সব রোগের টিকা নেই কেন
বিশ্বের বহু দেশে জন্মের পরপরই নবজাতকদের শরীরে অনেকগুলো টিকা দেওয়া হয়। সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করতে সরকারিভাবেই নেওয়া হয়েছে এই উদ্যোগ। যেমন বর্তমানে শিশুকে ছয়বার টিকাকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। জন্মের সময়ই যক্ষ্মা (বিসিজি) এবং মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা (ওপিভি) পায় বাংলাদেশের শিশুরা। ৬, ১০ ও ১৪ সপ্তাহ বয়সে মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা (ওপিভি) এবং পেনটা ইনজেকশন দেওয়া হয়। পেনটা ইনজেকশনে ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, টিটেনাস, হেপাটাইটিস বি এবং হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি-এর টিকা থাকে।
৬ সপ্তাহ থেকে ১৫ মাস বয়স পর্যন্ত শিশু পায় নিউমোনিয়ার টিকা (পিসিভি), পোলিওর ইনজেকশন টিকা (আইপিভি) এবং হাম ও রুবেলার টিকা (এমআর)। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শে কলেরা, জলবসন্ত, হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মেনিনজাইটিস এবং জলাতঙ্কের মতো বিভিন্ন টিকাও দেওয়া যেতে পারে।
শিশুকে এতসব টিকা দেওয়ার পর মনে হতে পারে, সব রোগ থেকেই বুঝি শিশুকে মুক্ত করা গেল। বাস্তবে বিষয়টা তেমন না। টিকা মানব ইতিহাসের অন্যতম সেরা আবিষ্কার হলেও সব রোগ থেকে মানুষের মুক্তি আসেনি। তবে বৈশ্বিকভাবে অনেক ঘাতক রোগ ছিল, যেগুলো টিকার মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন লুই পাস্তুরের উদ্ভাবিত পুরানো কালচার পদ্ধতিতেই প্রায় পুরোপুরি নির্মূল করা গেছে গুটিবসন্ত ও পোলিও।
ইবোলার বিরুদ্ধে মানুষের হাতে এমন এক টিকা আছে যা প্রায় শতভাগ সুরক্ষা দেয়। আবার সাধারণ ফ্লুর জন্য এমন টিকা আছে, যা অর্ধেক ক্ষেত্রেও কার্যকর নয়।
কোন টিকা আছে, কোনটি নেই
সব রোগের টিকা এখনো নেই। যেমন ম্যালেরিয়া ও এইচআইভির মতো রোগগুলো বিজ্ঞানীরা এখনো পরাস্ত করতে পারেননি। বিজ্ঞানের হাতে এখন জিন এডিটিংয়ের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আছে। তবু এই রোগগুলোর টিকা আবিষ্কার হয়নি।
ইবোলার বিরুদ্ধে মানুষের হাতে এমন এক টিকা আছে যা প্রায় শতভাগ সুরক্ষা দেয়। আবার সাধারণ ফ্লুর জন্য এমন টিকা আছে, যা অর্ধেক ক্ষেত্রেও কার্যকর নয়। শিশুদের হাম, মাম্পস, রুবেলা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, জলবসন্ত, পোলিও, হেপাটাইটিস এ ও বি, রোটাভাইরাস, নিউমোকক্কাস এবং মেনিনগোকক্কাল রোগের মতো নানা ধরনের টিকা প্রচলিত আছে।
এই টিকাগুলো মানুষের জীবন রক্ষায় বিপ্লব এনেছে। বিশেষ করে শিশুমৃত্যু হার শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে ১৫ বছর বয়সের আগে প্রতি তিন শিশুর মধ্যে একজন (৩৩ শতাংশ) মারা যেত। এখন টিকাগুলোর কারণে সেই সংখ্যা এক শতাংশেরও কম।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে টাইফয়েড, কলেরা, জাপানিজ এনসেফালাইটিস, মেনিনজাইটিস এ, টাইফয়েড, ডেঙ্গু এবং জলাতঙ্কের জন্য টিকা রয়েছে। তবে ৩০ বছরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনো এইডসের কোনো টিকা নেই। একইভাবে কোনো সর্বজনীন ফ্লু ভ্যাকসিন নেই। ম্যালেরিয়া বা যক্ষ্মার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দেয়, নেই এমন কোনো টিকাও।
এমনকি চাগাস, এলিফ্যান্টাইয়াসিস, হুকওয়ার্ম বা লিভার ফ্লুকের মতো পরজীবী থেকে ছড়ায় এমন রোগের কোনো টিকা নেই। নিপা, লাসা এবং মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোমের মতো ভাইরাসগুলোর জন্যও নেই কোনো টিকা। এগুলো ভবিষ্যতে মহামারির কারণ হতে পারে। এছাড়াও লাইম রোগ, ওয়েস্ট নাইল, জিকা এবং হেপাটাইটিস সি রোগেরও কোনো টিকা নেই।
সব রোগের টিকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নেই। একটি টিকা তৈরিতে সময় লাগতে পারে প্রায় ১০ বছর। খরচ হতে পারে ১০০ কোটি ডলারের বেশি।
টিকা কেন তৈরি হয়নি
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। যেমন পরিষ্কার পানির অভাব, সাবানের কম ব্যবহার, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে টিকা আছে, এমন রোগও মানুষকে আক্রান্ত করছে। মাঝেমধ্যে মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। টিকার অভাবে যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে, তাঁদের তো টিকা থাকলে বাঁচানো যেত। তাহলে কেন সব রোগের টিকা নেই? দ্রুত সব রোগের টিকা আবিষ্কার না হওয়ার পেছনে দুটি কারণ আছে। একটি বৈজ্ঞানিক, অন্যটি দুঃখজনক।
দুঃখজনক কারণটি আগে বলি। সব রোগের টিকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নেই। একটি টিকা তৈরিতে সময় লাগতে পারে প্রায় ১০ বছর। খরচ হতে পারে ১০০ কোটি ডলারের বেশি। একটি রোগের চিকিৎসা আবিষ্কারের জন্য শুনতে এই অর্থের পরিমাণ বিশাল মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতের বাজেটের সঙ্গে তুলনা করলে এই অর্থকে সামান্য মনে হবে। দেশগুলো সমরাস্ত্র কেনার জন্য যে টাকা বরাদ্দ করে, টিকা আবিষ্কার জন্য তার সিকিভাগও বরাদ্দ করে না। প্রতিরক্ষা গবেষণার জন্য রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে কাজ করে। টিকা গবেষকদের নির্দিষ্ট কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিচ্ছিন্নভাবে অর্থ বরাদ্দ করে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত শুধু উচ্চমূল্যের টিকা তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। এই টিকাগুলো আবার ধনী দেশগুলোর শিশু, সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়। আবার অ্যানথ্রাক্স বা প্লেগের মতো কিছু রোগ জৈব অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগের সম্ভাবনা থাকে। দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার এবং জৈব-সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য এসব টিকার পেছনে বরাদ্দ করে।
বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য স্থানীয়ভাবে টিকা উদ্ভাবন বা সংগ্রহের বিকল্প নেই। আমাদের দেশে যেসব টিকা প্রয়োজন, সেগুলোর জন্য সাধারণত বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। বিদেশি সরকারের অনুদানের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অথচ এসব রোগ ধনী বা দরিদ্র দেশের সীমানা মানে না। যেকোনো দেশে যে কোনো সময় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভাইরাসে হাতেগোনা কয়েকটি প্রোটিন থাকলেও ব্যাকটেরিয়ার প্রায় ৬ হাজার পর্যন্ত প্রোটিন থাকে। পরজীবীর প্রোটিনের সংখ্যা আরও বেশি।
টিকা তৈরি না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ
টিকা তৈরি না হওয়ার দ্বিতীয় কারণটি বৈজ্ঞানিক। অনেক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু জিনগতভাবে এত আলাদা যে একটি টিকা সবার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। একটি প্রাণী যেমন অন্য প্রাণী থেকে আলাদা, ঠিক একইভাবে এই জীবাণুগুলোও একে অপরের থেকে আলাদা। এ ছাড়াও অনেক জীবাণু দ্রুত মিউটেশন বা রূপ বদলায়। এ কারণে এদের প্রোটিনের ধরন বা গঠন বদলে যায়। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যে প্রোটিনকে চেনার জন্য তৈরি হয়, মিউটেশনের পর সেই প্রোটিনগুলো দেখতে আলাদা হয়। ফলে আগের টিকা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে না।
ভাইরাসে হাতেগোনা কয়েকটি প্রোটিন থাকলেও ব্যাকটেরিয়ার প্রায় ৬ হাজার পর্যন্ত প্রোটিন থাকে। পরজীবীর প্রোটিনের সংখ্যা আরও বেশি। এই প্রোটিনগুলোর ধরণ দ্রুত বদলে যাওয়ার কারণেই সব রোগের জন্য কার্যকর টিকা তৈরি করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) জীবাণুকে শনাক্ত করে এর পৃষ্ঠে থাকা প্রোটিনগুলোর আকৃতি দেখে। টিকা সেই প্রোটিনের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করে। কিন্তু জীবাণু যদি মিউটেশনের মাধ্যমে তার প্রোটিনের আকৃতি বদলে ফেলে, তাহলে আগের অ্যান্টিবডিগুলো আর কাজ করে না। তখন আমাদের শরীর সেই পরিবর্তিত জীবাণুকে চিনতে পারে না সহজে।
টিকা আমাদের শরীরকে নির্দিষ্ট প্রোটিন চিনতে শেখায়। যখন জীবাণু তার প্রোটিন পরিবর্তন করে ফেলে, তখন টিকাও অকার্যকর হয়ে যায়। এই কারণেই প্রতি বছর নতুন ফ্লু ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হয়। এইচআইভি, ফ্লু এবং হেপাটাইটিস সি-এর মতো ছোট ভাইরাসগুলো খুব দ্রুত নিজেদের রূপ বদলায়। ফলে অ্যান্টিবডি এদের ধরতে পারে না।
বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া অনেক রোগেরই টিকা তৈরি করা সম্ভব। বিশ্ব নেতারা যদি আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করে, তবে টিকা তৈরি করা অসম্ভব নয়।
কীভাবে একটি টিকা তৈরি করা হয়
কোন টিকা তৈরি হবে তার একটি সাধারণ নিয়ম আছে। যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কিছু মানুষ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আজীবন রোগমুক্ত থাকে এবং কখনো আক্রান্ত না হয়, তবে সেই রোগের টিকা তৈরি করা সম্ভব। গুটিবসন্ত এই শর্ত পূরণ করে। কিন্তু এইচআইভি, ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মা এই শর্ত পূরণ করে না। এইচআইভি মাত্র এক দিনে যতটুকু রূপ পরিবর্তন করে, ফ্লু তা করতে পুরো এক বছর সময় নেয়।
এ ছাড়াও টিবি ব্যাকটেরিয়া শ্বেত রক্তকণিকা দিয়ে বন্দি থাকলেও বেঁচে থাকতে পারে। আর ম্যালেরিয়া পরজীবী ঘন ঘন রূপ বদলায়। ম্যালেরিয়ায় একবার আক্রান্ত হলে পরে আর আক্রান্ত হবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যারা বারবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকে, তারা প্রতিবার একটু কম অসুস্থ হয়। কিন্তু তারা যদি ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চল থেকে চলে যায়, তবে সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা চলে যাবে। তারা ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে ফিরে এলে মাত্র একটি মশার কামড়েই তাঁদের মৃত্যু হতে পারে।
বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া অনেক রোগেরই টিকা তৈরি করা সম্ভব। বিশ্ব নেতারা যদি আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করে, তবে টিকা তৈরি করা অসম্ভব নয়। বরাদ্দ পেলে যে দ্রুত টিকা তৈরি সম্ভব, তার উদাহরণ কোভিড অতিমারি। কোভিড-১৯ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল ২০১৯ সালের শেষ থেকে ২০২০ সালের শুরুতে। ২০২০ সালের প্রথমাংশে বিভিন্ন দেশে টিকা উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যায় কোভিড টিকা। ২০২১ সালের মধ্যে ফাইজার, মর্ডানা এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো প্রতিষ্ঠান বিশ্বে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডোজ টিকা উৎপাদন করে।
তাই টিকা তৈরিতে দশ বছর সময় হয়তো লাগবে না। এমন দিন আসবে, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে আর মানুষ মারা যাবে না। সবার জন্য, সব রোগের জন্য আবিষ্কার হবে টিকা!