রাতের বেলা টিনের চালে লাফালাফি করে কে? ভূত না অন্যকিছু?

২০২১ সালের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়া শহর থেকে দু-তিন কিলোমিটার দূরের বারাদী মাঠে পাকা ধান কাটছিলেন কয়েকজন কৃষিশ্রমিক। জায়গায় জায়গায় বাবলাগাছের সারি, নানা রকম ঝোপঝাড়ও অনেক। কৃষিশ্রমিক মো. দাউদ দেখতে পেলেন একটি গাছখাটাশ বা গন্ধগোকুলের বাচ্চা। সেটি চুপটি করে বসে আছে ধানখেত–সংলগ্ন একটি ঘন ঝোপে। অমনি মাথায় কুবুদ্ধি এল। মারতে হবে সেটিকে। এরা কলা-পেয়ারাসহ নানা রকম ফল খেয়ে সর্বনাশ করে। হাঁস-মুরগির ছানা ও পোষা কবুতরও খায়। এ ছাড়া বন্য প্রাণী মারার ভেতরে একটা অন্য রকম আনন্দ যেন আছে! তিনি চিৎকার দিতেই সবাই মিলে করলেন ধাওয়া। কিন্তু গন্ধগোকুল ধরা-মারা কী এতই সোজা। দৌড়-লাফে মহা ওস্তাদ। গাছে চড়তে পারে তরতর বেগে। প্রাণীটি তো বৃক্ষচর। ধানখেত, ঝোপঝাড়, বাবলা ঝোপের ভেতর দিয়ে দৌড়ে সেটি একসময় চড়ে বসল একটি চারাগাছের মাথায়। ‘ধর-মার’ শব্দে তেড়ে এলেন কৃষকেরা। প্রায় ১২ ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে দিল আবার ঝেড়ে দৌড়, লেজ উঁচিয়ে। কিন্তু একসময় কাঁটাভরা একটি বড় বাবলাগাছে চড়েও রক্ষা পেল না—লাফিয়ে মাটিতে পড়তেই সেটিকে জাল দিয়ে আটকে ফেলা হলো। প্রাণীটি আহত হয়েছে ধাওয়া খেয়ে। হাঁপাচ্ছে। মরমর দশা। কাঁচি-লাঠি দিয়ে আর মারলেন না কেউ। মো. দাউদ ফোন করলেন কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা এস আই সোহেলকে। তাঁদের পারিবারিক জমিতেই ধান কাটা হচ্ছিল। সোহেল একজন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী, বন্য প্রাণীপ্রেমী ও বন্য প্রাণী সংরক্ষক। মোটরসাইকেলে চড়ে তিনি ঘটনাস্থলে এলেন, অনেকটা সময় নিয়ে বাচ্চাটিকে যত্ন করে ফিডারে ছাগলের দুধ পান করিয়ে ও ঘরোয়া প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে একসময় বাবলা বনে অবমুক্ত করলেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া গন্ধগোকুল
ছবি: রবিউল ইসলাম

উল্লিখিত প্রাণীটির ইংরেজি নাম ‘কমন পাম সিভেট’। বৈজ্ঞানিক নাম Paradoxurus hermaphroditus। শুধু শরীরের দৈর্ঘ্য ৪৮ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার। লেজ ৪৪ থেকে ৫৩ সেন্টিমিটার। বৃহত্তর খুলনায় এরা সারেল বা সাইরেল নামে পরিচিত। এ ছাড়া গাছখাটাশ, তালখাটাশ, ভোন্দর, লেনজা ও নঙ্গর নামে পরিচিত দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ওজন দুই থেকে পাঁচ কেজি। সারা দেশেই কমবেশি দেখা যায়। তবে বাগেরহাটের ফকিরহাট ও খুলনার রূপসা উপজেলার গ্রামীণ বনে বেশি দেখা যায়। দিন কাটায় বড় গাছের কোটর-ফোকর ও মোটা ডালে। কিন্তু প্রাকৃতিক বন ছাড়া গ্রামীণ বনে এখন আছে প্রকট অস্তিত্বসংকটে। এই প্রাণী শৈশব থেকে আজ অবধি আমার নিত্য প্রতিবেশী। আমার ও আমার সমবয়সীদের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা খুবই সমৃদ্ধ। গ্রামে (ফকিরহাট) গেলে প্রায় প্রতি রাতেই কলা-সফেদা-পেয়ারা-পেঁপেগাছে আসতে দেখি।

আরও পড়ুন

বাগেরহাট অঞ্চলে খুব ভালো অবস্থায় ছিল ৩০ বছর আগেও। এখন প্রতিটি গ্রামেই কবুতর ও মুরগির অনেক ফার্ম। বন-বাগান ও বুনো ফলের গাছ কমেছে, বড় গাছ তো বলতে গেলে নাই-ই হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রকট সংকট আবাসস্থলের। এরা ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি, কাঠবিড়ালিও খায়। তাই খাদ্যসংকট এদের হয় না। তালের পচা রস বা তাড়ি পান করে এরা কখনো কখনো মাতাল হয়। তাই এরা ‘তাড়ি বিড়াল’ নামেও পরিচিত। রাতে এরা এলাকার প্রতিটা বাড়িতেই টহল দেয়, ফল খায়। ঘরবাড়ির চালা-ছাদে নামে। কবুতর বা মুরগির খামারে হানা দিতে চায়। অতএব পাকা কলা বা অন্য কোনো ফলের ভেতরে ‘ফুরাডন’ বা ‘ফুরাডন–জাতীয় বিষ ঢুকিয়ে কেউ কেউ মেরে ফেলছে এগুলো। চলতি বছরের মার্চেও আমি বাড়ির আঙিনার সফেদাগাছে তিনটি ছানাসহ মা-বাবা প্রাণী দুটিকে কমপক্ষে আট রাতে আসতে দেখেছি। ভয় পেলে বা তাড়া খেলে এরা পশ্চাদ্দেশের গন্ধগ্রন্থি থেকে যে তরল স্প্রে করে, তার গন্ধ অনেকটাই পচা আতপ চালের মতো। একনজরে হালকা ও ঘন বাদামি-ছাই রঙের প্রাণী এরা। নিশাচর। সারা জীবনের জন্য জুটি বাঁধে, চলেও জোড়ায় জোড়ায়। এদের মুখের গড়ন-ধরন খুবই সুন্দর। নাক ঘিরে সাদা-কালো রঙের বৃত্তটা দেখতে দারুণ। কান দুটিসহ মুখখানিতে যেন দর্শনীয় নকশা করেছে কোনো শিল্পী। টলটলে কালো রঙের দুটি চোখ, কপাল, চিবুক-নাকের ডগা মিলে সাদা ও কালোর চমৎকার কম্বিনেশন।

গন্ধগোকুল

গর্ভধারণকাল দুই মাস প্রায়। নারকেল-তালগাছের পাতার গোড়াসহ কোটরে দুই থেকে চারটি ছানা প্রসব করে। ছানাদের কান্না প্রথম প্রথম দুই–তিন মাস বয়সী মানবশিশুর কান্নার মতো মনে হয়। গন্ধগোকুলের ছানা আমরা শৈশবে পুষেছি। একটু বড় হলেই বন-বাগানে চলে যায়। বেজির মতো এরা সুকৌশলে বিষধর সাপকেও রুখে দিতে পারে। মেরেও ফেলতে পারে। এরা দিন কাটায় গাছে, বড় গাছের মগডাল ও কোটরে। বড় গাছ তো কমছে দিন দিন। প্রাকৃতিক খাবারেও টান পড়েছে। খাবে কী? আশ্রয় নেবে কোথায়? তার ওপরে শত্রু মনে করে অকারণে মেরে ফেলার প্রবণতা এদের একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে। প্রকট প্রতিকূলতায় কতকাল আর টিকতে পারবে এরা?

আরও পড়ুন
কেউ কেউ বাচ্চাটির যত্ন নিচ্ছে। সোহেলের কাছে ফোন করে পরামর্শ নিলেন বারেক। পাখি ও প্রাণীপ্রেমী তিনিও। আহত পাখি ও বন্য প্রাণী সুস্থ করে অবমুক্ত করা তাঁর নেশা।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার সোনাপাতিল গ্রামে উদ্ধার হওয়া গন্ধগোকুল

দুই

কুষ্টিয়া শহরের বারেক নামের এক যুবক রাজবাড়ী জেলায় বেড়াতে এসেছিলেন তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে। তখন ওখানকার কালুখালী রেলস্টেশন এলাকায় এসে আখড়া গেড়েছিল এক জোড়া ‘অভ্যন্তরীণ অভিবাসী’ মুখপোড়া হনুমান বা যশোরের হনুমান (Northern Plains Langur)। এদের মূল আবাস যশোরের কেশবপুরে। ওখানকার দু–একটি করে হনুমান প্রায়ই দেশের নানা প্রান্তে ‘অভিবাসন’ করে। এরা তো আর জেলা-উপজেলার সীমান্ত বোঝে না। কেশবপুর থেকে বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ—সব জায়গায়ই এদের কাছে ‘বিদেশ’। পাসপোর্ট-ভিসাও লাগে না। তো কৌতূহলে কালুখালী রেলস্টেশনে হনুমান দেখতে গিয়ে একটা মর্মান্তিক দৃশ্যের মুখোমুখি হলেন বারেক। স্টেশনসংলগ্ন এলাকার এক জোড়া গন্ধগোকুল কামড়ে-আঁচড়ে ও আছড়ে মেরে ফেলেছে হনুমান দুটি। দুটি ছানার একটিকেও মেরেছে। অন্য ছানাটি পড়েছে গাছতলায়। বেঁচে আছে। কেউ কেউ বাচ্চাটির যত্ন নিচ্ছে। সোহেলের কাছে ফোন করে পরামর্শ নিলেন বারেক। পাখি ও প্রাণীপ্রেমী তিনিও। আহত পাখি ও বন্য প্রাণী সুস্থ করে অবমুক্ত করা তাঁর নেশা। সবাইকে বলে ছানাটিকে তিনি কুষ্টিয়া শহরে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। অতি যত্নে ধীরে ধীরে বড় করেছেন সেটিকে। সাধ করে নাম রেখেছেন ‘বুলেট’। নাম ধরে ডাকলেই কাছে চলে আসে। ঘাড়-মাথায় চড়ে। এখন বুলেট দুষ্টু হয়েছে ভীষণ। উঠানের আমগাছে চড়ে। কাপড় শুকানোর দড়ি বা তারের ওপর দিয়ে হেঁটে যায় তরতর করে। ইচ্ছা হলেই গাছে চড়ে পাকা সফেদা ও কলা খাচ্ছে। বাটিতে দুধ দিলে পান করছে। রাতে থাকছে ঘরের ভেতরেই। স্বাধীন সেটি। ঘরের মাচান বা চালায় ওঠে। এবাড়ি–ওবাড়ি যায়। বারেক জানেন, প্রাণীটির শরীরে ‘যৌবনের ডাক’ এলেই সঙ্গীর খোঁজে বেরিয়ে একরাতে হারিয়ে যাবে। আর ফিরবে না। কেননা, বুনোটি তো আর গৃহস্থের বাড়িতে আসতে চাইবে না কিছুতেই। কুষ্টিয়ার শহরতলির যেকোনো বাগানে পেয়ে যাবে জীবনসঙ্গী।

লেখক: পাখি ও বন্য প্রাণীবিশারদ

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন