পঞ্চইন্দ্রিয় না হয়ে সপ্তইন্দ্রিয় হলে মস্তিষ্ক সবচেয়ে ভালো কাজ করত, দাবি বিজ্ঞানীদের
ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনেছি, মানুষের ইন্দ্রিয় পাঁচটি। চোখ, কান, নাক, জিহ্বা আর ত্বক। এই পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়েই আমরা পৃথিবীকে দেখি, শুনি, গন্ধ নিই, স্বাদ বুঝি আর স্পর্শ করি। কিন্তু কখনো কি মনে হয়েছে, আরও কয়েকটা ইন্দ্রিয় থাকলে ভালো হতো? যেমন, আমরা যদি বাদুড়ের মতো শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করতে পারতাম বা পাখির মতো চৌম্বক ক্ষেত্র!
এতদিন এগুলো ছিল শুধু কল্পনা। কিন্তু রাশিয়ার স্কোলটেকের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন এক গাণিতিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যা আমাদের চিন্তাজগৎকে ওলটপালট করে দিতে পারে। তাঁদের দাবি, মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বা মেমোরি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করে, যখন তার কাছে তথ্যের উৎস থাকে ৭টি!
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে। বিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে স্মৃতি জমা রাখে, তা নিয়ে একটি জটিল গাণিতিক মডেল তৈরি করেছিলেন।
আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতির একককে বলা হয় ‘এনগ্রাম’। সহজ করে বললে, এনগ্রাম হলো নিউরনের এক বিশেষ বিন্যাস। ধরুন, আপনি একটা কলা দেখছেন। আপনার মস্তিষ্ক এটাকে কীভাবে মনে রাখে? প্রথমে চোখ দেখে এটা হলুদ। নাক পায় মিষ্টি গন্ধ। জিহ্বা বোঝে এর স্বাদ সুস্বাদু। হাত দিয়ে স্পর্শ করলে বোঝা যায় এটি নরম।
এই সব তথ্য মিলে আপনার মস্তিষ্কে কলা নামে একটা এনগ্রাম বা ফোল্ডার তৈরি করে। আমাদের ক্ষেত্রে এই ফোল্ডারটা তৈরি হচ্ছে পাঁচটি ইন্দ্রিয়র তথ্যের ভিত্তিতে। মানে, আমাদের মস্তিষ্কের ক্যানভাসটা হলো পাঁচ মাত্রার।
রাশিয়ার স্কোলটেকের একদল গবেষক সম্প্রতি দাবি করেছেন, মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বা মেমোরি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করে, যখন তার কাছে তথ্যের উৎস থাকে ৭টি!
কিন্তু স্কোলটেকের গবেষকেরা বলছেন, গণিত অনুযায়ী এই মাত্রা যদি ৫ না হয়ে ৭ হতো, তবে মস্তিষ্ক সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারত!
এই গবেষণার সহ-লেখক প্রফেসর নিকোলাই ব্রিলিয়ানটভ বিষয়টাকে খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গাণিতিকভাবে প্রমাণ পেয়েছি, যখন কোনো স্মৃতি ৭টি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মস্তিষ্কে জমা হয়, তখন মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আলাদা আলাদা জিনিস মনে রাখতে পারে।’
ব্যাপারটা অনেকটা সুটকেস গোছানোর মতো। ধরুন, আপনার সুটকেসে ৫টা খোপ আছে। আপনি সেখানে ৫ রকমের জিনিস রাখতে পারবেন। কিন্তু গণিত বলছে, যদি সুটকেসটা এমনভাবে ডিজাইন করা হতো যাতে ৭টা বিশেষ খোপ থাকে, তবে আপনি সবচেয়ে বেশি জিনিস সবচেয়ে ভালোভাবে ও দীর্ঘ সময়ের জন্য গুছিয়ে রাখতে পারতেন। ৭-এর কম হলে তথ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়, আবার ৭-এর বেশি হলে মস্তিষ্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে বা তথ্যগুলো গুলিয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের তো ৫টা ইন্দ্রিয়, তাহলে এই গবেষণা দিয়ে আমরা কী করব? আমরা কি মিউট্যান্ট হয়ে যাব? প্রফেসর ব্রিলিয়ানটভ অবশ্য এখনই আমাদের এক্স-ম্যান হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন না। তবে তিনি একটা মজার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। হয়তো ভবিষ্যতে মানুষের নতুন কোনো ইন্দ্রিয় তৈরি হবে! হয়তো আমরা তেজস্ক্রিয়তা অনুভব করতে পারব, কিংবা বুঝতে পারব পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। তখন আমাদের মস্তিষ্ক আজকের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ হবে।
গণিত বলছে, যদি সুটকেসটা এমনভাবে ডিজাইন করা হতো যাতে ৭টা বিশেষ খোপ থাকে, তবে আপনি সবচেয়ে বেশি জিনিস সবচেয়ে ভালোভাবে ও দীর্ঘ সময়ের জন্য গুছিয়ে রাখতে পারতেন।
তবে এই মুহূর্তে আমরা সপ্তইন্দ্রিয় না পেলেও, এই গবেষণা কিন্তু ফেলনা নয়। এর আসল বাজিটা হতে যাচ্ছে রোবোটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে। আমরা যখন কোনো রোবট বা এআই তৈরি করি, আমরা চাই সেটা যেন মানুষের মতোই চিন্তা করতে পারে। এতদিন আমরা রোবটকে ক্যামেরা (চোখ) আর মাইক্রোফোন (কান) দিয়ে মানুষের মতো বানানোর চেষ্টা করতাম।
কিন্তু এই গবেষণা বলছে, রোবটকে যদি আমরা মানুষের চেয়েও স্মার্ট বানাতে চাই, তবে পাঁচটির পরিবর্তে সাতটি সেন্সর দিতে হবে।
একটি এআই যদি পৃথিবীকে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় বিশ্লেষণ করতে পারে, তবে তার শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি হবে মানুষের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী।
হয়তো আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু পারফেক্ট নয়। গণিতের ভাষায়, পারফেকশনের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ৭ সংখ্যার ভেতরে। কে জানে, হয়তো হাজার বছর পর আমাদের উত্তরসূরিরা এমন কোনো ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে, যা দিয়ে তারা এই মহাবিশ্বকে আমাদের চেয়ে আরও স্পষ্টভাবে, আরও রঙিনভাবে অনুভব করতে পারবে! তবে এ সবই এখনো কল্পনা!