বিশ্বের প্রথম পেরোভস্কাইট ক্যামেরা উদ্ভাবন, দেখা যাবে মানবদেহের ভেতরটা

শিল্পীর কল্পনায় পেরোভস্কাইট ক্যামেরা। নতুন এই ক্যামেরার সাহায্যে মানবদেহের ভেতরটা দেখা যাবেশাটারস্টক

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন একটি ক্যামেরা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা আপনার হৃদয়ের স্পন্দন দেখতে পারবে, রক্ত প্রবাহের গতিপথ অনুসরণ করবে, এমনকি খুঁজে বের করবে শরীরের গভীরে লুকিয়ে থাকা রোগের চিহ্নও। শুনতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মতো মনে হলেও এটাই এখন বাস্তব। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এবং চীনের সুজো ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এমনই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে SPECT স্ক্যানের নাম শুনেছেন? সিঙ্গেল-ফোটন এমিশন কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি। এটা এক ধরনের নিউক্লিয়ার ইমেজিং প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে ডাক্তাররা রোগীর শরীরে খুব সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রবেশ করান। এই পদার্থ গামা রশ্মি নির্গত করে। ফলে শরীরের টিস্যু ভেদ করে, তা বাইরের ডিটেক্টরে ধরা পড়ে। প্রতিটি গামা রশ্মি কাজ করে একটি আলোকবিন্দুর মতো। এমন লাখো বিন্দু একসঙ্গে মিলে তৈরি করে অঙ্গের ত্রিমাত্রিক ছবি।

কিন্তু এখানেই বাধে একটি সমস্যা। বর্তমানে ব্যবহৃত ডিটেক্টরগুলো হয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল, নয়তো ছবির মান খুবই নিম্নমানের। সিজেডটি বা ক্যাডমিয়াম জিঙ্ক টেলুরাইড (CZT) ডিটেক্টর দারুণ কাজ করলেও এর দাম কয়েক লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত। আর এর ক্রিস্টাল এত ভঙ্গুর যে তৈরি করাই কঠিন। অন্যদিকে সোডিয়াম আয়োডাইড ডিটেক্টর সস্তা হলেও এর ছবির মান ভালো না। কুয়াশায় ঢাকা জানালা দিয়ে দেখলে ভেতরটা যেমন ঝাপসা দেখায়, এই ডিটেক্টরের ছবিও তেমন ঝাপসা।

এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলো পেরোভস্কাইট ক্রিস্টাল। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মেরকুরি কানাৎজিডিস গত দশ বছর ধরে এই বিশেষ ক্রিস্টালের ওপর কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘পেরোভস্কাইট ক্রিস্টাল সৌরশক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে। এবার এই একই পদার্থ নিউক্লিয়ার মেডিসিনেও পরিবর্তন আনতে প্রস্তুত।’

আরও পড়ুন
গবেষকরা নতুন ধরনের পিক্সেলেটেড সেন্সর তৈরি করেছেন। স্মার্টফোনের ক্যামেরায় যেমন অসংখ্য পিক্সেল থাকে, তেমনই এই ডিটেক্টরেও রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট সংবেদনশীল অংশ।

২০১২ সালে কানাৎজিডিসের দল প্রথম পেরোভস্কাইট ব্যবহার করে সলিড ফিল্ম সোলার সেল তৈরি করেন। পরের বছরই তাঁরা প্রমাণ করেন যে পেরোভস্কাইট একক ক্রিস্টাল এক্সরে এবং গামা রশ্মি শনাক্ত করতে পারে। এই আবিষ্কার আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।

গবেষকরা নতুন ধরনের পিক্সেলেটেড সেন্সর তৈরি করেছেন। স্মার্টফোনের ক্যামেরায় যেমন অসংখ্য পিক্সেল থাকে, তেমনই এই ডিটেক্টরেও রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট সংবেদনশীল অংশ। প্রতিটি অংশ গামা রশ্মির সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে পারে প্রায় নির্ভুলভাবে।

চীনের সুজো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইহুই হে এই গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই পদ্ধতি কেবল ডিটেক্টরের কর্মক্ষমতা বাড়ায় না, খরচও কমায়। মানে এখন থেকে আরও বেশি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সর্বোচ্চ মানের ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে।’

এই বড় স্ফটিকের টুকরো থেকে নির্দিষ্ট মাপে কেটে ও ঘষে মসৃণ করে ডিটেক্টর বানানো হয়
মেরকুরি কানাৎজিডিস/নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই নতুন ডিটেক্টর বিভিন্ন শক্তির গামা রশ্মির মধ্যে পার্থক্য করতে পারে প্রায় নির্ভুলভাবে। টেকনেশিয়াম-৯৯এম নামে চিকিৎসায় ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থের অত্যন্ত দুর্বল সংকেতও এটি ধরতে পারে। মাত্র কয়েক মিলিমিটার দূরত্বে থাকা দুটি তেজস্ক্রিয় উৎসকেও আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ডিটেক্টরের স্থিতিশীলতা। প্রায় সব গামা সংকেতই এটি কোনো বিকৃতি ছাড়া ধরতে পারে। যেহেতু এই ডিটেক্টর অধিক সংবেদনশীল, তাই রোগীদের স্ক্যান করতে সময় কম লাগবে। অথবা সময় বেশি নিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহারও কমানো যেতে পারে। 

আরও পড়ুন
পেরোভস্কাইট ক্রিস্টাল তৈরি করা সহজ এবং এর উপাদানগুলোও সরল। তাই সিজেডটি এবং সোডিয়াম আয়োডাইড ডিটেক্টরের তুলনায় এটি অনেক কম দামে উৎপাদন করা সম্ভব।

এই প্রযুক্তিকে বাস্তব জীবনে ব্যবহারের উপযোগী করতে একটি কোম্পানি কাজ করছে। ফলে অচিরেই হয়তো এই প্রযুক্তি গবেষণাগার থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। 

পেরোভস্কাইট ক্রিস্টাল তৈরি করা সহজ এবং এর উপাদানগুলোও সরল। তাই সিজেডটি এবং সোডিয়াম আয়োডাইড ডিটেক্টরের তুলনায় এটি অনেক কম দামে উৎপাদন করা সম্ভব। তবে মানের দিক থেকে এটি অন্যগুলো থেকে ভালো হবে। এছাড়াও সোডিয়াম আয়োডাইড ডিটেক্টরের চেয়ে কম তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করেও এতে ভালো ছবি পাওয়া যাবে।

পেরোভস্কাইট স্ফটিকের বড় বড় টুকরো গলিত পদার্থ থেকে খুব নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তৈরি করা হয়
মেরকুরি কানাৎজিডিস/নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

এই নতুন প্রযুক্তির ফলে রোগীরা অনেক সুবিধা পাবেন। স্ক্যানের সময় কমে যাবে, ছবির মান হবে আরও স্পষ্ট এবং তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শও কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে।

এই গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এটি শুধু আরেকটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ নয়, বরং চিকিৎসা প্রযুক্তিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা। পেরোভস্কাইটভিত্তিক এই ক্যামেরা রোগ নির্ণয়ের গতি বাড়াবে, তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকি কমাবে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে আরও বেশি মানুষের কাছে উন্নত চিকিৎসা পৌঁছে দেবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি হতে পারে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: সাইটেক ডেইলি

আরও পড়ুন