নিউরালিংকের ব্রেইন চিপ কীভাবে কাজ করে?

চিন্তা করে করে গেম খেলছে পেজার
নিউরালিংকের এ বিশেষ চিপের মাধ্যমে মানবদেহের স্থুলতা, অটিজম, হতাশা, সিজোফ্রেনিয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা সারিয়ে তোলা যাবে। পাশাপাশি মানুষের মস্তিষ্ককে ওয়েব ব্রাউজিং ও টেলিপ্যাথির মতো কাজে সক্ষম করে তোলা সম্ভব হবে।

সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে মানুষের মস্তিষ্কে ইলেকট্রনিক চিপ বসানোর অনুমতি পেয়েছে নিউরালিংক। প্রথমবারের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ ছাড়পত্র দিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন বা এফডিএ। ইলন মাস্ক এ প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এই চিপটা কী, এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি এককথায়—জিনিসটা খানিকটা ছোট ছোট তার দিয়ে খুলিতে বসানো ফিটবিটের মতো। ফিটবিট মানে, ফিটনেস ট্র্যাকার। স্মার্টফোনে বসানো যেসব চিপ মানুষের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বা রক্তচাপ ইত্যাদি রেকর্ড করে রাখে, সেগুলো।

কিন্তু জিনিসটা আসলে কী? কীভাবে কাজ করে? ইলন মাস্ক আসলে কী বসাতে চাচ্ছেন মানুষের মস্তিস্কে?

এই চিপটার কোনো ব্র্যান্ড নেম সেভাবে নেই। অনেকে একে প্রতিষ্ঠানের নামে ‘নিউরালিংক’-ই বলছে। এই নিউরালিংক, সংক্ষেপে ‘লিংক’ আসলে ১ হাজার ২৪টি চ্যানেল বা ইলেকট্রোডযুক্ত ২৩×৮ মিলিমিটার আকৃতির একটি চিপ। ইলেকট্রোডগুলো নন-করোসিভ, মানে ক্ষয়ে যায় না—এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি। যেমন সিলিকন কার্বাইড। ব্যাস ৫ মাইক্রন। এই ব্যাসের পরিমাণ মানুষের একটি চুলের ২০ ভাগের ১ ভাগ।

লিংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘পড়তে’ (Read) এবং ‘লিখতে’ (Write) পারা। কম্পিউটারবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পড়া’ বা ‘রিড’ করা মানে, সিগন্যাল শনাক্ত করতে পারা। কমান্ড বা নির্দেশ বুঝতে পারা। আর ‘লেখা’ বা ‘রাইট’ করা মানে আউটপুট দেওয়া। এগুলো জানার জন্য অবশ্য কম্পিউটারবিজ্ঞানী হতে হয় না। যাঁরা বাসায় কম্পিউটার চালান, সবাই নিশ্চয়ই রিড-রাইটের সঙ্গে পরিচিত।

আরও পড়ুন

নিউরালিংক মূলত নিউরন থেকে আসা সিগন্যাল ‘রিড’ বা শনাক্ত করতে পারে এবং সে হিসেবে ‘রাইট’, মানে নিউরনকে নির্দিষ্ট কোনো কাজের কথা ভাবার জন্য যে বৈদ্যুতিক ইমপালস তৈরি করতে হয়, সেটা উৎপন্ন করে। ফলে নিউরনটি সক্রিয় হয় এবং সেই কাজ করতে পারে।

এটা কতটা কার্যকর, তা নিয়ে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল, অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণীর মাথায় চিপ বসিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালের এপ্রিলে পেজার নামে একটি বানরের মাথায় চিপ বসায় নিউরালিংক। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তিন মিনিটের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, পেজার নামে একটি বানর শুধু চিন্তা করে করে, কোনো কিছু হাত দিয়ে না ধরেই মাইন্ড পং নামের একটি ভিডিও গেম খেলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তোলে এ ভিডিও।

গবেষকেরা পেজার নামে এই বানরটির হাত ও বাহুর মোটর করটেক্স স্নায়বিক অঞ্চলে এই ‘লিংক’ বসিয়েছেন। এই অঞ্চল মূলত স্বেচ্ছায় করা নড়াচড়ার পেছনের পরিকল্পনা করে, নড়াচড়া শুরু করে এবং নড়াচড়ার পুরো কাজটা নিয়ন্ত্রণ করে। বসিয়ে দেওয়ার পর লিংক থেকে গবেষকেরা পেজারের সম্পূর্ণ স্নায়বিক কাজকর্মের একটি মানচিত্র পেয়ে গেছেন। তারপর স্নায়বিক বিভিন্ন ধরনের সিগন্যালের জন্য মোটর স্নায়ু কীভাবে সাড়া দেয়, এর ফলে নড়াচড়া কেমন হয়—এসবের একটি মডেল তৈরি করেছেন। এখান থেকে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, কোনো চিন্তা করলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, চিন্তার সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক কী রকম ইত্যাদি। এর ওপর নির্ভর করে তাঁরা আবার একটি ‘ডিকোডার’ বানিয়েছেন। আসল কাজ করে এই ডিকোডার।

নিউরালিংকের গঠন

মস্তিষ্ক কোনো চিন্তা করলে ডিকোডার সেই সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং এর ফলে মোটর স্নায়ুটির কীভাবে সাড়া দেওয়া উচিত, তা অনুমান করার চেষ্টা করে। একটু অন্যভাবে বললে, চিন্তা থেকে আসা সিগন্যাল অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্গের কীভাবে সাড়া দেওয়ার কথা, কতটুকু দ্রুত এবং কোন দিকে নড়াচড়া করার কথা সেসব এটি হিসাব কষে বের করে ফেলে। এই হিসাব সে আউটপুট হিসেবে দেয় কম্পিউটারকে। ফলে কম্পিউটার বুঝতে পারে, স্ক্রিনের ওপর মাউসের কার্সরটা কোন দিকে নাড়ানো উচিত (মানে হাত দিয়ে ধরে থাকলে কোন দিকে, কীভাবে, কত দ্রুত নাড়াত)। সে অনুযায়ী এটি কার্সরটা নাড়ায়। এভাবেই পেজার শুধু চিন্তা করেই কার্সরটি নাড়াতে পেরেছিল, গেম খেলতে পেরেছিল।

এখন চিন্তার ওপর নির্ভর করে শুধু হাত নয়, পুরো দেহের নড়াচড়াই যদি অনুমান করা যায় এবং সে হিসাবে বিভিন্ন যন্ত্রকে নির্দেশ দেওয়া যায়, তাহলে কী হবে, ভাবুন তো!

সে চিন্তা মাথায় রেখেই ধাপে ধাপে গবেষণা করে মানবদেহের জন্য এই প্রযুক্তিকে উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। চিন্তার ওপর নির্ভর করে একজন মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ কীভাবে নড়াচড়া করে, তা যদি হিসাব কষে বের করে ফেলা যায়, তাহলে সামনে রাখা বিভিন্ন যন্ত্রকে সেভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া যাবে।

একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি একটি গাড়ি চালাচ্ছেন। কিন্তু তিনি হাত ও পা নাড়াতে পারেন না। যখনই ব্রেক করা প্রয়োজন, তিনি ব্রেক কষার কথা ভাবেন। পা কাজ করলে, তাঁর পা ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিত। মানুষটি যেহেতু পা নাড়াতে পারেন না, তাঁর এই চিন্তা সরাসরি পৌঁছে যাবে গাড়ির কাছে। গাড়ি নিজেই তখন ব্রেক করবে। কত জোরে প্যাডেলে চাপ দিতে হবে, সে তথ্যও গাড়িটা পেয়ে যাবে ব্যক্তিটির চিন্তা থেকে। একইভাবে মানুষটি যেভাবে চাচ্ছেন, সেভাবে হাত নাড়াতে না পারলেও গাড়ি তাঁর হয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে দেবে। তার মানে শুধু চিন্তা করেই তিনি গাড়ি চালাতে পারবেন! একইভাবে চিন্তার মাধ্যমে চালানো যাবে মুঠোফোন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র।

নিউরালিংক যদি এটা আসলেই করতে পারে, তাহলে মানুষ প্রযুক্তির নতুন এক যুগে প্রবেশ করবে। কল্পবিজ্ঞানের বিচিত্র জগৎ ছেড়ে চিন্তার মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করার ব্যাপারটি হয়ে যাবে নিখাদ বাস্তব। পেজারের ভিডিও ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে ইলন মাস্কের দাবি, নিউরালিংকের এ বিশেষ চিপের মাধ্যমে মানবদেহের স্থুলতা, অটিজম, হতাশা, সিজোফ্রেনিয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা সারিয়ে তোলা যাবে। পাশাপাশি মানুষের মস্তিষ্ককে ওয়েব ব্রাউজিং ও টেলিপ্যাথির মতো কাজে সক্ষম করে তোলা সম্ভব হবে। তবে মাস্ক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি এখানে থামতে রাজি নন। ২০২০ সালের নিউরালিংক ইভেন্টে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে নিউরালিংক স্মৃতি ‘সেভ’ করে রাখতে পারবে এবং সময়মতো ‘রিপ্লে’ দেখাতে পারবে। তিনি মনে করেন, চাইলে স্মৃতির ‘ব্যাকআপ’ রেখে দেওয়া এবং পরে ‘রিস্টোর’ করে নেওয়া সম্ভব। তাঁর মতে, ‘আপনারা চাইলে এসব স্মৃতি নতুন কোনো দেহে বা কোনো রোবটের ভেতরে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। বড় বিচিত্র এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি আমরা!’

তবে সেজন্য আরও সাবধানতা প্রয়োজন। বিজ্ঞানচিন্তার সূত্রে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের কথা যেমন জানা যাচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিউরালিঙ্ক প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা চালানোর ফলে মারা গেছে অনেক নিরীহ প্রাণী। এ নিয়ে এখন রাষ্ট্রীয় তদন্ত চলছে। সে অবস্থাতেই এ অনুমতি দেওয়া হলো।

মার্কিন সরকারের একাধিক বিভাগ নিউরালিংকের এসব গবেষণা নিয়ে তদন্ত করছে। এসবের ফলাফল কী হবে, বা ইলন মাস্ক আসলেই এ উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষের কতটা উপকার করতে পারবেন, সে প্রশ্নের জবাব জানে শুধু সময়।

তবে মানুষ ইতিমধ্যে ক্রিসপার আবিষ্কার করে জিন সম্পাদনার উপায় বের করে ফেলেছে। ইলন মাস্ক হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর অনুমতি পেয়ে গেছেন। কল্পবিজ্ঞান সত্যি হওয়ার এই যুগে হয়তো সবই সম্ভব!

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, অ্যানালাইটিকস ইন্ডিয়াম্যাগ, রয়টার্স, টুইটার, উইকিপিডিয়া, নিউরালিংক ডট কম ও বিজ্ঞানচিন্তা

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন