন্তর্জাতিক ফোনকল আদান-প্রদানের দরজা।

গেটওয়ে প্রথমেই পড়বে কান্ট্রি কোড। ৮৮০ পড়ে বুঝতে পারবে, এই কলের গন্তব্য বাংলাদেশ। তখন এটি সাবমেরিন কেবল বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোনো একটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে।

বাংলাদেশের গেটওয়ে কলটি গ্রহণ করার পর নম্বরের পরের দুটি সংখ্যা দেখবে। যেমন ১৭। এই কোডটি দিয়ে সে বুঝবে, এটি গ্রামীণফোনের নম্বর। তখন কলটিকে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এবারে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক নম্বরের শেষ অংশ বা সাবস্ক্রাইবার নম্বরটি খুঁজে বের করে আপনার ফোনটিকে সংযুক্ত করে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠবে আপনার মোবাইল।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একটা কল করার আগে আপনি মোটেও এত কিছু ভাবেন না। আপনার যেন ভাবতে না হয়, নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করাই প্রযুক্তিবিদদের কাজ।

 

এবারে শূন্য রহস্য: নম্বরের প্রথম ০ আন্তর্জাতিক কলের সময় কোথায় হারিয়ে যায়?

এটা খুব সাধারণ প্রশ্ন। আমরা যখন দেশের ভেতরে ০১৭… নম্বরে কল করি, তখন তো শুরুতে ০ ব্যবহার করি। কিন্তু আন্তর্জাতিক কলের সময় +৮৮০ লেখার পর শূন্য (০) বাদ দিয়ে ১৭… এভাবে লিখি। কেন?

কারণ, নম্বরের সামনের এই শূন্যকে বলা হয় ‘ট্রাঙ্ক প্রিফিকস’। এর কাজ হলো, দেশের ভেতরের এক শহর থেকে অন্য শহরে বা এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে কল করতে সাহায্য করা। এটি লোকাল নেটওয়ার্ককে জানায়, এই কলটি জাতীয় পর্যায়ের।

কিন্তু আপনি যখন +৮৮০ ব্যবহার করেন, তখন সামনের + চিহ্নটিই সেই নির্দেশনা দিয়ে দেয়। ফলে জাতীয় পর্যায়ের কল বোঝাতে শূন্যটার (০) আর দরকার পড়ে না। এই হলো শূন্য রহস্য, আন্তর্জাতিক পরিসরে যে কারণে শূন্যটা হারিয়ে যায়।

এই লেখা পড়ে থাকলে এবারে আপনি ভাবতে পারেন, এতদিনে আপনি নিজের মোবাইল নম্বরের ব্যাখ্যাটুকু জানেন। মজার না ব্যাপারটা?