অর্থকষ্টে কেন মানুষের ঘুম আসে না, বিজ্ঞান কী বলে
ঘড়ির কাঁটায় রাত ২টা। সারা দিনের খাটুনি শেষে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছেন। চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছে, কিন্তু মস্তিষ্ক? সে যেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মাথার ভেতর চলছে এক অদ্ভুত ক্যালকুলেটর। আগামী মাসের বাড়ি ভাড়া, ক্রেডিট কার্ডের বিল কিংবা বাচ্চার স্কুলের বেতন—টাকার এই হিসাব-নিকাশ আপনাকে কিছুতেই ঘুমাতে দিচ্ছে না।
এই দলে কিন্তু আপনি একা নন। যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটির নতুন এক গবেষণা বলছে, অর্থনৈতিক চাপ বা ফিন্যান্সিয়াল স্ট্রেস আমাদের ঘুমের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর এই নির্ঘুম রাত শুধু আপনার শরীর খারাপ করছে না, পরদিন অফিসে আপনার কাজেরও বারোটা বাজাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে এক ভিসিওয়াস সাইকেল বা দুষ্টচক্র।
সমীকরণটা অনেকটা এ রকম: টাকার চিন্তা, ঘুম নেই; পরদিন খারাপ পারফরম্যান্স, চাকরির ভয়, আবার টাকার চিন্তা। কিন্তু টাকার সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক কোথায়? এই সাপে-নেউলে সম্পর্কটা আসলে কীভাবে কাজ করে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বেছে নিলেন আমেরিকার আর্মি এবং এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের পূর্ণকালীন সদস্যদের। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের অর্থায়নে চলা এই গবেষণায় প্রায় ৯ মাস ধরে তাঁদের ওপর নজর রাখা হয়েছিল।
গবেষক রেবেকা ব্রোসইট এবং তাঁর দল শুধু মুখের কথায় বিশ্বাস করেননি। তাঁরা অংশগ্রহণকারীদের হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন রিস্ট-ওর্ন অ্যাক্টিগ্রাফ। এটি এমন এক বিশেষ যন্ত্র, যা নির্ভুলভাবে বলে দেয় মানুষটা আসলে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে আর কতক্ষণ বিছানায় ছটফট করেছে। ফলাফল? যাদের মাথায় অর্থনৈতিক চাপ ছিল, তাদের ঘুমের দফারফা!
রিস্ট-ওর্ন অ্যাক্টিগ্রাফ এমন এক বিশেষ যন্ত্র, যা নির্ভুলভাবে বলে দেয় মানুষটা আসলে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে আর কতক্ষণ বিছানায় ছটফট করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনৈতিক চাপ সরাসরি আমাদের ঘুমানোর আগের আচরণকে প্রভাবিত করে। রেবেকা ব্রোসইট বলছেন, ‘টাকার চিন্তা মানুষের মস্তিষ্ককে মানসিক ও আবেগীয় উত্তেজনার মধ্যে ফেলে দেয়।’ সহজ কথায়, বিছানায় শুয়ে আপনি হয়তো ভাবছেন, আগামীকাল বসকে কী বলব? অথবা ধারের টাকাটা শোধ করব কীভাবে?—এই চিন্তাগুলো আপনার শরীরকে শিথিল হতে দেয় না।
এখানে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলে রাখি। আমরা যখন দুশ্চিন্তা করি, তখন আমাদের শরীর থেকে কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এগুলোকে বলা হয় ফাইট অর ফ্লাইট হরমোন। এই হরমোনগুলো হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয় এবং মস্তিষ্ককে সজাগ রাখে। অর্থাৎ আমাদের ঘুমের সম্পূর্ণ বিপরীত।
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা টাকার চিন্তায় ভোগেন, তাঁরা বিছানায় শুয়ে আগামীকালের পরিকল্পনা করেন অথবা অতীতের ভুল নিয়ে আফসোস করেন। ফলে তাঁদের ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা দেখা দেয়। ঘুমের তৃপ্তিও কমে যায়।
এই গবেষণার সবচেয়ে মজার দিক হলো, এটা শুধু কম আয়ের মানুষের সমস্যা নয়। গবেষকরা বলছেন, আপনার ব্যাংকে কত টাকা আছে, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো আপনি নিজেকে কতটা নিরাপদ ভাবছেন। একজন ধনী ব্যক্তিও যদি তাঁর লাইফস্টাইল বা চাকরি হারানোর ভয়ে থাকেন, তবে তাঁরও ঘুম নষ্ট হবে। একে বলা হয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। বেতনের চেকটা আদৌ আসবে কি না, এই অনিশ্চয়তা শরীরের জন্য বিষের মতো কাজ করে।
আমরা যখন দুশ্চিন্তা করি, তখন আমাদের শরীর থেকে কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এগুলোকে বলা হয় ফাইট অর ফ্লাইট হরমোন। এই হরমোনগুলো হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়।
তাহলে উপায়? গবেষকেরা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি অনেকটাই অফিসের বস বা প্রতিষ্ঠানের হাতে। কর্মীদের বেতন ঠিকঠাক দেওয়া, চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কাজের সময়ের নমনীয়তা কর্মীদের মানসিক চাপ অনেক কমিয়ে দিতে পারে।
তবে আমরা ব্যক্তিগতভাবেও কিছু করতে পারি। রেবেকা ব্রোসইট ঘুমের কিছু নিয়মকানুনের কথা বলেছেন। সেগুলো একটু দেখে নিই।
১. ফোন দূরে রাখা
ঘুমানোর আগে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। ফোনের নীল আলো আমাদের মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এই হরমোনই আমাদের ঘুমের সংকেত দেয়। তাই ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা উচিত।
২. রুটিন মানা
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করা ভালো।
৩. রিল্যাক্স করা
ঘুমানোর আগে টাকার হিসাব না করে বই পড়লে বা হালকা গান শুনলে দ্রুত ঘুম আসতে পারে।
রাইস ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ডেসটিনি কাস্ত্রো এই গবেষণার ডেটা বিশ্লেষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতিটি অংশকে প্রভাবিত করে। টাকা জীবনে অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেই টাকার চিন্তা করতে গিয়ে যদি আপনার ঘুমটাই হারিয়ে যায়, তবে সে টাকা উপভোগ করবেন কীভাবে? তাই বিছানায় যাওয়ার আগে টাকার চিন্তাগুলো দূরে রেখে আরাম করে ঘুম দিন। এতে আপনার স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে এবং কাজও করতে পারবেন ভালো। আর ভালো কাজ করতে পারলে তো চিন্তার কিছু নেই!