কাঁকড়ার বিস্ময়কর জগৎ

পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার প্রজাতির কাঁকড়া আছে।ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

প্রথম দেখায় মনে হতে পারে আস্ত একটা এলিয়েন। অন্য কোনো গ্রহ থেকে প্রাণীটা হয়তো পৃথিবী ভ্রমণে এসেছে। গোটা দশকে পা (আটটি পা আর দুটি চিমটার মতো নখর) নিয়ে কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগর সৈকতে। শিকার ধরছে। কুঁতকুঁতে চোখে তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। বিপদ টের পেলেই চোখের পলকে মুখ লুকাচ্ছে গর্তে। শুধু সাগর বা মহাসাগরেই নয়, নদী, খাল-বিল বা পুকুর—প্রায় সবখানেই ছড়িয়ে আছে এলিয়েনের মতো চেহারার এ প্রাণী। এর নাম কাঁকড়া।

কিন্তু দেখতে যতই বদখত হোক, স্বাদের কারণে এরা অনেক আগেই দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে আমাদের খাবারের প্লেটে। জাতভাই যেমন লবস্টার বা শিম্প্র। আবার জলের তলার অন্য অনেক শিকারি প্রাণীও টিকে থাকে এদের ভোজ বানিয়ে। তবে শুধু খাদ্যশৃঙ্খলের অংশ হিসেবেই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাণিজগতে এরা আর্থোপোডা পর্বের প্রাণী। সেই হিসেবে বলা যায়, এরা আসলে এক ধরনের জলের পোকা। আমরা যাকে চিংড়ি মাছ বলি (আসলে মাছ নয়), সেও আসলে এক ধরনের জলের পোকা। যাই হোক, চিংড়ির মতোই কাঁকড়ার ছোট্ট দেহটাও শক্ত এক ধরনের খোলসে ঢাকা থাকে। একে বলে এক্সোস্কেলিটন বা বহিকংকাল। এটাই এদের দেহকে বাইরের তাপ-চাপ বা অন্য কিছু থেকে সুরক্ষা দেয়। আর এদের দশ পায়ের কথা তো আগেই বলেছি, একে বলে ডেকাপড [গ্রিক শব্দ ডেকা অর্থ ১০]।

বিজ্ঞানীদের হিসেবে, গোটা পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার প্রজাতির কাঁকড়া আছে। এদের বেশিরভাগ কাঁকড়ার বসবাস সাগরে। তাছাড়া কিছু প্রজাতি বাস করে সুপেয় পানিতে। কিছু প্রজাতি স্থলে বা গাছের ডালেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কাঁকড়াদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রজাতির আকার ছোট্ট একটা শিমের বিচির সমান হতে পারে। অন্যদিকে সবচেয়ে বড় কাঁকড়া হতে পারে প্রমাণ সাইজের। যেমন জাপানিক স্পাইডার ক্র্যাব। এদের পায়ের আকারই প্রায় ৪ মিটার বা ১৩ ফুট।

এখানেই শেষ নয়, কাঁকড়া নিয়ে আরও অনেক মজার তথ্য আছে। চলুন, সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন
পৃথিবীতে কাঁকড়ার প্রজাতি রয়েছে ৭ হাজারের বেশি। অনেক সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী মনে করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

৭ হাজারের বেশি প্রজাতির কাঁকড়া আছে

আগেই বলেছি, পৃথিবীতে কাঁকড়ার প্রজাতি রয়েছে ৭ হাজারের বেশি। অনেক সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী মনে করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এরা ‘ডেকাপোডা’ বর্গের অন্তর্গত এক ধরনের ক্রাস্টেসিয়ান প্রাণী। শুধু কাঁকড়াই নয়, গলদা চিংড়ি, সাধারণ চিংড়ি এবং ক্রেফিশও এই দলের সদস্য। কাঁকড়াদের আকার, রং, বাসস্থান ও স্বভাব ভিন্ন হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এদের প্রায় ১০০টি পরিবারে ভাগ করা হয়েছে।

কাঁকড়ার ওজন হতে পারে ১৯ কেজি

কাঁকড়াদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতি হলো ‘জাপানি মাকড়সা কাঁকড়া’। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Macrocheira kaempferi। এদের পায়ের বিস্তার প্রায় ১৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ওজন হতে পারে প্রায় ১৮-১৯ কেজি। অন্যদিকে, সবচেয়ে ছোট প্রজাতির কাঁকড়া হলো ‘মটর কাঁকড়া’। এর দৈর্ঘ্য মাত্র ০.২৭ থেকে ০.৪৭ ইঞ্চি হয়।

নখরের সাহায্যে যোগাযোগ করে

কাঁকড়ারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এদের যোগাযোগের পদ্ধতি বেশ অদ্ভুত। মূলত নিজেদের নখর নাড়িয়ে বার্তা বিনিময় করে এরা। প্রজনন, নিজের এলাকা রক্ষা করা বা শিকারির উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করতে কাঁকড়া এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। কিছু প্রজাতির কাঁকড়া ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে। খোলসের ওপর নখর বা পা দিয়ে আঘাত করে। এর মাধ্যমে শব্দ তৈরি করে শিকারির উপস্থিতি সম্পর্কে অন্যদের সতর্ক করে দেয়। এছাড়াও কাঁকড়ারা রাসায়নিক সংকেত বা ফেরোমোনের মাধ্যমেও নিজেদের অবস্থান বা প্রজননের প্রস্তুতির কথা জানায়।

আরও পড়ুন
কাঁকড়ার একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো, এরা নিজেদের হারানো অঙ্গ পুনরায় তৈরি করতে পারে। শিকারি আক্রমণ করলে বা কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এরা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। একে বলে অটোটমি প্রক্রিয়া।

নখরের সাহায্যে খাবার খায় কাঁকড়া

কাঁকড়া সর্বভুক প্রাণী। এরা পচা প্রাণী থেকে শুরু করে গাছপালা বা শামুক, সবই খায়। এমনকি অন্য কাঁকড়াকেও খেয়ে ফেলে মাঝেমধ্যে। নিজেদের নখর দিয়ে ধরতে পারে এমন প্রায় যেকোনো জীবিত বা মৃত জিনিসই এদের খাবার। কাঁকড়া খাওয়ার সময় তার নখর ব্যবহার করে। এটি নখর দিয়ে খাবার তুলে মুখে দেয়। অনেকটা আমাদের হাত দিয়ে খাওয়ার মতোই।

বিপদে পড়লে অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে দেয়

কাঁকড়ার একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো, এরা নিজেদের হারানো অঙ্গ পুনরায় তৈরি করতে পারে। শিকারি আক্রমণ করলে বা কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এরা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। একে বলে অটোটমি প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে কাঁকড়ারা ইচ্ছাকৃতভাবে সেই অঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্গটি আবার গজায়।

স্থলেও বাস করে এরা

বেশির ভাগ কাঁকড়া সাগর ও মিষ্টি পানিতে বাস করে। যেমন, নীল কাঁকড়া ও চীনা কাঁকড়া। তবে কিছু প্রজাতি স্থলেও বাস করে। এরা পানি থেকে কয়েক মাইল দূরেও থাকতে পারে। যেমন, ক্রিসমাস দ্বীপের লাল কাঁকড়া। ফিডলার কাঁকড়া সাধারণত বালি বা কাদার গভীর গর্তে বাস করে। এরা শীতকালে ও জোয়ারের সময় সেখানে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে, মটর কাঁকড়া ঝিনুক বা মাসেলের খোলসের ভেতরে থাকতে পছন্দ করে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: অরিজিনাল ডাইভিং

আরও পড়ুন