শামুকের গতি ধীর কেন?

শামুক
শামুক আকারে ছোট হলে কী হবে, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানে এদের ভূমিকা অনেক বড়। বীজ ও ছোট ছোট অপ্রয়োজনীয় গাছ খেয়ে ফেলার মাধ্যমে এরা চারপাশে গাছের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার পঁচনশীল মৃতদেহ খাবার হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে মাটিতে পুষ্টির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে।

ইট-সিমেন্টের শহরে শামুকের দেখা মেলা ভার। তবে গ্রামে এখনও শামুকের দেখা পাওয়া যায় খুব সহজেই। বিশেষ করে, বর্ষা মৌসুমে অনেকসময় খাল-বিল থেকে এরা উঠে আসে বাড়ির আঙ্গিনায়। ধানি জমির আলের ধারে বা যেকোনো জলা জায়গায় এ সময় দেখা মেলে শামুকের।

অনেকসময় বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে দেখা যায় আকারে ছোট্ট, পিচ্ছিল ও মাংশল ধীরগতির একধরনের প্রাণী। চলার গতি বা দেহের কাঠামো শামুকের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। পার্থক্য শুধু, শামুকের খোলস আছে, এদের নেই। শামুককে ইংরেজিতে স্নেল বলে। আর এ প্রাণীগুলোকে বলা হয় স্লাগ। স্লাগের সঠিক বাংলা পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে, বাংলাদেশে খুব বেশি দেখাও যায় না এ প্রাণী। এ লেখায় আমরা একে স্লাগ বলেই সম্মোধন করব। বলে রাখা উচিত, স্লাগ ও শামুক একই প্রজাতির প্রাণী।

তবে কেবল বাড়ির চারপাশে নয়, স্লাগের দেখা মেলে বন জঙ্গল কিংবা সমুদ্রেও। শামুকের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। অর্থাৎ স্বাদু বা লোনা পানির জলাশয়, ঝোপঝাড় কিংবা বনাঞ্চল—সবখানেই শামুকের বাস। সব মহাদেশে এদের দেখা পাওয়া যায়। পৃথিবীতে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার প্রজাতির শামুক ও স্লাগ আছে। এসব শামুক ও স্লাগ যে পরিবেশেই থাকুক না কেন, একটি ব্যাপারে এদের সবার মধ্যে বেশ মিল। এরা খুবই ধীরগতিতে চলাফেরা করে।

পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী শামুকের বেগ ঘন্টায় প্রায় ০.০৬ মাইল বা ০.০৯৭ কিলোমিটার। এই বেগ কতটা ধীর, তা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার বা আপনার গতি যদি এমন হতো, তাহলে প্লেট থেকে মুখে খাবার তুলতেই লেগে যেত এক মিনিটেরও বেশি সময়।

স্লাগ

দুই

শামুকের এত ধীরগতির পেছনের কারণ কী? যুক্তরাষ্ট্রের দ্য পেনসিলভেনিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব ও সম্প্রসারণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জন টুকার। তাঁর মতে, এই প্রশ্নের উত্তর আমরা যত সহজ মনে করি, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক জটিল।

শামুক মলাস্কা পর্বের প্রাণী। বিশাল এ পর্বে শামুক ছাড়াও আছে ঝিনুক, স্কুইড এবং অক্টোপাসের মতো প্রাণী। মলাস্কা পর্বের মাঝে আছে নানা শ্রেণি। শামুক ও স্লাগের অবস্থান গ্যাসট্রোপড শ্রেণিতে।

বৈচিত্র্যময় পরিবেশে বসবাস করে এ শ্রেণির প্রাণীরা। এ কারণে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের খাবারই এরা খায়। কিছু প্রজাতি তৃণভোজী বা হারবিভোরাস, গাছ-লতা খায়। কিছু আছে মৃতভোজী, মানে মৃত জীব বা উদ্ভিদ খায় এরা। কিছু আবার মাংসাশী বা কারনিভোরাস, এরা অন্য প্রাণী শিকার করে খায়।

শামুকের চলার গতি ধীর হয় কেন, সে প্রশ্নের উত্তরেরর জন্য আমাদের তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। এরা কীভাবে চলাচল করে, কী খায় এবং কাদের খাবারে পরিণত হয়।

প্রথমে আসা যাক চলাচল প্রসঙ্গে। অন্যান্য প্রাণীর মতো শামুকের পা, ডানা বা পাখনা নেই। তার বদলে আছে ‘ভেনট্রাল ফুট’। মজার বিষয়, নামে ‘ফুট’ হলেও এগুলো কিন্তু মোটেই পায়ের মতো নয়। অন্তত আমরা পা বলতে যা বুঝি, তা তো নয়ই।

ভেনট্রাল ফুট মূলত শামুক ও স্লাগের শরীরের নিচের অংশে থাকা একগুচ্ছ পেশি। এগুলো আবার চটচটে পিচ্ছিল মিউকাসে ঢাকা থাকে। এই পেশির সংকোচন-প্রসারণের ফলে শামুকের দেহের নিচের অংশে একধরনের ঢেউ বয়ে যায়। এ তরঙ্গের কারণে পেশির নিচে থাকা মিউকাস পরিণত হয় পিচ্ছিল তরলে। পেশির আন্দোলন আর পেশির নিচে থাকা পিচ্ছিল তরল—এই দুইয়ের সাহায্যে শামুক চলতে শুরু করে। সমতল মাটির ওপর হোক বা গাছের গা বেয়ে ওঠা হোক, প্রায় সব জায়গাতে শামুক চলতে পারে কোনো ঝামেলা ছাড়া। 

শামুক

শামুকের দেহের নিচের পেশিতে কতগুলো ভাঁজ তৈরি হচ্ছে এবং কী পরিমাণ মিউকাস তৈরি করছে, তার ওপর চলার গতি নির্ভর করে। দুটোই তৈরি হওয়ার পরিমাণ সীমাবদ্ধ। তাই চাইলেও শারীরিকভাবে শামুকের গতি বাড়ানোর সুযোগ নেই। চলাচলের এই অভিনব উপায়ের কারণে শামুকের গতি বেশ কম হয়।

শামুকের খাদ্য তালিকার দিকে আরেকবার নজর দিলে বুঝতে পারব, এদের খাবারের জন্য আসলে তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। অনেক প্রাণী, বিশেষ করে শিকারী প্রাণীদের বেশ ক্ষিপ্র হতে হয় খাবার সংগ্রহের জন্য। কারণ এদের শিকারগুলোও চলে বেশ দ্রুত। কিন্তু শামুকের সে ঝামেলা নেই। বেশিরভাগ শামুকের খাবার হলো উদ্ভিদের নানা অংশ কিংবা প্রাণীর মৃতদেহ। এগুলো একজায়গাতে স্থির থাকে। তেমন একটা নড়াচড়া করে না। খাবার যখন কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না, তখন আর দৌড়াদৌড়ি করে লাভ কী?

খাবার ধরতে না হোক, অন্য প্রাণীর শিকার হওয়া থেকে বাঁচতেও তো পালানো প্রয়োজন। আর সে জন্য প্রয়োজন গতি। তাই তো? আসলে কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। শামুকের সুরক্ষার জন্য এদের গায়ে থাকে শক্ত খোলস। শিকারী প্রাণী দেখলেই খোলসের মাঝে পুরো দেহ গুটিয়ে নেয় এরা। মজার ব্যাপার হলো, পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে এদের খোলস হয় নানা রঙের। যেমন স্থলভাগে যেসব শামুক বাস করে, এদের বেশিরভাগের খোলস বাদামী। একেবারে খোলা জায়গাতেও মাটির রঙের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে শিকারি প্রাণীরা বেশিরভাগ সময় এদের আলাদা করে দেখতে পায় না।

এখানেই শেষ নয়। শামুকের নিরাপত্তার আরেক স্তর হলো এদের শরীর থেকে বের হওয়া মিউকাস। স্লাগের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। এদের দেহ খোলসে ঢাকা থাকে না, তবে মিউকাসে ঢাকা থাকে। চলাচলের জন্য এরা যে মিউকাস ব্যবহার করে, তার চেয়ে একটু ভিন্ন এই আত্মরক্ষার মিউকাস। এটা একটু বেশি আঠালো। শিকারি প্রাণী যখন এদের খাওয়ার চেষ্টা করে, তখন মিউকাস তাদের মুখে আঠার মতো লেগে যায়। চিবানো কিংবা গিলে ফেলা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে শিকারি প্রাণীরা খুব ঠেকায় না পড়লে শামুক বা স্লাগ খেতে চায় না।

অন্যদিকে সমুদ্রের শামুকগুলো হয় রং-বেরঙের। রং দেখে ভয় পেয়ে শিকারি প্রাণী এদের থেকে দূরে থাকে। এ ছাড়া এসব শামুকের দেহে থাকে বিষাক্ত পদার্থ। ফলে শিকারী প্রাণীরা এদেরকে তেমন একটা ঘাঁটায়ও না।

তিন

শামুক আকারে ছোট হলে কী হবে, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানে এদের ভূমিকা অনেক বড়। বীজ ও ছোট ছোট অপ্রয়োজনীয় গাছ খেয়ে ফেলার মাধ্যমে এরা চারপাশে গাছের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার পঁচনশীল মৃতদেহ খাবার হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে মাটিতে পুষ্টির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে। গাছ এ পুষ্টি নিয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে।

প্রাকৃতিক অনেক সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নিরীহ এই ছোট্ট প্রাণীটি প্রায়ই অন্য প্রাণীর শিকারে পরিণত হয়। তবে খাদ্য শৃঙ্খলে এটি স্বাভাবিক। তবে আমাদের উচিত অপ্রয়োজনে শামুক ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকা। ছোট্ট এই প্রাণীটি পরিবেশের একটি অংশ। পরিবেশ সুন্দর রাখতে, পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে এদের প্রয়োজন সীমাহীন। শুধু শামুক নয়, সব প্রাণীর প্রতিই আমাদের সহানূভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন