মস্তিষ্কের বেশিরভাগ অংশই নেই, তবু বেঁচে আছেন ২০ বছর

হাইড্রানেনসেফালি এমন এক বিরল শারীরিক অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্কের প্রধান অংশ বা সেরিব্রাম গঠিতই হয় নাছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

আলেক্স সিম্পসন। জন্মের পর তাকে দেখে আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই মনে হয়েছিল। কিন্তু বয়স যখন মাত্র দুই মাস, তখন তার বাবা-মাকে চিকিৎসকরা এমন এক খবর দিলেন, যা শুনে তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেল।

চিকিৎসকরা জানালেন, এই ফুটফুটে শিশুটির মাথার ভেতরে মস্তিষ্কের প্রধান অংশটি নেই! খুলির ভেতরটা ফাঁকা, মগজের বদলে সেখানে টলটল করছে শুধুই পানি। বিজ্ঞানের ভাষায় এই পানিকে বলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড। ডাক্তাররা সময় বেঁধে দিলেন, বড়জোর এক বছর বাঁচতে পারে এই শিশু!

কিন্তু বিজ্ঞানের সব হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে, গত ৪ নভেম্বর আলেক্স ২০ বছরে পা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার এই তরুণী এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক জীবন্ত বিস্ময়।

আলেক্সের এই বিরল রোগের নাম হাইড্রোএনসেফালি। মানুষের মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় ও প্রধান অংশ সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার। মস্তিষ্কের এই অংশটি দিয়েই আমরা চিন্তা করি, নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করি, দেখি বা শুনি। আলেক্সের ক্ষেত্রে এই পুরো অংশটাই গায়েব!

ভাবছেন, মস্তিষ্ক না থাকলে মানুষ বাঁচে কী করে? এটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। আলেক্স বেঁচে আছে কারণ তার মস্তিষ্কের ব্রেনস্টেম অংশটি পুরোপুরি অক্ষত আছে। ব্রেনস্টেম হলো শরীরের অটোপাইলট সিস্টেম। এটি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, শরীরের তাপমাত্রা এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। আলেক্সের এই অংশটি কাজ করছে বলেই সে এখনো বেঁচে আছে।

আরও পড়ুন
মানুষের মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় ও প্রধান অংশ সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার। মস্তিষ্কের এই অংশটি দিয়েই আমরা চিন্তা করি, নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করি, দেখি বা শুনি। আলেক্সের ক্ষেত্রে এই পুরো অংশটাই গায়েব!

আলেক্সের বাবা শন সিম্পসন বলেন, ‘ওর মস্তিষ্কের পেছনের অংশটুকু এতই ছোট যে, তা আমার হাতের কড়ে আঙুলের অর্ধেক হবে। এটুকুই ওর সম্বল।’

এছাড়া তার মস্তিষ্কের বেসাল গ্যাংলিয়া এবং মেনিনজেস নামে পর্দা কিছুটা টিকে আছে, যা তাকে নড়াচড়া ও অনুভূতিতে সামান্য সাহায্য করে।

তবে এসব ব্যাপার শুরুতে বোঝা যায়নি। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা জন্মের সময় দেখতে একদম স্বাভাবিক হয়। তাদের মাথার আকার ঠিক থাকে, রিফ্লেক্সও কাজ করে। তাই আলেক্সের জন্মের সময় কেউ বুঝতেই পারেনি, তার মগজ প্রায় নেই।

সমস্যা শুরু হয় কিছুদিন পর। শিশু অতিরিক্ত কান্নাকাটি করে, খিটখিটে হয়ে যায়, পেশি শক্ত হয়ে যায়, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে। আলেক্সের ক্ষেত্রেও দুই মাস বয়সে এসব লক্ষণ দেখেই ডাক্তাররা রোগটি ধরতে পেরেছিলেন।

সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার না থাকায় আলেক্স চোখে ঠিকমতো দেখতে পায় না, কানেও সমস্যা আছে। কিন্তু তার বাবা-মা বলছেন, তাদের সঙ্গে আলেক্সের যোগাযোগ খুব গভীর।

তার বাবা বলেন, ‘সে তার মা, বাবা ও ছোট ভাইকে ঠিকই চেনে। আমাদের আশপাশে ভালো কিছু ঘটলে সে খুশি হয়, আবার খারাপ কিছু ঘটলে সে তা অনুভব করতে পারে।’ অর্থাৎ, বুদ্ধিমত্তা না থাকলেও অনুভূতির জগত তার আছে।

আরও পড়ুন
হাইড্রোএনসেফালি রোগে আক্রান্ত শিশুরা জন্মের সময় দেখতে একদম স্বাভাবিক হয়। তাদের মাথার আকার ঠিক থাকে, রিফ্লেক্সও কাজ করে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন হয়? মায়ের পেটে থাকার সময় ভ্রূণের মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এমনটা হতে পারে। কোনো ইনফেকশন বা রক্তনালীর সমস্যার কারণেও এমনটা হয়। তবে খুব কম ক্ষেত্রে এটি জিনগত কারণেও হতে পারে।

পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১ জনের এই রোগ হতে পারে। আমেরিকায় এই হার আরও কম, প্রতি আড়াই লাখে ১ জন। দুঃখের বিষয় হলো, এসব শিশু বেশিরভাগই মায়ের পেটে বা জন্মের পরপরই মারা যায়।

হাইড্রোসেফালাসে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কের স্ক্যানের একটি ছবি
ছবি: ফিউইলেট ইত্যাদি/দ্য ল্যানসেট

অনেকে এই রোগটিকে হাইড্রোসেফালাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু দুটি রোগ এক নয়। হাইড্রোসেফালাস মস্তিষ্কে থাকে, কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতরে পানি জমে চাপ সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে হাইড্রোএনসেফালি মস্তিষ্কের প্রধান অংশটিই তৈরি হয় না বা নষ্ট হয়ে যায় এবং সেই ফাঁকা জায়গা পানি দিয়ে ভরা থাকে।

আলেক্সের রোগটি দ্বিতীয়টি, যার কোনো চিকিৎসা নেই। নিবিড় যত্ন, ভালোবাসা আর পরিবারের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরেই আলেক্স আজ ২০ বছর বয়সে পা দিয়েছে। সে কথা বলতে পারে না, হাঁটতে পারে না, কিন্তু সে প্রমাণ করেছে; বেঁচে থাকার জন্য সবসময় মস্তিষ্ক লাগে না, মাঝেমধ্যে ভালোবাসাই যথেষ্ট।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট

আরও পড়ুন