পেইনকিলারের কারিকুরি: ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা কমে কীভাবে

ব্যথার অনুভূতিকে প্রশমন করার জন্য ব্যবহৃত ব্যথানাশক বা পেইনকিলারছবি: মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধের তালিকার একেবারে সামনের সারিতেই থাকবে পেইনকিলার বা ব্যথানাশকের নাম। ব্যথার অনুভূতি যেমন আদিম ও অকৃত্রিম, তেমনি একে পাশ কাটানোর চেষ্টাও মানুষের বহু পুরোনো। আর সেই কারণেই আমরা পেয়েছি হরেক রকমের ব্যথানাশক।

ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টি থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের সেটি বুঝতে পারা পর্যন্ত লম্বা পথপরিক্রমার যেকোনো এক জায়গায় বাধা দিতে পারলেই সেটি জায়গা পায় ব্যথানাশকের তালিকায়। তবে দৈনন্দিন জীবনে পেইনকিলার বলে আমরা যে ওষুধগুলোকে চিনি ও ব্যবহার করি, সেগুলো মূলত এনএসএআইডি বা নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস নামে ওষুধের একটি গ্রুপের সদস্য।

মজার ব্যাপার হলো, এই গ্রুপের প্রোটোটাইপ বা প্রথম সদস্য হলো অ্যাসপিরিন, যা চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহৃত হতে শুরু করে ১৮৯০-এর দশকে। বর্তমানে অবশ্য অ্যাসপিরিন ব্যথা কমানোর চেয়ে রক্ত তরল রাখার জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসপিরিনের অনেক উত্তরসূরি আবিষ্কৃত হয়েছে, যারা ব্যথানাশক হিসেবে আরও অনেক বেশি দক্ষ।

অ্যাসপিরিন
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমাদের ভীষণ পরিচিত এই পেইনকিলারগুলোর ক্রিয়াকৌশল বুঝতে হলে আগে একটু জানতে হবে ব্যথার পেছনের বিজ্ঞান। আমাদের শরীরের ত্বক থেকে শুরু করে আরও প্রায় সব অঙ্গে থাকে ব্যথার অনুভূতি গ্রহণকারী রিসেপ্টর। এগুলোকে বলা হয় নোসিসেপ্টর।

ল্যাটিন শব্দ নোসি (Nocere) থেকে এদের নামটা এসেছে, যার অর্থ ক্ষতি করা। শরীরের যেকোনো জায়গায় ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিলেই এরা তৎপর হয়ে ওঠে। সেই ক্ষতিটা হতে পারে যেকোনো ভৌত বা রাসায়নিক শক্তির কারণে—যেমন তাপ, চাপ কিংবা অ্যাসিড বা ক্ষারের মতো কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ।

আরও পড়ুন
দৈনন্দিন জীবনে পেইনকিলার বলে আমরা যে ওষুধগুলোকে চিনি ও ব্যবহার করি, সেগুলো মূলত এনএসএআইডি বা নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস নামে ওষুধের একটি গ্রুপের সদস্য।

এই রিসেপ্টরগুলো আসলে বিশেষায়িত স্নায়ুপ্রান্ত। তাই তারা এই অনুভূতিটা বয়ে নিয়ে যায় এদের স্নায়ুকোষদেহের দিকে, যে কিনা বসে আছে স্পাইনাল কর্ডের পেছনের মুক্তোদানার মতো ডর্সাল রুট গ্যাংলিয়াতে। এখান থেকে আরেকটি স্নায়ুপ্রান্ত দিয়ে এ অনুভূতিটা যায় স্পাইনাল কর্ডের পেছনের অংশের নিউরনের কাছে, যে কিনা এই ব্যথার অনুভূতি বয়ে নিয়ে যাবে মস্তিষ্কে।

এখন আবার আমরা ফিরে যাই আমাদের পেইনকিলারগুলোর দিকে। এদের মূল কাজ হলো কক্স, অর্থাৎ সাইক্লোঅক্সিজিনেজ এনজাইমের কাজে বাধা দেওয়া। আর এর মাধ্যমে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন উৎপাদন বন্ধ করা।

কিন্তু এতক্ষণ আমরা ব্যথার অনুভূতির যে পথপরিক্রমা পড়লাম, সেখানে এই প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের কাজটা ঠিক কোথায়? চলুন, সেটা দেখে নেওয়া যাক।

ব্যথার প্রধান কারণ হলো শরীরের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। সেটা কেটে গিয়েই হোক কিংবা পুড়ে গিয়েই হোক। আর ক্ষতিটা সব সময় শুরু হয় সবচেয়ে বাইরের অংশ, অর্থাৎ কোষঝিল্লি থেকে। কোষঝিল্লির মূল উপাদান হলো ফসফোলিপিড। এটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাধ্যমে উন্মুক্ত হয় ২০ কার্বনবিশিষ্ট ফ্যাটি অ্যাসিড অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড।

এই অ্যাসিড থেকেই সাইক্লোঅক্সিজিনেজ এনজাইমের ক্রিয়ায় কয়েক ধাপে তৈরি হয় প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনসহ আরও বেশ কিছু রাসায়নিক। এদের একটা নাম ইনফ্ল্যামেটরি মেডিয়েটর। এদের বিচিত্র কার্যকলাপে দেখা দেয় ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ। যেসব ব্যথার ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি কাটাছেঁড়ার মাধ্যমে কোষের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পাই না, সেগুলোর গোড়াতেও আছে এই প্রদাহ।

আরও পড়ুন
অ্যারাকিডোনিক অ্যাসিড থেকেই সাইক্লোঅক্সিজিনেজ এনজাইমের ক্রিয়ায় কয়েক ধাপে তৈরি হয় প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনসহ আরও বেশ কিছু রাসায়নিক। এদের একটা নাম ইনফ্ল্যামেটরি মেডিয়েটর।

ইনফ্ল্যামেটরি মেডিয়েটরদের দলের সব কাজের কাজি হলো প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন। এরা প্রদাহের প্রায় সব কটি ধাপে ভূমিকা পালন করে, হোক সেটা জ্বর কিংবা ব্যথা। এরা সংশ্লিষ্ট এলাকার রক্তনালির কোষগুলোর ওপর কাজ করে এগুলোকে প্রসারিত করে এবং শ্বেত রক্তকণিকা যেন সহজে সে জায়গায় পৌঁছাতে পারে, সে জন্য রক্তনালির দেয়ালে কিছু ছিদ্র তৈরি করে। ফলে প্রদাহের জায়গাটা ফুলে ওঠে। এই ফুলে ওঠার জন্য যেই নোসিসেপ্টরগুলো সংকোচন-প্রসারণের ব্যাপারে সংবেদনশীল, তারা উদ্দীপ্ত হয়। এটা ব্যথা অনুভূত হওয়ার একটা কারণ।

এর পাশাপাশি এরা আস্তে আস্তে ব্যথার তীব্রতা বাড়ায় এক জটিল প্রক্রিয়ায়। একে বলা হয় পেরিফেরাল সেনসিটাইজেশন বা প্রান্তীয় সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি। প্রদাহের জায়গাটিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি পরিমাণে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন তৈরি হতে থাকে, যা নোসিসেপ্টরগুলোর সংবেদনশীলতা বাড়ায়। কাজেই একই পরিমাণ ব্যথার সংকেতেও আরও বেশি ব্যথা অনুভূত হয়।

বোঝাই যাচ্ছে, ব্যথা অনুভূত হওয়ার একদম গোড়ায় কাজ করে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন। এর উৎপাদন বন্ধ করার জন্য নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে সাইক্লোঅক্সিজিনেজ এনজাইমকে। আর ঠিক এই কাজটাই করে এনএসএআইডি গ্রুপের পেইনকিলারগুলো।

এভাবেই প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের উৎপাদন হ্রাস করার মাধ্যমে পেইনকিলারগুলো একদিকে যেমন প্রদাহ কমায়, একই সঙ্গে কমিয়ে ফেলে জ্বরও।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

আরও পড়ুন