আপনি হয়তো শুনেছন, মানুষের হাঁচি ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে ছুটে যায়। মানে বুলেট ট্রেনের গতির কাছাকাছি মানুষের হাঁচির গতি! অনেক জায়গায় এই তথ্যটা লেখা আছে। এমনকি কিছু পাঠ্যপুস্তকেও আছে এই তথ্য। কিন্তু আসলেই কি কথাটা সত্যি? বিজ্ঞানীরা কীভাবে হাঁচির গতি ১৬০ কিলোমিটার মেপেছিলেন? সে গল্পটা একটু আলাদা, বেশ মজারও।
এই ভুল তথ্যের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫০-এর দশকে। তখন উইলিয়াম ফার্থ ওয়েলস নামে একজন জীববিজ্ঞানী রিপোর্ট করেছিলেন, সবচেয়ে দ্রুত হাঁচি ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে যেতে পারে। এই তথ্যটা কয়েক দশক ধরে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া হয়েছে। বইপত্র থেকে শুরু করে ইন্টারনেটে, সর্বত্র এই তথ্যটি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটা অনেকটাই বাড়িয়ে বলা।
সাম্প্রতিক গবেষণায় যাওয়ার আগে দেখি, কীভাবে বিজ্ঞানীরা আগে ১৬০ কিলোমিটার গতি মেপেছিলেন। ভুলটা আসলে কোথায় হয়েছিল? গল্পের শুরু আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে। উইলিয়াম ফির্থ ওয়েলস তখন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন।
ডক্টর ওয়েলস সে সময় শুধু হাঁচির গতি নিয়েই ভাবছিলেন না, তিনি আরও অনেক বড় একটা রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি জানতে চাইছিলেন, রোগজীবাণু কীভাবে বাতাসের মাধ্যমে একজন মানুষ থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে যক্ষ্মার মতো রোগগুলো কীভাবে ছড়ায়। তিনিই প্রথম ড্রপলেট নিউক্লিয়াই বা জীবাণু কণার ধারণা দেন। অর্থাৎ, হাঁচি-কাশির বড় কণাগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পর যে অতি-সূক্ষ্ম কণা বাতাসে ভেসে বেড়ায়, সেগুলোই জীবাণু কণা।
১৯৫০-এর দশকে উইলিয়াম ফার্থ ওয়েলস নামে একজন জীববিজ্ঞানী রিপোর্ট করেছিলেন, সবচেয়ে দ্রুত হাঁচি ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে যেতে পারে।
বর্তমান সময়ের মতো তখনকার দিনে হাই-স্পিড থার্মাল ক্যামেরা ছিল না। তাই ডক্টর ওয়েলসকে সেই সময়ের সেরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তিনি ব্যবহার করেছিলেন ‘হাই-স্পিড ফটোগ্রাফি’ প্রযুক্তি।
কীভাবে তিনি পরীক্ষাটি করেছিলেন, সে ব্যাপারটা একটু কল্পনা করি। তিনি প্রথমে একটা অন্ধকার ঘর বেঁছে নিলেন। সেখানে একজন স্বেচ্ছাসেবককে দাঁড় করালেন। তাকে হাঁচি দিতে বলা হলো। হয়তো গোলমরিচ বা অন্য কিছুর সাহায্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হাঁচি দিলেন। তখনই ঘরের একপাশ থেকে প্রচণ্ড উজ্জ্বল আলো খুব দ্রুত গতিতে জ্বলতে-নিভতে শুরু করল। অন্য পাশে থাকা একটি হাই-স্পিড ক্যামেরা সেই আলোর ঝলকানিতে হাঁচির কণাগুলোর ছবি তুলে ফেলল। ব্যস, পরীক্ষা শেষ, এখন শুধু ফলাফল বের করার পালা।
হাঁচির ছবিগুলো হাতে পাওয়ার পর ওয়েলস সেগুলো বিশ্লেষণ শুরু করলেন। বুঝতে চাইলেন, প্রতিটি আলোর ঝলকানির মধ্যে হাঁচির কণাগুলো ঠিক কতদূর এগিয়েছে। তিনি হিসাব করে দেখলেন, হাঁচির একেবারে প্রথম ধাক্কায় যে সবচেয়ে বড় এবং দ্রুতগতির কণাগুলো বেরিয়ে আসে, সেগুলোর গতিবেগ অবিশ্বাস্য! তাঁর হিসাবে, এই গতিবেগ ছিল সেকেন্ডে প্রায় ৪৪ মিটার। অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ১৫৮.৪ কিলোমিটার।
তাহলে ভুলটা হলো কোথায়? আসলে ডক্টর ওয়েলস মোটেও ভুল ছিলেন না। তিনি যা মেপেছিলেন, তা সঠিক ছিল। কিন্তু তিনি মেপেছিলেন হাঁচি মুখ থেকে বের হওয়ার মুহূর্তের সর্বোচ্চ গতি। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা থার্মাল ক্যামেরা দিয়ে পুরো হাঁচির মেঘের গড় গতিবেগ মেপেছেন। সে ব্যাপারে পরে আসছি।
হাঁচির একেবারে প্রথম ধাক্কায় যে সবচেয়ে বড় এবং দ্রুতগতির কণাগুলো বেরিয়ে আসে, সেগুলোর গতিবেগ ছিল সেকেন্ডে প্রায় ৪৪ মিটার। অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ১৫৮.৪ কিলোমিটার।
অর্থাৎ, ওয়েলসের পরীক্ষায় হাঁচির প্রথম কণাটি হয়তো খুব জোরেই ধাক্কা খায়, কিন্তু পুরো জীবাণুর মেঘটি অত জোরে ছোটে না। কিন্তু ওই ১৬০ কিলোমিটার সংখ্যাটি ছিল খুবই চমকপ্রদ! ফলে এটিই মানুষের মুখে মুখে এবং খবরের কাগজে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এটি একটি মিথ বা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। যদিও ডক্টর ওয়েলসের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বাতাসের মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা।
এবার নতুন গবেষণায় বিষয়ে আসা যাক। কানাডার আলবার্টা প্রভিন্সিয়াল ল্যাবরেটরি ফর পাবলিক হেলথের বিজ্ঞানী জুলিয়ান ট্যাং এই বিষয়ে নতুন করে গবেষণা করেছেন। তাঁর পদ্ধতিটা বেশ ভালো ছিল। তিনি প্রথমে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে জোগাড় করেন। তারপর তাদের নাকে গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে ইচ্ছে করেই হাঁচি দেওয়ান! আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি তিনি থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করেন। ফলাফল অবাক করার মতো। হাঁচির গতি সেকেন্ডে মাত্র পাঁচ মিটার পেলেন। মানে ঘণ্টায় ১৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ, আগের দাবির তুলনায় এটা প্রায় নয় গুণ কম!
তবে গতির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো হাঁচি কতদূর যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির লিডিয়া বরুইবা এই বিষয়ে চমৎকার একটি গবেষণা করেছেন। তিনি হাই-স্পিড ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহার করে হাঁচির কণাগুলো ট্র্যাক করেছেন। তাঁর গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, একটা হাঁচি প্রায় ৮ মিটার বা ২৭ ফুট পর্যন্ত যেতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির লিডিয়া বরুইবার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, একটা হাঁচি প্রায় ৮ মিটার বা ২৭ ফুট পর্যন্ত যেতে পারে।
প্রথমত, তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা। গরম আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে হাঁচির কণাগুলো বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারে। ঠান্ডা আর শুষ্ক বাতাসে কণাগুলো দ্রুত শুকিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, কণার আকার। হাঁচিতে বিভিন্ন আকারের পানির কণা বের হয়। ছোট কণাগুলো অনেকক্ষণ বাতাসে ভাসতে থাকে। কিন্তু বড় ফোঁটাগুলো দ্রুত মাটিতে পড়ে যায়। মানে ঘর যত গরম আর স্যাঁতসেঁতে হবে, কণাগুলো তত বেশি সময় ভাসবে।
তৃতীয়ত, ঘরের বাতাস চলাচল ব্যবস্থা বা ভেন্টিলেশন। এসি বা ফ্যানের বাতাস হাঁচির কণাগুলোকে আরও দূরে নিয়ে যেতে পারে। চতুর্থত, হাঁচি দেওয়া ব্যক্তির ফুসফুসের ক্ষমতা। যার ফুসফুস বেশি শক্তিশালী, তার হাঁচি স্বাভাবিকভাবেই বেশি জোরালো হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেউ আপনার সামনে হাঁচি দিলে আপনি কি সরে যেতে পারবেন? বাস্তবে তা খুবই কঠিন। হাঁচি এত দ্রুত ছড়ায় যে সাধারণত প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় পাওয়া যায় না।
তাহলে সমাধান কী? সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রতিরোধ। হাঁচি আসলে নাক আর মুখ হাত বা বাহু দিয়ে ঢেকে ফেলতে হবে। অথবা মাস্ক পরা আরও ভালো। এতে হাঁচির কণাগুলো বেশিদূর যেতে পারে না। আর যদি কারো হাঁচির সংস্পর্শে এসে যান, তাহলে সাবান-পানি দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।
মজার ব্যাপার হলো, করোনা মহামারীর পর এই বিষয়ে গবেষণা অনেক বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছেন, কীভাবে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ছড়ায়। হাঁচি শুধু একটা সাধারণ শারীরিক ক্রিয়া নয়, এটা রোগ ছড়ানোর একটা বড় মাধ্যম।
