সকালে ঘুম ভাঙতে চায় না কেন

রাতে ঘুমানোর আগে জানালার পর্দা সরিয়ে রাখলে সকালে সহজে ঘুম ভেঙে যাবে। মডেল: অ্যাঞ্জেলাছবি: সুমন ইউসুফ

সকালে ঘুম ভাঙার পরেও অনেক সময় মনে হয় ঘুমটা যেন পুরোপুরি কাটেনি। মাথা ভার, চোখে ঝিমুনি, শরীর কেমন অলস অলস লাগে। এটা একেবারেই স্বাভাবিক। কারণ, ঘুম থেকে ওঠা কোনো লাইটের সুইচ অন করার মতো বিষয় নয়। বরং ঘুম ভাঙার প্রক্রিয়াটা হয় ধীরে ধীরে, নির্দিষ্ট ক্রমে। 

ঘুম নিয়ে বুঝতে চাইলে আগে জানতে হবে, জেগে থাকা মানে কী। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডারের অধ্যাপক র‍্যাচেল রো বলেন, ‘জেগে থাকা মানে মস্তিষ্ক এমন অবস্থায় আছে, যা আমাদের সচেতন থাকতে, নড়াচড়া করতে এবং চিন্তা করতে সাহায্য করে।’ ঘুমের সময় মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো খুব ধীর হয়। কিন্তু জেগে থাকলে সেগুলো দ্রুত ও নমনীয় হয়ে ওঠে যাতে বাইরে পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারে।

সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুম গবেষক অরেলি স্টেফান বলেন, ‘মস্তিষ্ক কখন ঘুম থেকে পুরোপুরি জেগে ওঠে তার কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্ত নেই। বরং ঘুম ভাঙে ধাপে ধাপে।’ 

আরও পড়ুন

গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের ভেতরের সাবকর্টিক্যাল অঞ্চল নামে একটি অংশ প্রথমে কাজ শুরু করে। এখানে রেটিকুলার অ্যাক্টিভেটিং সিস্টেম নামে এক বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এটা একধরনের সুইচের মতো কাজ করে। এটি থ্যালামাস নামে আরেকটি অংশে বার্তা পাঠায়। থ্যালামাস হলো মস্তিষ্কের যোগাযোগ কেন্দ্র। মানে সংবেদনশীল তথ্য এক অংশ থেকে আরেক অংশে পাঠায় এই থ্যালামাস। এরপর সেই সংকেত যায় মস্তিষ্কের বাইরের স্তরে। সেই স্তরের নাম সেরিব্রাল কর্টেক্সে। এই অঞ্চলের সাহায্যে মানুষ চিন্তা করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়।

স্টেফান ও তাঁর সহকর্মীরা ২০২৫ সালের এক গবেষণায় দেখেছেন, ঘুম ভাঙার সময় মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট একটি প্যাটার্ন অনুসরণ করে। আমরা যখন নন-আরইএম ঘুমে থাকি, মানে হালকা থেকে গভীর ঘুমের স্তরে, তখন প্রথমে কিছু সময়ের জন্য ঘুম ঘুম তরঙ্গ দেখা যায়। মানে পুরোপুরি তখনো জেগে উঠিনি। এরপরই জেগে থাকার দ্রুত তরঙ্গ শুরু হয়।

কিন্তু আমরা যদি আরইএম ঘুম থেকে উঠি, তখন মস্তিষ্কের তরঙ্গ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত হয়ে যায়। আরইএম ঘুমের সময় আমরা স্বপ্ন দেখি। গবেষকেরা আরও দেখেছেন, ঘুম ভাঙার সময় মস্তিষ্কের কার্যকলাপ শুরু হয় মাথার সামনের ও মাঝের অংশে। এরপর ধীরে ধীরে পেছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

তবে অনেক সময় ঘুম ভাঙলেও পুরোপুরি জেগে উঠতে দেরি হয়। কারণ, জেগে ওঠার পরও মস্তিষ্কের সব ক্ষমতা একসঙ্গে সক্রিয় হয় না। কিছু সময় লাগে। এই সময়টাকে বলা হয় স্লিপ ইনার্শিয়া। তখন আমরা একটু ঘোরের মধ্যে থাকি। মানে চোখ খুলে ফেলেছি, কিন্তু মাথা পুরো কাজ করছে না। স্টেফান বলেন, এই ঘোর ১৫-৩০ মিনিট পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে মাঝেমধ্যে ঘণ্টাও হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি জানেন না, কেন এই ঘোরভাব হয়। তবে এটা স্পষ্ট যে, আমরা কোন সময় ঘুম থেকে উঠছি, সেটি আমাদের অনুভূতির ওপর বড় প্রভাব ফেলে।

আমাদের মস্তিষ্ক প্রতি ৫০ সেকেন্ডে একটি ছোট চক্র তৈরি করে, যার মধ্যে সতর্কতার মাত্রা ওঠানামা করে। চক্রের বিল্ড-আপ ধাপে আমরা গভীর ঘুমে থাকি। তখন ঘুম থেকে ওঠা খুব কঠিন। কিন্তু যখন চক্র ক্ষীণ হতে থাকে, তখন ঘুম হালকা হয়ে আসে, জেগে ওঠা সহজ হয়। এই ধাপকে বলে ওয়েন ফেজ।

আরও পড়ুন

কিন্তু অ্যালার্ম ঘড়ি আমাদের সেই প্রাকৃতিক ছন্দ নষ্ট করে দেয়। এটি এলোমেলোভাবে বাজে। হয়তো আপনি গভীর ঘুমে আছেন, তখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ফলে মাথা ভারী লাগে, মনে হয় ঘুমই হয়নি। 

ঘুম থেকে জাগা নিয়ে এখনো অনেক রহস্য আছে। দেখবেন, টানা ৭ ঘণ্টা ঘুমানোর পর অনেক সময় আমাদের সতেজ লাগে, আবার মাঝেমধ্যে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে লাগে ক্লান্ত। কেন এমনটা হয়, তা এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি জানেন না। কিছু গবেষণা বলছে, খাবারের ধরন আর মোট ঘুমের সময়কাল সকালের সতেজতার ওপর প্রভাব ফেলে।

তার মানে, সকালে ঘুম ভাঙার লড়াইটা যতটা সহজ মনে হয়, আসলে ততটা নয়। হঠাৎ করে হয়তো অ্যালার্মের শব্দে আপনার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু মস্তিষ্ক হয়তো তখনো ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য প্রস্তুত নয়। এ জন্যই মাঝেমধ্যে আলসেমি লাগে, কাজে মন বসে না।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ 

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট

আরও পড়ুন