ফোন বা টিভির নীল আলো চোখ, ঘুম ও স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর

আমাদের জীবন এখন আধুনিক। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন—এগুলো আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত এই ডিভাইসগুলো আমাদের সঙ্গী। সারাদিন আমাদের চোখ পড়ে থাকে স্ক্রিনে। আপনি নিজেও এই মুহূর্তে এরকমই কোনো স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন। এই স্ক্রিন থেকে নির্গত হয় ক্ষতিকর নীল আলো (Blue Light)। দিনের পর দিন এই নীল আলো আমাদের চোখের কতটা ক্ষতি করছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। আমরা যদি এর ভয়াবহতা জানতাম, তাহলে হয়তো এত বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম না। যুক্তরাষ্ট্রের ইউসি ডেভিস আই সেন্টারের প্রধান চক্ষু বিশেষজ্ঞ মেলিসা বার্নেট চোখ ও স্বাস্থ্যের ওপর এই নীল আলোর প্রভাব সম্পর্কে জানিয়েছেন।

আমাদের চারপাশে বিভিন্ন রঙের আলো আছে। যেমন লাল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি। এই সব রং মিলেই তৈরি হয় দৃশ্যমান আলোক বর্ণালি। নীল আলো এই বর্ণালির একটি অংশ। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৩৮০ থেকে ৫০০ ন্যানোমিটার (nm)। সাধারণত যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম হয়, তার শক্তি হয় তত বেশি। নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হওয়ায় এটি সবচেয়ে শক্তিশালী আলোগুলোর একটি। সব দৃশ্যমান আলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে নীল আলো হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সূর্যের আলো নীল আলোর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক উৎস। এ ছাড়া নীল আলোর কৃত্রিম উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্লুরোসেন্টের আলো, এলইডি টিভি, কম্পিউটার মনিটর, স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট স্ক্রিন।

পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভিশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান প্রতিদিন দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ডিভাইস ব্যবহার করেন। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ একই সময়ে দুটি বা তারও বেশি ডিভাইস ব্যবহার করেন।

নীল আলো আমাদের বেশ কিছু কাজে আসে। দিনের বেলায় নীল আলো আমাদের মস্তিষ্কের জন্য উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এটি মনোযোগ বাড়ায়, ফলে আমরা আরও সতর্ক থাকি। এর প্রভাবে স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিষ্কের সামগ্রিক কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় দিনের বেলায় নীল আলোর সংস্পর্শে এলে আমাদের মেজাজও ফুরফুরে থাকে। আমাদের দেহে একটি প্রাকৃতিক ঘড়ি আছে, যা নিয়ন্ত্রণ করে আমরা কখন ঘুমাব এবং কখন জেগে থাকব। একে সার্কেডিয়ান রিদম বা চক্র বলে। নীল আলো এই ঘড়িকে সক্রিয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় থাকা নীল আলো আমাদের মস্তিষ্ককে বার্তা দেয়, এখন জেগে থাকার সময়। সূর্যের আলোয় যে নীল আলো থাকে, তা শিশুদের চোখের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন

সূর্যের আলোয় প্রচুর নীল আলো থাকলেও, বেশির ভাগ সময় আমরা অল্প সময়ের জন্য সরাসরি সূর্যের সংস্পর্শে থাকি। দীর্ঘ সময় সূর্যের আলো সরাসরি চোখে পড়লে সেটাও ক্ষতিকর হতো, তবে সময় স্বল্পতার জন্য তা হয় না। কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। যদিও কোনো স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলোর পরিমাণ সূর্যের আলোর চেয়ে অনেক কম, তবু আমরা দীর্ঘ সময় ধরে এই স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। বিশেষ করে যখন স্ক্রিন টাইম খুব বেশি হয় এবং আমরা স্ক্রিনের খুব কাছ থেকে দেখি বা তাকিয়ে থাকি, তখন এই নীল আলোর প্রভাব হয় দীর্ঘমেয়াদী। এটা এখন গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভিশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান প্রতিদিন দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ডিভাইস ব্যবহার করেন। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ একই সময়ে দুটি বা তারও বেশি ডিভাইস ব্যবহার করেন। যেমন টিভি দেখতে দেখতে স্মার্টফোন ব্যবহার করা। এই ব্যাপক ব্যবহারের ফলে ৫৯ শতাংশ আমেরিকানদের মধ্যে ‘ডিজিটাল আই স্ট্রেন’ বা চোখের ওপর চাপজনিত লক্ষ্মণ দেখা যায়। ডাক্তারি ভাষায় একে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম (সিভিএস) বলে।

নীল আলো আমাদের বেশ কিছু কাজে আসে। দিনের বেলায় নীল আলো আমাদের মস্তিষ্কের জন্য উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এটি মনোযোগ বাড়ায়, ফলে আমরা আরও সতর্ক থাকি। এর প্রভাবে স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিষ্কের সামগ্রিক কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়।

আমাদের চোখ নীল আলো আটকাতে খুব একটা দক্ষ নয়। চোখের সামনের অংশ কর্নিয়া এবং লেন্স প্রায় সব দৃশ্যমান নীল আলোকেই ভেদ করে যেতে দেয়। ফলে এই উচ্চ শক্তির নীল আলো সরাসরি রেটিনায় পৌঁছায়। রেটিনা হলো চোখের পেছনের একটি সংবেদনশীল স্তর, যেখানে আলোক-সংবেদী কোষগুলো আলোকে মস্তিষ্কের বোঝার মতো ছবিতে রূপান্তরিত করে।

দীর্ঘ সময় ধরে এই নীল আলোর সংস্পর্শে আসার কারণে রেটিনার কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে কিছু গুরুতর চোখের সমস্যা তৈরি হয়। এটি ছানি, চোখের ক্যান্সার এবং চোখের সাদা অংশের ওপর আবরণ তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আই ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা অনুসারে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের নীল আলোতে চোখের ক্ষতির বেশি হয়। এর কারণ হলো, শিশুদের চোখের লেন্স এবং কর্নিয়া আরও বেশি স্বচ্ছ থাকে, ফলে ডিভাইস থেকে আসা নীল আলো তাদের রেটিনায় আরও বেশি পরিমাণে যায়।

আরও পড়ুন

ডিভাইস ব্যবহার করার সময় আমরা সাধারণত কম পলক ফেলি। স্বাভাবিকের চেয়ে কম পলক ফেলার কারণে চোখ শুষ্ক হয়ে যায় এবং শুষ্ক চোখের সমস্যা ‘ড্রাই আইজ’ দেখা দেয়। এতেও চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এ চাপের কারণে মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা ইত্যাদি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভিশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ থেকে ৩৫ শতাংশ আমেরিকান ডিভাইস ব্যবহারের পর এই লক্ষণগুলোর অন্তত একটি অনুভব করার কথা জানিয়েছেন।

আমাদের শরীর প্রাকৃতিকভাবে একটি হরমোন তৈরি করে, যার নাম মেলাটোনিন (Melatonin)। এই মেলাটোনিনই আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। দিনের আলো কমে এলে বা অন্ধকার হলে আমাদের শরীর বেশি মেলাটোনিন তৈরি করে, ফলে আমাদের ঘুম পায়। কিন্তু ঘুমানোর আগে যদি ফোন, ট্যাব, কম্পিউটার বা টিভির স্ক্রিন দেখি তাহলে আমাদের শরীর মনে করে, দিন হয়তো এখনো শেষ হয়নি। এর ফলে মেলাটোনিন তৈরির প্রক্রিয়া কমিয়ে দেয়। পর্যাপ্ত মেলাটোনিন তৈরি না হলে আমাদের ঘুম আসতে দেরি হয়, ঘুম ভালো হয় না। ঘুমচক্রের এই ব্যাঘাতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো নানা রোগ হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের চোখের ওপর আলোক দূষণের প্রভাবও অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

আমেরিকান সোসাইটি অব অপথালমোলজির সূত্র অনুসারে, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং চোখের সমস্যায় ভুগছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক হলেও এই আলোই যে দায়ী, তার প্রত্যক্ষ শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অনেকে নীল আলোর প্রভাব কমাতে বিশেষ চশমা ব্যবহার করেন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নীল আলোর অতিরিক্ত সংস্পর্শের কারণে চোখের ওপর যে চাপ তৈরি হয়, এই চশমা তা কমাতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। তবে স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ট্যাব দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার না কমালে এই সমস্যা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব চশমার লেন্স নীল আলো ফিল্টার করে, সেগুলো নীল আলোর ক্ষতিকর প্রভাব ১০ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় স্ক্রিন দেখার সময় হলুদ রঙের লেন্সযুক্ত চশমা ব্যবহারে চোখ কিছুটা আরাম পায়।

মুঠোফোনের নীল আলো আমাদের শরীরে মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরিত হতে বাধা দেয়

বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল আই স্ট্রেন কমানোর জন্য একটি জনপ্রিয় এবং কার্যকর পদ্ধতি মেনে চলতে বলেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ২০-২০-২০। প্রতি ২০ মিনিটে, ২০ ফুট দূরে থাকা কোনো বস্তুর দিকে ২০ সেকেন্ডের জন্য তাকাতে বলা হয় এ পদ্ধতিতে। এটি চোখের ফোকাস পরিবর্তনে কার্যকর। এতে চোখের ওপর টানা চাপ পড়ে না। চোখ খানিকটা বিরতি পায়।

তবে অনেক গবেষক বলেন, নীল আলো বা স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার সঙ্গে চোখের ক্ষতি হওয়ার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। আমেরিকান সোসাইটি অব অপথালমোলজির সূত্র অনুসারে, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং চোখের সমস্যায় ভুগছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক হলেও এই আলোই যে দায়ী, তার প্রত্যক্ষ শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদের মতে, শুধু স্ক্রিন নয়, যেকোনো কিছুতে দীর্ঘক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকাটা চোখের ওপর চাপ ফেলে। তাই ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চললে ভালো।

চোখের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা এবং ডাক্তার দেখানো উচিত। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার ডাক্তার দেখানো ভালো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: হেলথ ডট ইউসি ডেভিস আই, স্ট্রেইটটাইমস 

আরও পড়ুন