প্রচণ্ড গরমে দিনের বেলায় দরকার বৈদ্যুতিক পাখা, রাতে আবার বৈদ্যুতিক আলো। এ দুইয়ের জন্যই দরকার বিদ্যুৎ। রান্নার জন্য দরকার কাঠ বা গ্যাস, যা থেকে পাওয়া যাবে তাপ। বিদ্যুৎ বা তাপশক্তি পেতে হলে প্রয়োজন জ্বালানি, হোক তা কাঠ, তেল, গ্যাস বা কয়লা। বনাঞ্চল বা খনির মতো উৎস থেকে এসব জ্বালানি সংগ্রহ করতে হয়। উৎস শেষ হয়ে গেলে জ্বালানিও শেষ। তাই এগুলোকে বলা হয় অনবায়নযোগ্য জ্বালানি। আরেক ধরনের শক্তি বা জ্বালানি আছে, যেগুলো দূরতম সময়ে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এগুলোকে বলা হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি। যেমন সূর্যের আলো বা বায়ুপ্রবাহ। এমন আরও কিছু জ্বালানি হলো সাগরের ঢেউ, বৃষ্টিপাত, জলের স্রোত ও পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ। কেউ কেউ মনে করেন, গৃহস্থালি ও নগরবর্জ্য ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের পদ্ধতিগুলোও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে ফেলা উচিত।
জ্বালানি কাঠ বাদ দিলে আমাদের দেশে মূলত পেট্রলজাতীয় (Petroleum) তরল জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। যেমন কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি), তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), তরলায়িত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ইত্যাদি। এর বাইরে বিদ্যুৎ উৎপাদন, ইটভাটা ও ইস্পাতশিল্পে কয়লা ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে বলা হয় জীবাশ্ম জ্বালানি। বিদ্যুৎ উৎপাদন, গাড়ি, সেচপাম্প ও শিল্পকারখানা চালাতে বছরে ১৪ লাখ টন পেট্রলজাতীয় জ্বালানি এবং ১.১ কোটি টন কয়লা দরকার হয়। পেট্রোলিয়ামের ৩.৬ শতাংশ ও কয়লার মাত্র ১০ শতাংশ আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এর বাইরে বছরে ৭৬ লাখ টন এলএনজিও আমদানি করা হয়। এসব জ্বালানি আমদানিতে বছরে ৩৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়।
জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য শুধু যে টাকা খরচ হয়, তা-ই নয়, এসব জ্বালানি ভীষণ পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে। এক ইউনিট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোটামুটি এক কেজি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, আমাদের দেশে প্রতিবছর ৮.১ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, যার ৪.১ কোটি টনই নির্গমন হয় বিদ্যুৎ খাত থেকে। আমরা সবাই জানি, মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে জলবায়ু দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ যে পৃথিবীর সবচেয়ে জলবায়ু বিপদাপন্ন দেশগুলোর অন্যতম, এটা সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে নিয়েছেন। এখন পৃথিবীতে মানবসভ্যতা বাঁচাতে হলে ব্যাপকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বাদ দিয়ে কীভাবে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে আলবেনিয়া, কঙ্গো, আইসল্যান্ড, প্যারাগুয়েতে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া নামিবিয়া, কোস্টারিকা, নরওয়ে, তাজিকিস্তান, উরুগুয়ে ও জাম্বিয়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার ৯৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের হার এখনো ৪ শতাংশের কম। কিন্তু বাংলাদেশ কেন পারবে না শতভাগের লক্ষ্য অর্জন করতে? এরই মধ্যে আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি যে ছোট্ট একটা উন্নয়নশীল দেশ হয়েও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। আমরা ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, তৈরি পোশাক ও পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ হতে পারি। তাহলে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনেও আমরা প্রথম হতে পারব।
কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে আমাদের দেশে কতগুলো ভুল ধারণা বা নেতিবাচক প্রচারণাই আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে।
অনেকে বলেন, আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে ৬০ লাখের বেশি বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল আছে, যা দুই কোটি মানুষকে আলো দিচ্ছে। এর বাইরে ৭টি ছোট-বড় সৌরপার্ক থেকে জাতীয় গ্রিডে ১৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৬০০–এর বেশি সৌরভিত্তিক সেচপাম্প উৎপাদন করছে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা হবে মোটামুটি ৬০ হাজার মেগাওয়াট।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ল্যাবরেটরি (NREL) আমাদের দেশে হিসাব করে দেখিয়েছে, ৮০-১২০ মিটার বা ২৪-৩৬ তলা উঁচু স্তম্ভের ওপর বায়ুকল বসালে বাতাসের প্রবাহ ব্যবহার করেই আমরা ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সোলার্জিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সৌরবিদ্যুতের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রতি বর্গমিটারে ঘণ্টায় ৩.৮ থেকে ৪.৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষের (SREDA) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘খসড়া জাতীয় সৌরশক্তি কর্মপরিকল্পনা ২০২১’ অনুসারে বাংলাদেশে ২৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শুধু সৌরশক্তি থেকে উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ গবেষকের মতে, এ প্রাক্কলন অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা কমপক্ষে এর দ্বিগুণ।
বলা হয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে যত ভূমি দরকার, তা বাংলাদেশে নেই। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছে। আমাদের দেশে অকৃষি খাসজমির পরিমাণ ১৮ লাখ একর। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য অকৃষি খাসজমি ১০ লাখ একর। সম্প্রতি বাংলাদেশে তিনটি বড় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোকে সৌরপার্ক (Solar Park) বলা হয়। এসব সৌরপার্কে প্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন একর জমিতে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। আমরা যদি দেশের অকৃষি খাসজমির অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারি, তাহলে শুধু সৌরবিদ্যুৎ থেকে আমাদের দেশে ১ লাখ ৪২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে। এ ছাড়া ২ কোটি ১১ লাখ কৃষিজমি রয়েছে। সমন্বিত কৃষি-সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তি গ্রহণ করলে কৃষিজমি থেকেই ১ লাখ মেগাওয়াটের বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, এর দাম। মনে রাখা দরকার যে সৌরবিদ্যুতের দাম অন্য যেকোনো বিদ্যুতের তুলনায় দ্রুত কমে আসছে। ২০১৫ সালে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম ছিল গড়ে ১৮ টাকা। মাত্র ৫ বছরের মধ্যে ৩৯ শতাংশ কমে এখন তার দাম ১১ টাকা। ভারতে ২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছিল ১৫ টাকা। গত এক দশকে ৮৪ শতাংশ কমে এখন ২ টাকা ৩৬ পয়সায় নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ ১ টাকা ৯০ পয়সায় পাওয়া যাবে। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বাড়ছে প্রতিবছর। ডিজেলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২৩ থেকে ৬৭ টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে।
তৃতীয় অভিযোগ হলো, এর সংরক্ষণ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবহার করতে হয়। কারণ, বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করার প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে সন্ধ্যার পরে। যুক্তি দেখানো হয়, সৌরবিদ্যুৎ রাতে উৎপাদন করা যায় না। তাই বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না এটা। তবে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের প্রযুক্তি খুব দ্রুত উন্নতি লাভ করছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় এমন একটি ব্যাটারি স্থাপন করা হয়েছে, যা দিয়ে ১২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংরক্ষণ সম্ভব। ২০১০ সালে যেখানে ১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সংরক্ষণের ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি কিনতে ৮৩ হাজার টাকা দরকার হতো, এখন তা পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে ৮ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ১ দশকে ব্যাটারির দাম ৯০ শতাংশ কমে গেছে।
চতুর্থ অভিযোগ হলো, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ অত্যন্ত বেশি। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যায়, নগদ টাকার হিসাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে খরচ সামান্য বেশি হলেও স্থানীয় পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর এর প্রভাব হিসাব করলে এ ব্যয় অত্যন্ত কম। বর্তমানে ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ফার্নেস অয়েল, গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের গড় খরচ যথাক্রমে ১০ কোটি ৫২ লাখ, ১২ কোটি ৬২ লাখ ও ১২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। অন্যদিকে প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জমির মূল্যসহ গড় খরচ ১৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। একটি ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে কয়লার তুলনায় ২৩ কোটি টাকা বেশি খরচ হবে। কিন্তু কয়লাবিদ্যুতের ফ্লাই অ্যাশ, সিসা, পারদ, সালফার ও ক্যাডমিয়ামের দূষণ থেকে বেঁচে যাবে আশপাশের ফসল ও জনসাধারণ। তাই প্রাথমিকভাবে খরচ বেশি হলেও আখেরে সৌরবিদ্যুৎই লাভজনক।
পঞ্চম অভিযোগ, বর্ষাকালে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না। আকাশ মেঘলা হলে সূর্যের বিকিরণ কমে যায়, তবে বন্ধ হয়ে যায় না। তাই বর্ষাকালেও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তবে তা ৬০ শতাংশে নেমে যেতে পারে। সোলার্জিসের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে ৩০০ দিন চালু রাখা যাবে। বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চলতে পারে বছরে ২৯০ দিন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় দুর্ঘটনার কারণে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলেও ব্যাটারি দিয়ে সীমিত আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব।
ষষ্ঠ অভিযোগটি সাধারণত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন। অভিযোগটি হলো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ভিত্তিবিদ্যুৎ (Baseload) সরবরাহ করা যাবে না। দেশের গড় সর্বনিম্ন বিদ্যুৎ চাহিদাকে বেসলোড বলা হয়। তবে সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বর্জ্যবিদ্যুৎ, স্রোতবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে ব্যাটারির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অস্ট্রেলিয়া, আলবেনিয়া, আইসল্যান্ডসহ বহু দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকেই বেসলোড সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি দুনিয়াব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের কারণে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করা সময়ের ব্যাপারমাত্র। তারপরও শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করার দিকে যেতে পারছি না কেন? সে ক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে আমাদের জাতীয় আইনকানুন, নীতিমালা ও কার্যক্রমে। সবচেয়ে বড় সমস্যা সম্ভবত অর্থায়ন। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা ও দেশীয় বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায়। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ বিদেশি অর্থায়নের শর্ত দেওয়া হয়। নতুন বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে এ ধরনের শর্ত একটি প্রধান বাধারূপে হাজির হয়। তাই সবার আগে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অর্থায়নের শর্তাবলি দূর করা দরকার। পাশাপাশি দরকার বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সহজ শর্তের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, যাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয় থেকেই ঋণ শোধ করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি জাতিসংঘের পরিচ্ছন্ন উন্নয়ন ব্যবস্থা (সিডিএম) থেকে গ্রিনহাউস নির্গমন কমানোর জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা দরকার। বর্তমানে মিনিগ্রিড (সমাজভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র) স্থাপনের জন্য ৫০ শতাংশ অনুদান দেওয়া হচ্ছে। বৃহৎ আকারের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কমপক্ষে ২০ শতাংশ অনুদান দেওয়া দরকার।
সরকার জীবাশ্মভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না নিলে উৎপাদনক্ষমতার কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিয়ে থাকে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দ্বিতীয় বড় বাধা পর্যাপ্ত ভূমির ব্যবস্থা করা। কৃষিভিত্তিক দেশ বিধায় বাংলাদেশে বড় আকারের ভূমিপ্রাপ্তি সত্যিকার অর্থেই কঠিন। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য খাসজমি চিহ্নিতকরণ, দখলমুক্ত করা ও বরাদ্দ দেওয়ার দায়িত্বটি সরকারেরই গ্রহণ করতে হবে। ভূমির দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করার কারণেই ভারতে সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট মাত্র ২.৩৬ রুপি করা সম্ভব হয়েছে। কৃষিভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ হতে পারে জমিসংকটের আরেকটি জুতসই সমাধান।
বিদ্যুৎ শুধু উৎপাদন করলেই চলে না; বরং তা ব্যবহারের জন্য বাড়ি বা কারখানা পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। এ জন্য দরকার হয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের নেটওয়ার্ক। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের তরঙ্গ এবং সৌরপার্কে উৎপাদিত বিদ্যুতের তরঙ্গের মাত্রা এক নয়। তাই সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য দরকার এমন গ্রিড, যা একাধিক মাত্রার তরঙ্গ গ্রহণ ও সঞ্চালন করতে পারে। একে বলা হয় স্মার্ট গ্রিড। বাংলাদেশের মোট গ্রিডের মাত্র ১২ শতাংশ স্মার্ট গ্রিডে রূপান্তর করা হয়েছে। স্মার্ট গ্রিড না হলে শতভাগ সৌরবিদ্যুৎ গ্রহণ ও বিতরণ করা সম্ভব হবে না।
জীবাশ্মভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক করের আওতামুক্ত। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ সুযোগ মাত্র পাঁচ বছরের জন্য। সরকার জীবাশ্মভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না নিলে উৎপাদনক্ষমতার কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিয়ে থাকে। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না নিলে কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না। এ বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর (VAT) ও অন্যান্য করও বাতিল করা দরকার।
অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা একটি বড় সংকট। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে পরিবেশগত ছাড়পত্রসহ ৪০টি দপ্তর থেকে অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়, যা শুধু সময়ক্ষেপণই করে না; বরং প্রকল্পের খরচ বাড়ায় এবং বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহী করে তোলে। রপ্তানিমূলক শিল্পের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেও ‘এক কার্যালয়ে সব সেবা’ বা ওয়ান–স্টপ সেন্টার তৈরি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্রেডা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে স্রেডা সর্বোচ্চ ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দিতে পারে। স্রেডার দায়িত্ব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা একান্ত আবশ্যক।
অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা একটি বড় সংকট। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া টারবাইন, মডিউল, ব্যাটারি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরির জন্যও দেশের অভ্যন্তরেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার।
তবে সবার আগে দরকার আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ও মুজিব বর্ষে সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণ করা দরকার। আর দরকার দেশীয় দৃষ্টিভঙ্গি। জ্বালানিবিষয়ক মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হতে হবে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সুবিদিত দেশি বিশেষজ্ঞ, যাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের দেশের জলবায়ু, ভূমি, নদী, বন, কৃষি, মানুষ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার ভাবনা মাথায় নিয়ে একটি বাস্তবভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন, যা পরিবেশসম্মত, সস্তা ও জনবান্ধব।
লেখক:
হাসান মেহেদী, প্রধান নির্বাহী, উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্ম জোট (ক্লিন)
ফারজানা আক্তার, গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন