সহস্র ধারায় ছোটে দুরন্তজীবন নির্ঝরিণী
মরণের বাজায়ে কিঙ্কিণী
—রবীন্দ্রনাথ
পাশাপাশি দুটি ঘর। মশা আটকানোর জন্য দরজা-জানালায় শক্ত তারের জাল আঁটা। প্রথম ঘরটি স্যাঁতসেঁতে, আলো-হাওয়া খেলার জন্য সেখানে যথেষ্ট দরজা-জানালা নেই। কিন্তু দ্বিতীয়টির ব্যবস্থা একেবারে উল্টো—জানালা অনেক, ভেতর ঝকঝকে, হাওয়া অঢেল। দুঘরেই বিছানা পাতা এবং কজন করে লোক। প্রথম ঘরটির বিছানাপত্র বহুব্যবহারে মলিন, কিন্তু দ্বিতীয় ঘরের বিছানায় নতুন পাটভাঙা কাপড়, সবকিছুই ধবধবে।
ঘটনাস্থল কিউবা দ্বীপ। ১৯০০ সাল। রাত্রিকাল।
সবাই শুয়ে আছেন, কিন্তু কারও চোখেই ঘুম নেই। ঘুমানো অসম্ভব। বাইরে মহামারির তাণ্ডব চলছে। লোক মরে মরে গোটা অঞ্চল প্রায় জনশূন্য। সবাই গাঁ-গঞ্জ ছেড়ে পালাচ্ছে। সর্বত্র দুর্গন্ধ, আবর্জনা, গলিত লাশ।
কারও মুখে কথা নেই। বাইরে রাত্রি যেন মৃত্যুভয়ে নিস্পন্দ। কোনো শব্দ শোনা যায় না। পাশের জলাভূমি থেকে পচা-ওঠা বাষ্পে ভারী বাতাস বারবার জানালা ছুঁয়ে যাচ্ছে এবং অশ্রান্ত গুঞ্জনে মশা তাদের ভয়ংকর অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। অদূর অরণ্য যেন অবশিষ্ট এই কটি প্রাণের জন্য অপেক্ষারত লোলুপ যমদূত।
দ্বিতীয় ঘরের একটি লোককে মশায় কামড়াল।
চিত্কার করে উঠল সে যেন অপেক্ষারত মৃত্যুর দীর্ঘ হাত জানালা গলিয়ে তাকে স্পর্শ করল।
১৮৬৫ সালের আগে জীবাণুই যে এসব রোগের কারণ তা কেউ জানত না। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ও সহযোগীরা প্রথম প্রমাণ করেন যে জীবাণুই সংক্রামক রোগের কারণ এবং ফলত চিকিত্সাবিজ্ঞানে ঘটল রীতিমতো বিপ্লব।
তারপর আবার সব চুপচাপ, এমনটি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কেউ বিছানা ছেড়ে উঠল না, মশা তাড়ানোর চেষ্টা করল না, পাশের ঘরের লোকজনদের খবর নিল না। পুরো ব্যাপারটিই একটি পরীক্ষা। অত্যন্ত মারাত্মক, বিপজ্জনক পরীক্ষা। রীতিমতো মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা। যে মহামারির কথা আগে বলা হয়েছে, সে জন্যই এই আয়োজন।
কিউবায় পীতজ্বরের তাণ্ডব চলছে। লোক মরছে। প্রথমে জ্বর ও গায়ে ব্যথা, পরে শরীর হলুদ হয়ে যাওয়া এবং শেষে সংজ্ঞালোপ ও মৃত্যু। এই হলো পীতজ্বর।
রোগটি অবশ্য এখানে নতুন নয়, পশ্চিম গোলার্ধের উষ্ণমণ্ডলে এর প্রকোপ বহুদিনের। পীতজ্বরের মহামারীর জন্যই আফ্রিকার কুখ্যাত পশ্চিম উপকূল শ্বেতাঙ্গদের কবরভূমি নামে কুখ্যাত। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এবং কাছাকাছি অঞ্চলে এটি একমাত্র ত্রাস।
ইউরোপে রোগটি আনেন কলম্বাস। তিনি ইউরোপের জন্য বিপুল সম্পদের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন সত্যি, কিন্তু একই সঙ্গে আনেন অনেক নতুন মারাত্মক ব্যাধিও, পীতজ্বর তারই একটি। সংক্রামক রোগ যাতে ছড়াতে না পারে সে জন্য ইউরোপের বন্দরে বন্দরে তখন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ফরাসি বিপ্লবের চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগে পীতজ্বর ইউরোপে ঢুকে পড়ে এবং লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে নেয়।
১৮০১ সালে নেপোলিয়ান হাইতি দ্বীপে নিগ্রো-বিদ্রোহ দমনের জন্য ২ হাজার ৫০০ সৈন্য পাঠান। যুদ্ধে সহজে জয়ী হলেও দেশে ফেরে মাত্র ৩০০ জন। একই কারণে উনিশ শতকের শেষে ফরাসিদের পানামা খাল কাটার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এই আবহাওয়ায় অনভ্যস্ত শ্বেতাঙ্গরাই এই রোগের সহজ শিকার হতো।
অথচ করণীয় কিছুই ছিল না। ১৮৬৫ সালের আগে জীবাণুই যে এসব রোগের কারণ তা কেউ জানত না। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ও সহযোগীরা প্রথম প্রমাণ করেন যে জীবাণুই সংক্রামক রোগের কারণ এবং ফলত চিকিত্সাবিজ্ঞানে ঘটল রীতিমতো বিপ্লব। ক্রমে ক্রমে আবিষ্কৃত হলো কলেরা, যক্ষ্মা প্রভৃতি রোগের জীবাণু ও উন্নত চিকিত্সাপদ্ধতি।
তাই ১৯০০ সালে কিউবায় স্পেনীয়দের সঙ্গে যুদ্ধরত আমেরিকান সৈন্যদের মধ্যে পীতজ্বর দেখা দিলে রোগের কারণ জানার চেষ্টা শুরু হয়। কাজের ভার নেন ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কারক বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার রনাল্ড র্যাস। একটি ডাক্তারদলের নেতা হয়ে এলেন কিউবায়। রোগটি সম্পর্কে তখন নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন সংক্রমণ ঘটে রোগীর মলমূত্র-ঘামের ছোঁয়া থেকে, অন্যেরা বলেন ছোঁয়াচে নয় মোটেও, আসলে একধরনের মশা পীতজ্বর ছড়ায়।
তাই এই পরীক্ষার আয়োজন। প্রথম ঘরে যেসব স্বেচ্ছাসেবী শুয়েছিল তাদের বিছানাপত্র পীতজ্বরে মৃত রোগীদের কাছ থেকে আনা। তারা অনেকে আবার এসব রোগীর পাজামাও পরেছিলেন। আর দ্বিতীয় ঘরে রোগ ছড়াতে পারে এমন কিছুই ছিল না, শুধু ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল রুপালি ডোরা-কাটা কিছু মশা, যারা নাকি পীতজ্বরের বাহন।
এদের সবচেয়ে ছোট জীবাণুটির আয়তন ১ মিউ অর্থাৎ ১ মিলিমিটারের ১০০০ ভাগের ১ ভাগ। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে যেকোনো কিছু দুই হাজার গুণ বড় করে দেখা যায়। সুতরাং সবচেয়ে ছোট জীবাণুটিকেও তাতে ২ মিলিমিটারের সমান বড় দেখাবে।
সন্দেহ নেই বীভত্স পরীক্ষা। রীতিমতো জীবন নিয়ে খেলা। কিন্তু সেকালে এ ছাড়া অন্য পথও ছিল না। আজকাল এ ধরনের পরীক্ষায় বাঁদর, খরগোশ, গিনিপিগ ব্যবহার করা হয়। তখন এসব কেউ জানত না। তাই মানুষের প্রয়োজন হতো। ডাকা হলো স্বেচ্ছাসেবক, যারা মানবজাতির কল্যাণের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। এই গবেষণায় বহুবার মানুষের প্রয়োজন হয়েছে, কখনো স্বেচ্ছাসেবকের অভাব হয়নি। অনেকে রোগ থেকে বেঁচে উঠেছেন, অনেকে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছেন। শেষে জানা গেল যে একধরনের বাঁদরের দেহে সংক্রমণ ঘটানো সম্ভব এবং তখনই মানুষ নিয়ে পরীক্ষা বন্ধ হলো। অবশ্য তা অনেক পরের কথা।
আমরা আপাতত আবার এই প্রথম পরীক্ষায় ফিরে যাই, যেখানে এক জলাভূমির পাশে দুটি ঘরে কজন লোক মৃত্যুর অপেক্ষায় বিনিদ্র রাত্রি কাটাচ্ছিলেন। প্রথম ঘরে যাঁরা ছিলেন শেষ পর্যন্ত তাঁদের কারও পীতজ্বর হলো না। কিন্তু দ্বিতীয় ঘরে ছেড়ে দেওয়া মশারাই যে বাহন, সেটা প্রমাণিত হলো। ঘটনাটি অনেকটা ম্যালেরিয়ার মতো হলেও পীতজ্বর ম্যালেরিয়ার চেয়ে বহুগুণ মারাত্মক।
রোগের কারণ নির্ভুলভাবে জানার পর তার সঙ্গে লড়াই অনেকটা সহজ হয়ে গেল। জীবাণুবাহী মশা মারা এবং মশারি ব্যবহার ইত্যাদি ব্যবস্থায় পীতজ্বরের প্রকোপ অনেকটা কমে গেল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতে তুষ্ট নন। তাঁরা জানতে চান রোগের জীবাণুর খুঁটিনাটি বিবরণ, তাদের আকার, আয়তন, আকৃতি, অভ্যাস ও বংশবিস্তার। কাজের ভার নিলেন জেমস ক্যারল। তিনি কিউবায় এসেছিল স্যার রোনাল্ড রসের সঙ্গে।
সেকালের ডাক্তাররা রোগজীবাণুকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করতেন—ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অ্যামিবা। প্রত্যেকেই এককোষী বলে মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না। এদের সবচেয়ে ছোট জীবাণুটির আয়তন ১ মিউ অর্থাৎ ১ মিলিমিটারের ১০০০ ভাগের ১ ভাগ। সাধারণ মাইক্রোস্কোপে যেকোনো কিছু দুই হাজার গুণ বড় করে দেখা যায়। সুতরাং সবচেয়ে ছোট জীবাণুটিকেও তাতে ২ মিলিমিটারের সমান বড় দেখাবে। এদের চিনতে তাই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু ক্যারল খুঁজে খুঁজে হয়রান। পীতজ্বরের রোগীর রক্ত নিয়ে সারাক্ষণ মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করে চলেছেন, কিন্তু কোনো জীবাণু চোখে পড়ে না। তবে কি রোগটি জীবাণুঘটিত নয়? কিন্তু সন্দেহ স্থায়ী হয় না। জীবাণুতত্ত্ব তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই আবার পরীক্ষা চালান। রোগীর রক্ত, মশার নাড়িভুঁড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজেন। কিন্তু একই ব্যর্থতা। কিছুই দেখা যায় না। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যামিবা কিছুই না।
ব্যর্থতার হতাশার মুখোমুখি একদিন মনে পড়ল তামাকগাছের একধরনের রোগের কথা। তামাকগাছের পাতায় পাতায় নানা রকম দাগ পড়ে, পাতা যায় কুঁচকে। রোগটি ভীষণ ছোঁয়াচে, এতে ফসলের ক্ষতি হয়, কিন্তু কোনো বিহিত করা যায় না। শেষে কাজের ভার নেন রুশ জীবাণুবিদ আইভানভস্কি। তিনিও ক্যারলের মতোই রুগ্ন তামাক পাতার রসে জীবাণু খুঁজে কিছুই পাননি। শেষে মনে এল নতুন এক পরিকল্পনা। চেম্বারল্যান্ড ফিল্টার তখন পানীয়কে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ব্যবহূত হচ্ছিল। এ ফিল্টারের ছাঁকনির মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ছোট জীবাণুটিও গা-গলিয়ে যেতে পারত না। এই পরিস্রুত ছিল জীবাণুমুক্ত। আইনভানভস্কি নকশিপাতা রোগে আক্রান্ত তামাকগাছের রস চেম্বারল্যান্ড ফিল্টারে ছাঁকেন। পরিস্রুত বস্তুটি টলটলে স্বচ্ছ এবং প্রচলিত ধারণানুযায়ী জীবাণুমুক্ত। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই বিশুদ্ধ জীবাণুমুক্ত জলীয় পদার্থ তামাকগাছে ছিটিয়ে দিতেই তামাকগাছে ওই রোগ দেখা দিল। আইভানভস্কি বিস্মিত। জীবাণুতত্ত্বে বিশ্বাসী সবাই অবাক। এ কেমন জীবাণু যা চেম্বারল্যান্ড ফিল্টারের ছাঁকনির মধ্যদিয়ে গা-গলিয়ে দিব্যি বেরিয়ে যায়!
ক্যারল অবিকল আইভানভস্কির পদ্ধতিই অনুকরণ করলেন। রোগীর রক্ত-বোঝাই কয়েকটি মশা গুঁড়ো করে চেম্বারল্যান্ড ফিল্টারে ছাঁকলেন এবং এ থেকে পাওয়া স্বচ্ছ পরিস্রুত নিয়ে তিনজন স্বেচ্ছাসেবককে ইনজেকশন দিলেন। ক্যারল আশ্চর্য হলেন এই দেখে যে, এদের দুজন পীতজ্বরে আক্রান্ত হলো।
গাছপালার ভাইরাস রোগের ইতিহাস নিশ্চয়ই মানুষের চেয়েও পুরোনো কিন্তু তা জানার উপায় নেই। বিখ্যাত শিল্পী রেমব্রান্টের সমকালীন চিত্রীদের আঁকা টিউলিপ ফুলের ছবিই এ রোগের সবচেয়ে পুরোনো সাক্ষী।
নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো যে পীতজ্বর ও তামাকগাছের নকশিপাতা রোগের জীবাণু মূলত একই ধরনের। এরা অন্য সব জীবাণু অপেক্ষা বহুগুণ ছোট, যাদের সাধারণ মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় না, চেম্বারলান্ড ফিল্টারের ছাঁকনির ছিদ্র দিয়েও বেরিয়ে আসতে পারে। তারা ব্যাকটেরিয়া নয়, ছত্রাক নয়, অ্যামিবা নয়। বহুগুণ ছোট এ জীবাণুর নাম ভাইরাস। না-উদ্ভিদ, না-প্রাণী, না-জীবন্ত, না-মৃত। বিজ্ঞানের বিস্ময়!
অথচ তারা আছে কত কাল, হয়তো জীবনের শুরু থেকে কিংবা আরও আগ থেকে। এগুলো বহু জাতের, একেকটি একেক রকম রোগের কারণ। একমাত্র গাছপালারই প্রায় দেড় শ জাতের ভাইরাস রোগ আছে, মানুষ ও প্রাণীদের তো কথাই নেই। তা ছাড়া যেসব ভাইরাস রোগের কারণ শুধু তাদের কথাই আমরা জানি; তাদের ক্রিয়াকর্ম আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এমন সব ভাইরাস থাকা খুবই স্বাভাবিক, যা জীবদেহে লুকিয়ে রয়েছে অথচ দেখার মতো কোনো রোগ সৃষ্টি করছে না। তাদের খোঁজ ইদানীং মিলছে। এ পৃথিবীতে তাহলে কত জাতের ভাইরাস আছে সেই সঠিক সংখ্যা কোনো দিনই জানা যাবে না। কেমন করে জানা যাবে? এদের চোখে দেখা যায় না, মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় না, রোগের সূত্রেই আমরা তাদের খবর জানতে পারি। এদের যারা কোনো রোগ সৃষ্টি না করবে, তাদের জানা যাবে কেমন করে?
ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে পুরোনো যে ভাইরাস-রোগের নজির মেলে সেটি বসন্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ১১২২-২৪৯ অব্দের মধ্যে চীনে বহুবার বসন্তের প্রাদুর্ভাব ঘটে। মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালেও রোগটি ছিল। ৪০ খ্রিষ্টাব্দে আরবীয় চিকিত্সকেরা এ রোগের সম্পূর্ণ ও নিখুঁত বর্ণনা লেখেন। শুধু পীতজ্বর ও বসন্তই নয়; সর্দি, জলাতঙ্ক, টাইফাস এমনি আরও অনেক মারাত্মক রোগই ভাইরাসঘটিত।
গাছপালার ভাইরাস রোগের ইতিহাস নিশ্চয়ই মানুষের চেয়েও পুরোনো কিন্তু তা জানার উপায় নেই। বিখ্যাত শিল্পী রেমব্রান্টের সমকালীন চিত্রীদের আঁকা টিউলিপ ফুলের ছবিই এ রোগের সবচেয়ে পুরোনো সাক্ষী। এসব ছবির মধ্যে এমন সব ফুল রয়েছে, যাদের গায়ে শ্বেতীর চিহ্ন আছে। ফুল নয়, পাতায়ও যে রোগটি ছড়িয়ে থাকে, তাও এই শিল্পীগোষ্ঠী নির্ভুলভাবে এঁকেছিলেন। শিল্পীরা একে প্রকৃতির খেয়ালিপনা ভেবে থাকবেন। কিন্তু আসলে এটি ছিল রোগবিশেষ, ভাইরাস রোগ। এ ধরনের রোগ অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক নয়, যেমন পাতাবাহারের রকমারি বাহার। আমরা অনেকেই জানি না যে পাতার এই বাহার ভাইরাসের জন্য।
শুধু মানুষ নয়; গাছপালা, পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গেরও ভাইরাস রোগ হয়। গরু, ঘোড়া, কুকুর, মেষ, ইঁদুর, উকুন, আরশোলা, বাঁদর, তামাক, টমেটো, আলু, বীট, আপেল—এমনি প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কতকিছুর যে ভাইরাস রোগ হয়, তার সীমাসংখ্যা নেই। ভাইরাসকণা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে বহু হাজার গুণ বড় করে তবেই দেখা যায়।
কিন্তু প্রতিকার কী? মানুষ ও জীবজন্তুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সার্থক প্রতিকার টিকা। ফসলের ক্ষেত্রে অবশ্য এ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়। রুগ্ন গাছপালা উপড়ে ফেলা, জীবাণুবাহী কীটপতঙ্গ ধ্বংস ইত্যাদি ব্যবস্থাই ফলপ্রসূ।
কিন্তু ভাইরাস কী?
আমরা যাদের জীবাণু বলি তা খুবই ছোট, কিন্তু তাদের অন্তত একটি এককোষী দেহ আছে, বাঁচার পক্ষে যা কিছু প্রয়োজন, কম হলেও তার সবকিছুই এর মধ্যেই মজুত থাকে। কিন্তু ভাইরাস হলো জীবাণু অপেক্ষা বহুগুণ ছোট। তাই তাতে প্রাণের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়েরও স্থান সংকুলান হয় না। অনেক ভাইরাস রয়েছে, যারা আয়তনে প্রায় অণুর কাছাকাছি। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এদের অনেকটা দানার মতো দেখায়। কোনো কোনো জাতের ভাইরাসকণা সবই সমান আয়তন ও আকৃতির, আবার অনেকের ক্ষেত্রে এই দানাগুলো নানা আকার ও আয়তনের।
সুতরাং ভাইরাসকে কী বলা যায়? জীব না জড়? সুস্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। হয়তো জীব ও জড়ের মাঝামাঝি কিছু, হয়তো আদিমতম প্রাণ, এদের দিয়েই পৃথিবীতে জীবনের শুরু হয়েছিল।
ভাইরাসের জন্ম আছে। তারা জীবজন্তুর দেহকোষের মধ্যে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু এদের মৃত্যু নেই। শুকনো মৃত জিনিসে লুকিয়ে থাকতে পারে অনন্তকাল। তারপর পছন্দসই গাছপালা বা জীবজন্তু পেলে চাঙা হয়ে ওঠে; শুরু করে কাজকর্ম, ভাঙাগড়া। সিগারেট খেয়ে তার শেষ টুকরোটি তামাক বা টমেটোর খেতে ফেললে তা থেকে ভাইরাস রোগ ছড়াতে পারে তামাক-টমেটোগাছে। ব্যাকটেরিয়া, অ্যামিবা, ছত্রাক যাকে আক্রমণ করে, তার মৃত্যু হলে তারাও মরে যায়। কিন্তু ভাইরাসের ইতিহাস ভিন্ন। সে কিছুতেই মরে না। তাদের এই ধর্মটি জীবনের নিয়মের সঙ্গে ঠিক মেলে না। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ নিয়মটি এখানে খাটে না। তবু এদের জড় পদার্থের কণাও বলা যায় না।
এরা বংশপরম্পরায় বদলে বদলে নতুন নতুন ভাইরাসের জন্ম দিতে পারে। গুটিবসন্ত ও জলবসন্তের ভাইরাস পরস্পরের এত ঘনিষ্ঠ যে একটিকে অন্যটির ঈষৎ বদলানো রূপ বলা যায়। তা ছাড়া আরও একটি ব্যাপার বিবেচ্য। বহু ভাইরাস রয়েছে, যারা সরাসরি জীবজন্তুর রোগ জন্মাতে পারে না; এ জন্য ওদের মশা, ফড়িং বা অন্য কীটপতঙ্গের দেহের মধ্যে কিছুদিন থাকতে হয়। ধরা যাক বীটগাছের ‘বাবড়ি মাথা’ রোগ। একধরনের ফড়িং এই অসুখ বয়ে বেড়ায়। রোগটি সরাসরি ছোঁয়াছুঁয়িতে অন্য গাছে ছড়ায় না। বৈজ্ঞানিকরা সুস্থ গাছে রুগ্ন গাছের রস ইনজেকশন দিয়েও সংক্রমণ ঘটাতে পারেননি। এ জন্য প্রয়োজন প্রথমত একটি বিশেষ জাতের ফড়িং, যে গাছের রসের সঙ্গে কিছু ভাইরাসও গিলবে, তারপর ভাইরাসটি তার পেটে থাকবে কিছুদিন—ধরা যাক এক সপ্তাহ এবং শুধু তখনই সেই ফড়িংটি সুস্থ বীটগাছ কামড়ালে ভাইরাস রোগ হবে, অন্যথা নয়। পীতজ্বরের ক্ষেত্রেও তা সত্যি। এ রোগের ভাইরাস রোগীর দেহ থেকে সরাসরি অন্যত্র ছড়াতে পারে না। রোগীর রক্ত মশার দেহে অন্তত ১০ থেকে ১২ দিন না থাকলে তার সংক্রমণক্ষমতা জন্মে না।
কিন্তু কেন? একটি ভাইরাসের পক্ষে রোগ-জন্মানোর ক্ষমতালাভের জন্য কীটপতঙ্গের ভেতর নির্দিষ্ট সময় থাকা কী জন্য প্রয়োজন?
অনেক জীবাণুর ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, তাদের জীবনবৃত্তের একটি অংশ ওই সব কীটপতঙ্গের দেহেই পূর্ণতা পায়। কিন্তু ভাইরাসের কি এ ধরনের জীবনবৃত্ত বলে কিছু আছে? দৃশ্যত অবশ্যই নেই, কিন্তু কিছু একটা পরিবর্তন অবশ্যই ঘটে, নাহলে সে রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা পায় কোথা থেকে?
সুতরাং ভাইরাসকে কী বলা যায়? জীব না জড়? সুস্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। হয়তো জীব ও জড়ের মাঝামাঝি কিছু, হয়তো আদিমতম প্রাণ, এদের দিয়েই পৃথিবীতে জীবনের শুরু হয়েছিল। কিংবা এমনও হতে পারে যে একসময় এদের দেহ ছিল, স্বাধীন জীবন ছিল, কিন্তু দীর্ঘকাল পরজীবিতার জন্য সব খুইয়ে বসেছে এবং ক্রমেই সরু হয়ে হয়ে শেষপর্যন্ত জীবনের কণায়, জড় পদার্থের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
প্রসঙ্গত, মনীষী অ্যারিস্টটলের কথা মনে পড়ে। তিনি একদা বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির রাজ্যে জড় থেকে জীবনের সৃষ্টি অত্যন্ত ধীরে ধীরে ঘটেছে বলেই জড় ও জীবের মধ্যবর্তী সীমারেখা খুবই অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক।’ ভাইরাসই হয়তো সেই অস্পষ্ট সন্দেহজনক সীমারেখা, জীবন ও জড়ের সেতুবন্ধন।