গাছের মৃত্যুরহস্য

বয়স হওয়ার (বার্ধক্যজনিত) কারণেও গাছের মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যু বলতে আমাদের চোখের সামনে যে ছবি ভাসে, গাছের মৃত্যুটা তেমন নয়

বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।

প্রবাদটি সবাই কম-বেশি জানি। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে শুধু ফল নয়, গাছ আমাদের সঙ্গে পরিচিত এর সবটুকু দিয়েই। কাণ্ড, পাতা, ফুল—গাছের সবই আমাদের কাজে লাগে। শুধু আমাদের কথা বলছি কেন, গাছ সব প্রাণীরই বন্ধু। ছায়া বা খাবারের উৎস হয়ে গাছ যেমন প্রাণীর জীবন বাঁচায়; তেমনি ঝড়, বৃষ্টি, খরা বা নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে লড়াই করে প্রকৃতির সঙ্গে। প্রাণীর মতো গাছেরও জীবন আছে। কেউ শক্তি প্রয়োগ করলে ভিন্ন কথা। এমনিতে গাছ এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়েই জীবন পার করে দেয়। তাই গাছ দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না প্রাণীর মতো। এজন্য প্রাণীকে আমরা যতটা ছাড় দিই, গাছের বেলায় তা দিতে চাই না। গাছেরও যে জীবন আছে, সেটা মনে রাখি না অনেক সময়।

গাছের জীবন নানাভাবে শেষ হতে পারে। অর্থাৎ গাছ মারা যেতে পারে নানাভাবে। মারা যাওয়ার এই ধরনগুলোকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। দ্রুত মৃত্যু ও ধীর মৃত্যু।

বয়স হওয়ার (বার্ধক্যজনিত) কারণেও গাছের মৃত্যু হয়

আগুন, বন্যা বা বাতাসের কারণে গাছের শেকড় থেকে কাণ্ডে পুষ্টি ও পানি আসার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে গাছ দ্রুত মারা যেতে পারে।

পোকামাকড়ের আক্রমণ বা রোগে আক্রান্ত হয়েও মারা যায় গাছ। এসব ক্ষেত্রে মারা যায় ধীরে। সময় লাগে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত। মারা যাওয়ার পেছনের কারণ এখানেও একই। গাছের সব অংশে ঠিকমতো পুষ্টি ও পানি পৌঁছে না। তবে এ ক্ষেত্রে খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায় ধীরে ধীরে।

মজার বিষয় হলো, বয়স হওয়ার (বার্ধক্যজনিত) কারণেও গাছের মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যু বলতে আমাদের চোখের সামনে যে ছবি ভাসে, গাছের মৃত্যুটা তেমন নয়। অর্থাৎ প্রাণীদের মতো গাছ মারা যাওয়া মানে সব শেষ নয়। বরং জীবনের নতুন স্রোতের সূচনা ঘটে সেখান থেকে।

আয়ুষ্কাল নির্ভর করে এর প্রজাতির ওপর। যেমন বিস্ট্রল পাইন প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে বাঁচতে পারে।
ভিন্ন গাছ, ভিন্ন আয়ুষ্কাল

ভিন্ন গাছ, ভিন্ন আয়ুষ্কাল

অবিশ্বাস্য রকম লম্বা সময় ধরে বাঁচতে পারে গাছ। আয়ুষ্কাল নির্ভর করে এর প্রজাতির ওপর। যেমন বিস্ট্রল পাইন প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে বাঁচতে পারে। অন্যদিকে লজারপোল বা পপলার ধরনের গাছগুলো বাঁচে অনেক কম সময়। ২০ থেকে ২০০ বছরের মতো। আমাদের আশেপাশে, অর্থাৎ যেসব গাছ শহর বা জনপদে জন্মায়, সেগুলোর বেশিরভাগ এরকম সময় বাঁচে।

হয়তো খেয়াল করেছেন, ভিন্ন ভিন্ন জীবের আয়ুষ্কালও ভিন্ন। যেমন বিড়ালের চেয়ে হ্যামস্টার (ইঁদুরের মতো একধরনের প্রাণী) অনেক কম দিন বাঁচে। আবার বিড়ালের আয়ু মানুষের চেয়ে অনেক অনেক কম। শুধু মানুষের কথাই যদি ভাবি, পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষের গড় আয়ুও এক নয়। গাছের ক্ষেত্রেও একই বিষয়। এদের আয়ুষ্কাল নির্ধারিত হয় ডিএনএ-র ওপর ভিত্তি করে। ডিএনএ হলো জীবনের নীলনকশা। এতে লেখা থাকে, একটি জীব কেমন হবে, তার খুঁটিনাটি সব। সে অনুযায়ী অনেক গাছ বেড়ে ওঠে ধীরে। আবার অনেক গাছ দ্রুত বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদের চেয়ে ধীরে বাড়তে থাকা উদ্ভিদ বেশি শক্ত হয়। বাঁচেও বেশিদিন।

বেঁচে থাকার অর্থ, মৃত্যু সুনিশ্চিত। তাই বেশিদিন বাঁচতে পারে, এমন গাছও একসময় বৃদ্ধ হয়। মারা যায়। তা ছাড়া, পোকামাকড়ের আক্রমণে বছরের পর বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্থ হয় গাছ। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবেও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। গাছের একটি ডাল বা পাতা রোগাক্রান্ত হলে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো গাছে। একসময় ভেঙে পড়ে পুষ্টি ও পানি পরিবহন ব্যবস্থা। মারা যায় গাছ। মৃত্যুর এ প্রক্রিয়া অনেক ধীর হওয়ায় আমাদের কাছে সেটা বেশিরভাগ সময়েই দৃশ্যমান হয় না। অনেকে গাছ বা উদ্ভিদের মৃত্যুকে ভাবেন পরোক্ষ কোনো প্রক্রিয়া। সেটা আসলে আমাদের ভাবনার ধরনের জন্য। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল। গাছের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি না বলেই হয়তো এমনটা মনে হয় আমাদের। আসলে, গাছ রোগাক্রান্ত হয়, ধীরে ধীরে অসহায়ভাবে মারা যায়। এই সবটা ঘটে গাছের দেহে। সেজন্য আমাদের মনে না হলেও, গাছের জন্য পুরো বিষয়টি বেশ সক্রিয়—তার ভেতরেই ঘটে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

ভূ-গর্ভস্থ নেটওয়ার্ক

গাছ মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে শেকড়ের সাহায্যে। শেকড়ের কাজ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মাটির নিচে এর গায়ে লেগে থাকে আণুবীক্ষণিক ছত্রাক। এরা আবার বংশবৃদ্ধি করে। লেগে থাকে গায়ে গায়ে। দেখলে মনে হবে যেন শেকড়ের মাঝেই দ্বিতীয় আরেকটি শেকড় ব্যবস্থা।

ছত্রাকের দীর্ঘ গঠনকে বলা হয় হাইফি। গাছের মূল শেকড়ের চেয়ে এই হাইফি মাটির নিচে আরও অনেক দূর ছড়িয়ে থাকে। শুনতে পরজীবীর মতো শোনালেও ছত্রাকের এই নেটওয়ার্ক উল্টো গাছের উপকার করে। মাটি থেকে পুষ্টি শোষণ করে পৌঁছে দেয় শেকড়ে। বিনিময়ে গাছ এসব ছত্রাককে চিনির যোগান দেয়। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এ চিনি তৈরি হয় গাছের পাতায়।

ছত্রাক শুধু যে নির্দিষ্ট গাছকে পুষ্টি সরবরাহ করে, তা কিন্তু নয়। একাধিক গাছের মাঝে পুষ্টি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। কাজটা ঠিক কীভাবে করে, বিজ্ঞানীরা সেটা জানার চেষ্টা করছেন। কিছু গাছ অন্য গাছের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। অনেকে মজা করে এই ব্যবস্থাকে www বা উড ওয়াইড নেটওয়ার্ক বলেন। এ নেটওয়ার্ক ঠিক কীভাবে কাজ করে, তা এখনও বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি বোঝেন না। তবে জানেন যে ছত্রাকের এ নেটওয়ার্ক গাছের সুস্থ থাকার জন্য জরুরী।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরেও অন্যদের কাজে লাগে গাছ

মৃত্যুর পরেও অন্যদের কাজে লাগে গাছ

গাছ মারা যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এ সময় গাছের মরা কাণ্ড কাজ করে মৌমাছি, কাঠবিড়ালী, পেঁচা এবং আরও অনেক প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে। একটা সময় গাছের কাণ্ড মাটিতে পড়ে যায়। শুরু হয় নতুন আরেক যাত্রা।

মাটিতে পড়ে থাকা গাছের কাণ্ড আশ্রয় হয় বেজি ও সরীসৃপ শ্রেণির নানা প্রাণীর। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের মতো মৃতভোজী প্রাণীদের কলোনি তৈরি হয় এ কাণ্ডকে ঘিরে। এসব অণুজীব ধীরে ধীরে গাছের কাণ্ড ভেঙে ফেলে। এত নিখুঁত ভাবে এরা গাছের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয় যে পরবর্তীতে বোঝার উপায় থাকে না সেখানে আদৌ কোনো গাছের অস্তিত্ব ছিল। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে এই প্রক্রিয়ার জন্য কয়েক বছর থেকে শতাব্দীকাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। গাছের কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়লে এর উপাদানগুলো পুষ্টি আকারে মিশে যায় মাটিতে। পরে আবার অন্য গাছ এসব পুষ্টি গ্রহণ করে বড় হয়। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে গাছ মারা যাওয়ার সময় উত্তরাধিকারী রেখে যায়। জীবিত থাকার সময় যেমন প্রাণী ও অন্যান্য উদ্ভিদের খাদ্যের যোগান ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, মারা যাওয়ার পরও সেটা বন্ধ হয় না। নতুন গাছের পুষ্টি যুগিয়ে তৈরি করে প্রাণী, ছত্রাক বা উদ্ভিদের নতুন আবাসস্থল।

লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: দ্য কনভারসেশন, উইকিপিডিয়া