পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছটিকে কেটে ফেলেছিলেন এক বিজ্ঞানী, সেই ভুলের মাশুল আজও গুনছে পৃথিবী

গাছের আসল অবস্থানে যা অবশিষ্ট আছে, তা কেবল একটি অস্পষ্ট গুঁড়িছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আমরা সবাই জীবনে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা নিয়ে পরে আফসোস করতে হয়েছে। হয়তো রাগের মাথায় কাউকে কটু কথা শুনিয়েছেন, কিংবা শখ করে চুলে এমন রং করেছেন যা দেখে নিজেই আয়নায় তাকাতে ভয় পাচ্ছেন! এগুলো ছোটখাটো ভুল। কিন্তু ভাবুন তো, আপনি যদি অজান্তেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বয়স্ক জীবন্ত প্রাণীটিকে মেরে ফেলেন?

ঠিক এমন এক ট্র্যাজেডির নায়ক ছিলেন ডোনাল্ড আর. কারি। ১৯৬৪ সালে কারি একজন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। গবেষণার প্রয়োজনে তিনি একটি গাছ কেটে ফেলেছিলেন। কাটার পর তিনি যা আবিষ্কার করলেন, তা দেখে তার পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি মাত্রই এমন এক গাছকে হত্যা করেছেন, যার বয়স প্রায় ৫ হাজার বছর!

গাছটির নাম ছিল প্রমিথিউস। গ্রিক মিথলজির সেই টাইটানের নামে নাম, যিনি মানুষের জন্য আগুন চুরি করেছিলেন। কিন্তু বাস্তব প্রমিথিউসের কপালে জুটেছিল কুড়ালের আঘাত।

প্রশ্ন হলো, কারি কেন গাছটি কেটেছিলেন? ডোনাল্ড কারি আসলে কোনো ভিলেন ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ভূ-তত্ত্ববিদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদার গ্রেট বেসিন ন্যাশনাল পার্কের হুইলার পিক এলাকায় হিমবাহ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁর গবেষণার জন্য গাছের বয়সের রিং বা বলয় গণনা খুব জরুরি ছিল। কারণ, গাছের রিং দেখেই বোঝা যায় হাজার বছর আগের আবহাওয়া কেমন ছিল।

আরও পড়ুন
১৯৬৪ সালে কারি একজন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। গবেষণার প্রয়োজনে তিনি একটি গাছ কেটে ফেলেছিলেন। কাটার পর তিনি যা আবিষ্কার করলেন, তা দেখে তার পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল।

তিনি বেছে নিয়েছিলেন ব্রিসলকোন পাইন নামে এক প্রজাতির গাছ। এই গাছগুলো দেখতে অদ্ভুত। এগুলো এঁকেবেঁকে বেড়ে ওঠে এবং হাজার হাজার বছর দিব্যি বেঁচে থাকে। কারি জানতেন, এই গাছগুলো অনেক পুরোনো, তাই এগুলোই তাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবে।

কারি প্রথমে চেয়েছিলেন গাছটি না কেটেই তার কাণ্ড থেকে ছোট একটু অংশ বের করে নিতে। এর জন্য বিশেষ একধরনের ড্রিল মেশিন ব্যবহার করা হয়। তিনি স্থানীয় পর্বতারোহীদের কাছে পরিচিত প্রমিথিউস গাছই বেছে নেন।

কিন্তু সমস্যা বাঁধল যন্ত্র নিয়ে। গাছটি এতই শক্ত আর প্যাঁচানো ছিল যে, তার ড্রিল মেশিনটি ভেঙে গেল এবং গাছের ভেতরে গেল আটকে। কারি তখন উপায় না দেখে ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের কাছে অনুমতি চাইলেন গাছটি কেটে ফেলার জন্য। তারাও না বুঝে অনুমতি দিয়ে দিল।

ব্যস! কুড়ালের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল হাজার বছরের ইতিহাস। গাছ কাটার পর কারি যখন ল্যাবে বসে গাছের রিং গুনতে শুরু করলেন, তখন তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তিনি গুনছেন তো গুনছেনই... ৪০০০ বছর... ৪৫০০ বছর... ৪৬০০ বছর...। কারি ভাবলেন, নিশ্চয়ই আমি ভুল করছি! এত পুরোনো গাছ হওয়া সম্ভব নয়। তিনি আবার গুনলেন। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ভালো করে দেখলেন।

আরও পড়ুন
গাছ কাটার পর কারি যখন ল্যাবে বসে গাছের রিং গুনতে শুরু করলেন, তখন তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তিনি গুনছেন তো গুনছেনই... ৪০০০ বছর... ৪৫০০ বছর... ৪৬০০ বছর...।

না, কোনো ভুল নেই। গাছটির বয়স আনুমানিক ৪ হাজার ৯০০ বছর! অর্থাৎ, যখন মিশরে পিরামিড তৈরি হচ্ছিল, তখনো এই গাছ এই পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যিশুখ্রিস্টের জন্মের হাজার বছর আগে থেকেই সে বেঁচে ছিল। আর কারি নিজের হাতে সেই জীবন্ত ইতিহাসকে শেষ করে দিলেন। সেই সময় পর্যন্ত এটিই ছিল মানুষের জানা পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছ!

স্বাভাবিকভাবেই, এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কারি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। তবে তাঁর এই ভুলের কারণে বিজ্ঞান একটা বড় শিক্ষা পেয়েছিল। এরপর থেকে ব্রিসলকোন পাইন গাছগুলোকে রক্ষা করার জন্য কঠোর আইন করা হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছ হিসেবে ধরা হয় মেথুসেলাহকে। এই গাছটির বয়স প্রায় ৪ হাজার ৮৫০ বছর। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে এর সঠিক অবস্থান কাউকে জানানো হয় না, যাতে আরেকজন ডোনাল্ড কারি এসে কুড়াল হাতে হাজির না হন!

বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছ মেথুসেলাহ
ছবি: গেটি ইমেজ

আজ নেভাদার সেই পাহাড়ে প্রমিথিউস আর দাঁড়িয়ে নেই। পাথরের ভিড়ে শুধু তার কাটা গুঁড়িটা পড়ে আছে। আপনি যদি গ্রেট বেসিন ভিজিটর সেন্টারে যান, তবে প্রমিথিউসের শরীরের একটি টুকরো দেখতে পাবেন।

প্রমিথিউস হয়তো আর নেই, কিন্তু তার সেই কাটা গুঁড়িটি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির গায়ে হাত তোলার আগে দুবার ভাবা উচিত!

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স

আরও পড়ুন