আবহাওয়ার পূর্বাভাস নাকি কখনো মেলে না। পূর্বাভাসে রৌদ্রজ্জ্বল দিন, মাঝপথে পড়ে গেলেন ঝুম বৃষ্টিতে। এই অভিজ্ঞতা হয়তো আপনারও হয়েছে। এর কারণ কী?
কারণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কাজটা জটিল। এত ফ্যাক্টর এর মধ্যে কাজ করে যে সব মিলিয়ে একটা স্থিতিশীল, নিখুঁত হিসাব করা কঠিন। বাংলাদেশ বা কোরিয়ার মতো সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর জন্য এ কাজ আরও কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো এই কাজ অনেকটা ভালোভাবে করতে পারে—তাদের উন্নত প্রযুক্তির পাশাপাশি ভূতাত্ত্বিক অবস্থানও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই যে উন্নত প্রযুক্তি, এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে জাপানি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী স্যুকুরো মানাবে, জার্মান বিজ্ঞানী ক্লাউস হাসেলমান এবং ইতালীয় বিজ্ঞানী জর্জিও পারিসির গবেষণা। ফিজিক্যাল কমপ্লেক্স সিস্টেম বা জটিল ভৌত ব্যবস্থা নিয়ে বৈপ্লবিক কাজ করার জন্য তাঁরা ২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁদের কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসব্যবস্থা। তবু এই মডেলও অনেক ক্ষেত্রে নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারে না।
পরীক্ষা করার জন্য এ মডেল ব্যবহার করে ১০ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস বের করা হয়েছে। মডেলটি সাধারণ আবহাওয়ার পাশাপাশি হারিকেন ঝড়ের গতিপথ আরও নিখুঁতভাবে অনুমান করেছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরও নিখুঁতভাবে পেতে মাইক্রোসফট একটি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল বানিয়েছে। এই মডেল বাতাসের গুণগত মান, আবহাওয়ার প্যাটার্ন বা ধরন, জলবায়ুর জন্য বাড়তি যেসব ঝড় হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় (ট্রপিক্যাল) অঞ্চলে—সেগুলো বর্তমান বৈশ্বিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলের চেয়েও ভালোভাবে শনাক্ত করতে পারে। পাশাপাশি এটি সে অনুযায়ী আরও নিখুঁত পূর্বাভাসও দিতে পারে।
এই মডেলের নাম দেওয়া হয়েছে অরোরা। মডেলটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসেনি। কিন্তু পরীক্ষা করার জন্য এ মডেল ব্যবহার করে ১০ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস বের করা হয়েছে। মডেলটি সাধারণ আবহাওয়ার পাশাপাশি হারিকেন ঝড়ের গতিপথ আরও নিখুঁতভাবে অনুমান করেছে। এই মডেলের খরচও তুলনামূলক কম। বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বিষয়টি উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্যারিস পার্ডিকারিস এই গবেষণাপত্রের জ্যেষ্ঠ গবেষক। তাঁর মতে, ‘প্রথমবারের মতো কোনো এআই ব্যবস্থা গোটা বিশ্বের সব আবহাওয়া পূর্বাভাসকেন্দ্রের চেয়ে ভালো পূর্বাভাস দিল।’
এ জন্য অরোরাকে অতীতের আবহাওয়ার তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এভাবে ২০২৩ সালের সব হারিকেনের পূর্বাভাস এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হারিকেন সেন্টারসহ সব আবহাওয়া পূর্বাভাসকেন্দ্রের চেয়েও ভালোভাবে করেছে।
কিন্তু খরচ কীভাবে কম লাগছে? কারণ, প্রচলিত আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো ভর, ভরবেগ ও শক্তির সংরক্ষণশীলতাসহ পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলো মেনে হিসাব কষে পূর্বাভাস দেয়। এ জন্য প্রচুর কম্পিউটার পাওয়ার লাগে। সদ্য প্রকাশিত গবেষণাটি বলছে, সে তুলনায় অরোরা অনেক কম কম্পিউটেশনাল খরচেই আরও নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারে।
এটাকে আমরা সিরিয়াসলিই নিয়েছি।’ তাঁরা নিজেরাও অবশ্য এআই মডেল বানিয়েছেন। তাঁদের প্রথম মডেলটি বাজারে এসেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবে সেটি একদিকে অরোরার মতো নিখুঁত নয়, অন্যদিকে এটি তুলনামূলক নিম্ন রেজুল্যুশনে আউটপুট দেয়।
নেচার পরিবেশিত এক ভিডিও প্রেজেন্টেশনে পার্ডিকারিস বলেন, ‘বায়ুবিজ্ঞানে বিপ্লবের সূচনা হলো এর মাধ্যমে। আগামী ৫-১০ বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হবে—অতীত তথ্য নয়, স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ এবং বিভিন্ন আবহাওয়াকেন্দ্রের মতো রিমোট সেন্সিং উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক আবহাওয়া পূর্বাভাস দেওয়া।’
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টস (ECMWF) ইউরোপের ৩৫টি দেশে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়। তাদের মডেলের চেয়েও অরোরার নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া দেখে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ফ্লোরেন্স রাবিয়ের বলেন, ‘এটাকে আমরা সিরিয়াসলিই নিয়েছি।’ তাঁরা নিজেরাও অবশ্য এআই মডেল বানিয়েছেন। তাঁদের প্রথম মডেলটি বাজারে এসেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবে সেটি একদিকে অরোরার মতো নিখুঁত নয়, অন্যদিকে এটি তুলনামূলক নিম্ন রেজুল্যুশনে আউটপুট দেয়।
সব মিলে অনেকের ধারণা, এই এআই হয়তো ভবিষ্যতের আবহাওয়া পূর্বাভাসব্যবস্থা সত্যিই বদলে দেবে। কিংবা হয়তো আরও ভালো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসবে, কে জানে?
