গণিত চ্যালেঞ্জ: ধাঁধাটি মেলাতে পারবেন?

আগেই জানিয়ে রাখি, এ সমস্যার একাধিক বৈধ সমাধান আছে। না, আঁতকে উঠবেন না। ঠিকই শুনেছেন। এ কারণেই এই সাধারণ দেখতে গুণটা নিয়ে এত দ্বিধা।

এই সমস্যাটির সমাধান করতে গেলেই তর্ক বেঁধে যায়। ধাঁধাটি অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। কেউ বলেন, উত্তর এটা, কেউ বলেন ওটা। অনেকেই বলেছিলেন, গুগলের অনলাইন ক্যালকুলেটরও নাকি এর ভুল উত্তর দিয়েছিল। সমস্যাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কিছুদিন আগে। গণিত পছন্দ করেন, এমন অনেকেই এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক করেছেন তখন। এটাকে সমস্যা না বলে ধাঁধা বা হেঁয়ালি বললেই জুতসই হয়। যা-ই বলুন না কেন, দেখতে নিতান্ত সাধারণ মনে হলেও সমাধান করতে গিয়ে অনেককেই বেগ পেতে হয়।

সমস্যাটি হলো, ৬÷২(১+২)=?। হ্যাঁ, এটাই আজকের আলোচনার বিষয়।

২০১৫ সালে এই সমস্যাটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। পরে আরও অনেকবার এটি আলোচনায় এসেছে, এসেছে সাম্প্রতিককালেও। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের ধাঁধার উত্তর খুঁজে বের করে আমরা কমেন্ট সেকশনে গিয়ে মিলিয়ে দেখি বাকিদের উত্তর। সমস্যা তখন আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। কারণ, একটি সমস্যার অনেকগুলো উত্তরের দেখা মেলে। কোনটা আসলে সঠিক? আপনারটি নাকি কমেন্টের কোনো একটি?

আপনি বরং এবারে একটু থেমে এ সমস্যার সমাধান নিজে করুন। তারপর চলুন আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত। সমাধানে যাওয়ার আগে একটুখানি গণিতের ভাষা নিয়ে কথা বলা জরুরি। 

আরও পড়ুন
গণনার ক্ষেত্রে প্রতীক চিহ্ন, বন্ধনী, বর্গ ও বর্গমূল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর ওপরই নির্ভর করে আপনি সমাধানটি ডানদিক থেকে শুরু করবেন, নাকি বাঁ থেকে। গণিতের এ নিয়ম না মানলে আপনার উত্তর মিলবে না। 

ইংরেজি বা বাংলা ভাষায় আমরা বাম থেকে ডান দিকে পড়ি। ব্যাতিক্রমও আছে। আরবি ভাষা আবার পড়া হয় ডান থেকে বাঁয়ে। যাহোক, আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সবকিছু বাঁ থেকেই পড়ি। সুতরাং, গণিতও স্বভাবতই বাঁ দিক থেকে গণনা শুরু করি। গণিতের ক্ষেত্রে সব সময় এ নিয়ম অনুসরণ করলে আপনাকে বিপদে পড়তে হবে। তাই বিপদ এড়াতে গণিতের ‘বানান’ ও ‘ব্যাকরণ’ সম্পর্কে একটু ধারণা রাখা প্রয়োজন। 

গণনার ক্ষেত্রে প্রতীক চিহ্ন, বন্ধনী, বর্গ ও বর্গমূল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর ওপরই নির্ভর করে আপনি সমাধানটি ডানদিক থেকে শুরু করবেন, নাকি বাঁ থেকে। গণিতের এ নিয়ম না মানলে আপনার উত্তর মিলবে না। 

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে মনে রাখার জন্য একটি সূত্র শেখানো হয়। বডমাস (BODMAS)। অর্থাৎ, ব্রাকেট, অর্ডার, ডিভিশন, মাল্টিপ্লিকেশন, অ্যাডিশন এবং সাবট্রাকশন। মানে এ ধরনের সমাধান করতে হলে বন্ধনী, বর্গ বা বর্গমূল, ভাগ, গুণ, যোগ ও বিয়োগ—এই ক্রমানুসারে সমাধান করতে হবে। অনেক দেশে আবার BODMAS-এর পরিবর্তে PEDMAS, BEDMAS বা BIDMAS ব্যবহার করেন। সবক্ষেত্রে অবশ্য সমাধান একই হয়।

এবার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। নিচের সমীকরণ দুটিতে একইসঙ্গে যোগ এবং গুণ করতে হবে।

ক. ৩×৪+২ 

খ. ২+৩×৪ 

আরও পড়ুন
যোগ এবং গুণের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে লেখা আর না লেখায় কিছু যায় আসে না। কিন্তু বিয়োগ ও ভাগের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার দরকার আছে।

প্রথম সমীকরণের ক্ষেত্রে ‘বডমাস’ প্রয়োগ করলে সমাধান ঠিকই থাকে। বাম থেকে গুণ করলে ৩×৪=১২। তারপরে ১২+২=১৪। কিন্তু দ্বিতীয় সমীকরণের ক্ষেত্রে কেউ কেউ ভুল করেন। তাঁরা প্রথমে ২+৩=৫ এবং ৫×৪=২০ গণনা করেন। ভুলটা হয় এখানেই। এক্ষেত্রে বাঁ দিক থেকে গুণ করলে সমাধান মিলবে না। কারণ ‘বডমাস’-এর নিয়মটা ভালো করে খেয়াল করুন। নিয়মানুসারে যোগের আগে গুণ করতে হবে। অর্থাৎ, ৩×৪=১২ এবং ১২+২=১৪।

এবার একটু বন্ধনীর কথা বলা প্রয়োজন। কারণ, বন্ধনীর জন্য একটা গণনা সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। সাধারণত গণনার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট অংশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য বন্ধনী ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ কোনো সমীকরণে বন্ধনী থাকলে, ওই অংশের কাজ শুরুতে করতে হবে। ওপরের সমীকরণ দুটিই এবার একটু ভিন্নভাবে দেখুন।

গ. ৩×(৪+২) 

ঘ. (২+৩)×৪

আগের সমীকরণের সঙ্গে এখানে পার্থক্য শুধু বন্ধনীর। দেখুন উত্তরগুলো কীভাবে বদলে যাচ্ছে। প্রথম সমীকরণের ক্ষেত্রে (গ নং) শুরুতে বন্ধনীর ভেতরের অংশের কাজ করতে হবে। মানে ৪+২=৬ আগে করতে হবে। এবার ৩×৬=১৮ হবে। 

আবার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে (ঘ নং) শুরুতে করতে হবে ২+৩=৫। কারণ, এটুকু আছে বন্ধনীর ভেতরে। এরপরে হবে ৫×৪=২০। সুতরাং, দ্বিধা দূর করার জন্য  ‘বডমাস’ নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে। 

আরও পড়ুন

আরেকটা নিয়ম সম্পর্কে বলেই আজ শেষ করব। যোগ এবং গুণের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে লেখা আর না লেখায় কিছু যায় আসে না। কিন্তু বিয়োগ ও ভাগের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার দরকার আছে। যেমন যোগের ক্ষেত্রে ৩+২+১ লেখাও যে কথা, (৩+২)+১ বা ৩+(২+১) লেখাও একই কথা। কিন্তু ৩-২-১ লেখা আর ৩-(২-১) বা (৩-২)-১ লেখা এক কথা নয়। নিজেই হিসেব করে দেখুন, কত পার্থক্য! 

যোগের ক্ষেত্রে আপনি যেভাবেই যোগ করবেন উত্তর হবে ৬। কিন্তু বিয়োগের ক্ষেত্রে উত্তর হবে,

৩-২-১=০

৩-(২-১)=২

(৩-২)-১=০ 

যাহোক, গণনার অনেক খুঁটিনাটি জানা হলো। এবার চলুন, ওপরের সমস্যাটির সমাধান দেখি। 

আগেই জানিয়ে রাখি, এ সমস্যার একাধিক বৈধ সমাধান আছে। না, আঁতকে উঠবেন না। ঠিকই শুনেছেন। এ কারণেই এই সাধারণ দেখতে গুণটা নিয়ে এত দ্বিধা। অনেকে বলেন, ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই ভুল করেন এটা। যদিও আমরা দেখব, এটা সত্যি নয়। কারও মতে এটার উত্তর ৯, আবার কারো মতে ১। চলুন, দুটোই দেখা যাক। 

আরও পড়ুন

‘বডমাস’-এর নিয়ামানুসারে প্রথমে বন্ধনীর ভেতরের অংশের কাজ করতে হবে। অর্থাৎ, 

৬÷২(১+২) 

৬÷২×৩

এ পর্যন্ত আসার পরে এখন শুরুতে ভাগ করবেন নাকি গুণ? নিয়মানুসারে শুরুতে ভাগ করতে হবে। তাহলে,

৬÷২×৩

৩×৩

৯ 

অর্থাৎ, উত্তর হলো ৯। 

তবে এই উত্তর নিয়ে বিতর্কও আছে। অনেকেই মনে করেন গুণটা হওয়া উচিৎ এরকম:

৬÷২(১+২) 

৬÷২(৩)

৬÷৬

১ 

অর্থাৎ, উত্তর হলো ১। 

আসলে এখানে প্রধান আসামী ওই ভাগ বা গুণ চিহ্ন। এই সমস্যার একটিমাত্র সমাধানে পৌঁছাতে হলে সমাধানটিকে একটু অন্যভাবে লিখতে হবে। হয় আপনি (৬÷২)(১+২)=৯ লিখতে পারেন, অথবা ৬÷(২(১+২))=১ লিখতে পারেন। অর্থাৎ আপনাকে ওই সমস্যার সঙ্গে আলাদা বন্ধনী যোগ করতে হবে। নতুবা একটিমাত্র সমাধানে পৌঁছানো কঠিন। তবে সেটা আসলে কোনো সমস্যা নয়। কারণ, দুটো সঠিক উত্তর এক্ষেত্রে গণিতের নিয়মেই গ্রহণযোগ্য।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: দ্য কনভার্সেশন ডট কম