কাঠঠোকরা কীভাবে শক্ত গাছ ফুটো করে
বনে-জঙ্গলে হাঁটার সময় কখনো ঠক ঠক ঠক শব্দ শুনেছেন? আওয়াজটা এতটাই জোরে হয় যে মনে হয় কেউ বুঝি কুড়াল বা হাতুড়ি দিয়ে গাছ কাটছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলে চক্ষু চড়কগাছ! ওটা কোনো কাঠুরিয়া নয়, বরং হাতের মুঠোয় এঁটে যায় এমন এক পিচ্চি পাখি কাঠঠোকরা।
৩০ গ্রামের মতো একটা পাখি, অথচ সে তার ওইটুকু মাথা দিয়ে বিশাল সব গাছে গর্ত করে ফেলছে! ওদের কি মাথা ধরে না? ঘাড় মচকায় না? এত শক্তি ওরা পায় কোত্থেকে?
এত দিন বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এই জাদুর পেছনে আছে ওদের ঘাড়ের শক্তিশালী পেশি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এবার জানালেন এক নতুন তথ্য। তাঁরা বলছেন, কাঠঠোকরা শুধু মাথা বা ঘাড় দিয়ে নয়, বরং গাছের গায়ে বাড়ি মারে তার পুরো শরীর দিয়ে!
জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজিতে প্রকাশিত এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আমেরিকার সবচেয়ে ছোট প্রজাতির কাঠঠোকরা ডাউনি উডপেকারের ওপর নজর রেখেছিলেন। হাই-স্পিড ক্যামেরা দিয়ে প্রতি ৪ মিলি-সেকেন্ডের ভিডিও ফ্রেম বিশ্লেষণ করে তাঁরা যা দেখলেন, তা এককথায় অবিশ্বাস্য।
গবেষণার প্রধান লেখক নিকোলাস অ্যান্টনসন বলছেন, ‘কাঠঠোকরা যখন গাছে ঠোকর দেয়, তখন সে তার ঘাড়, কোমর, পেট এবং লেজ একসঙ্গে ব্যবহার করে ।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন, কাঠঠোকরা শুধু মাথা বা ঘাড় দিয়ে নয়, বরং গাছের গায়ে বাড়ি মারে তার পুরো শরীর দিয়ে!
ব্যাপারটা অনেকটা একজন মানুষের হাতুড়ি পেটার মতো। আমরা যখন হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকি, তখন আঘাতের মুহূর্তে কবজি শক্ত করে ফেলি। কাঠঠোকরাও ঠিক আঘাতের মুহূর্তে তার ঘাড় শক্ত করে ফেলে এবং পুরো শরীরের ভর দিয়ে আঘাতটা করে।
কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল। আপনি কি কখনো টেনিস খেলা দেখেছেন? খেয়াল করবেন, রাফায়েল নাদাল বা জকোভিচ যখনই জোরে বল হিট করেন, মুখ দিয়ে একটা ‘উহ’ বা ‘গ্রান্ট’ শব্দ করে বাতাস ছেড়ে দেন। কাঠঠোকরাও ঠিক এই কাজটাই করে! প্রতিবার ঠোকর দেওয়ার সময় তারা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। এতে তাদের পেশিগুলো আরও বেশি শক্তি পায়।
কাঠঠোকরা যখন টানা ঠক-ঠক করতে থাকে, তখন তারা সেকেন্ডে প্রায় ১৩ বার পর্যন্ত ঠোকর দেয়। আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ১৩ বারের প্রতিবারই তারা ছোট্ট করে শ্বাস নেয় এবং ছাড়ে।
গান গাওয়া পাখিরা সুর তোলার জন্য এমনটা করে বলে জানা ছিল। কিন্তু কাঠ কাটার কাজেও যে শ্বাস-প্রশ্বাসের এমন ব্যবহার হতে পারে, তা এই প্রথম জানা গেল।
কাঠঠোকরা যখন টানা ঠক-ঠক করতে থাকে, তখন তারা সেকেন্ডে প্রায় ১৩ বার পর্যন্ত ঠোকর দেয়। আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ১৩ বারের প্রতিবারই তারা ছোট্ট করে শ্বাস নেয় এবং ছাড়ে।
গবেষকরা মেপে দেখেছেন, কাঠঠোকরা তার নিজের ওজনের ২০ থেকে ৩০ গুণ বেশি শক্তিতে গাছে আঘাত করে। একটা ছোট্ট পাখির জন্য এটা অকল্পনীয় শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির সহ-গবেষক ম্যাথিউ ফাক্সজেগার বলছেন, ‘এটা শুধু গায়ের জোরের ব্যাপার নয়। এটা হলো টাইমিং এবং স্কিলের খেলা।’ তিনি এর তুলনা দিয়েছেন গানের প্রতিযোগিতার সঙ্গে। আমরা যখন কোনো গায়ককে বিচার করি, তখন শুধু তার গলার জোর দেখি না। দেখি সে কীভাবে সুর, তাল আর শ্বাসের সমন্বয় করছে কাঠঠোকরার ঠোকরও ঠিক তেমন। এটি নিখুঁতভাবে শারীরিক কসরত করে।
প্রকৃতির এই ছোট্ট প্রকৌশলী আমাদের আবারও প্রমাণ করে দিল যে আকার কোনো ব্যাপার নয়। যদি আপনার টেকনিক বা কৌশল সঠিক হয়, তবে আপনিও পাহাড়ও টলিয়ে দিতে পারেন।
কাঠঠোকরার এই পুরো শরীর দুলিয়ে, টেনিস প্লেয়ারের মতো নিঃশ্বাস ছেড়ে গাছ ফুটো করার দৃশ্যটি মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টিই একেকজন সুপারহিরো। এদের সুপারপাওয়ার লুকিয়ে আছে তাদের কৌশলে।