পাখি টানা কতদিন আকাশে উড়তে পারে
১০-১৫ ঘণ্টা বিমান বা আরামদায়ক বাসে চড়লেও আমাদের অনেকের কোমরে ব্যথা শুরু হয়। টানা এত ঘণ্টা সিটে বসে থাকা কি চাট্টিখানি কথা? আমরা তো তাও সিটে বসে থাকি, আরাম করি। কিন্তু যদি আপনাকে বলা হয়, হাত দুটোকে ডানার মতো ছড়িয়ে টানা ১০ মাস শূন্যে ভেসে থাকতে হবে? কোনো বিশ্রাম নেওয়া যাবে না, মাটিতে পা ফেলা যাবে না!
শুনেই নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে। মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব হলেও, প্রকৃতির রাজ্যে এমন এক জাদুকর পাখি আছে, যার কাছে এটা ডালভাত। নাম তার কমন সুইফট।
এই পাখিটি টানা ১০ মাস আকাশে ওড়ার ক্ষমতা রাখে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন—১০ মাস বা প্রায় ৩০০ দিন! একবারের জন্যও মাটিতে ল্যান্ড করে না!
ওয়েলশ পক্ষীবিদ রোনাল্ড লকলে সেই ১৯৭০ সালেই সন্দেহ করেছিলেন যে, কমন সুইফটরা হয়তো বাতাসের মধ্যেই তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তখন তো আর পাখির পিঠে জিপিএস বসানোর প্রযুক্তি ছিল না, তাই প্রমাণ করা যায়নি।
অবশেষে ২০১৬ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক ঠিক করলেন, এই রহস্যের সমাধান করেই ছাড়বেন। তারা ১৩টি পূর্ণবয়স্ক কমন সুইফটের পিঠে একদম ছোট সাইজের ডেটা লগার বসিয়ে দিলেন। এতে ছিল অ্যাক্সিলোমিটার এবং লাইট সেন্সর। অ্যাক্সিলোমিটার ওড়ার গতিবিধি মাপে আর তাদের অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে লাইট সেন্সর।
ওয়েলশ পক্ষীবিদ রোনাল্ড লকলে সেই ১৯৭০ সালেই সন্দেহ করেছিলেন যে, কমন সুইফটরা হয়তো বাতাসের মধ্যেই তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দেয়।
পাখিগুলো যখন শীতকালে সুইডেন থেকে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে পরিযায়ী হয়ে চলে গেল এবং আবার ফিরে এল, তখন তাদের পিঠের ওই ছোট যন্ত্রটি বিজ্ঞানীদের সামনে এক অবিশ্বাস্য সত্য তুলে ধরল।
ডেটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, এই পাখিগুলো বছরে মাত্র দুই মাস মাটিতে থাকে। সেটা শুধুই প্রজনন বা বাচ্চা ফোটানোর সময়। বাকি ১০ মাস এরা আকাশেই থাকে!
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু পাখি মাঝে মাঝে হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য কোথাও বসেছিল, কিন্তু গড় হিসেবে তারা তাদের সময়ের ৯৯.৫ শতাংশই কাটিয়েছে শূন্যে ভেসে। আর ১৩টি পাখির মধ্যে ৩টি পাখি তো আক্ষরিক অর্থেই টানা ১০ মাস একবারের জন্যও মাটি স্পর্শ করেনি!
ভাবতে পারেন? মাত্র ৪০ গ্রাম ওজনের একটা ছোট্ট পাখি, অথচ তার স্ট্যামিনা বা দম যেন অফুরন্ত!
এখন প্রশ্ন হলো, যারা ১০ মাস উড়ল আর যারা মাঝেমধ্যে একটু বসল, তাদের মধ্যে পার্থক্য কী? গবেষকরা বলছেন, এর রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের পালকে।
যে পাখিগুলো আকাশে টানা ছিল, তাদের ডানার পালকগুলো ছিল নতুন এবং চকচকে। অর্থাৎ, সেগুলোর ওড়ার দক্ষতা ছিল বেশি। আর যারা মাঝেমধ্যে ল্যান্ড করেছে, তাদের পালক বদলানোর প্রক্রিয়া তখনো শেষ হয়নি। পালক ভালো থাকলে ওড়ার জন্য শক্তি কম খরচ হয়, তাই তারা নামার প্রয়োজনই বোধ করেনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু পাখি মাঝে মাঝে হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য কোথাও বসেছিল, কিন্তু গড় হিসেবে তারা তাদের সময়ের ৯৯.৫ শতাংশই কাটিয়েছে শূন্যে ভেসে।
গবেষক অ্যান্ডার্স হেজেনস্ট্রম বলেন, ‘কমন সুইফটরা ধীরে ধীরে নিজেদের এমনভাবে গড়ে তুলেছে যে, এরা খুব কম শক্তিতে উড়তে পারে। এদের শরীরটা একদম সরু এবং ডানাগুলো লম্বা ও চিকন। ফলে বাতাস কেটে এগোতে তাদের খুব একটা কষ্ট হয় না।’
সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা আপনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এবার সেই প্রসঙ্গে আসি। এই পাখিরা কি ঘুমায় না? মানুষ যেমন প্লেনে বসে একটু ঝিমিয়ে নেয়, এরাও কি তাই করে?
খাওয়ার ব্যাপারটা সহজ। এরা আকাশেই উড়ন্ত পোকামাকড় খেয়ে পেট ভরায়। কিন্তু ঘুম? এটা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে এক অমীমাংসিত রহস্য। তবে হেজেনস্ট্রমের ধারণা, এরা সম্ভবত ফ্রিগেট বার্ডের মতো ওড়ার মধ্যেই ঘুমিয়ে নেয়।
ব্যাপারটা হলো পাওয়ার ন্যাপের মতো। প্রতিদিন ভোর এবং গোধূলি বেলায় এই পাখিগুলো প্রায় ২-৩ কিলোমিটার ওপরে উঠে যায়। সেখান থেকে ডানা মেলে নিচে নামার সময় তারা হয়তো কয়েক মিনিটের জন্য ঘুমিয়ে নেয়। ডানা না ঝাপটে বাতাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েই তাদের বিশ্রাম হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা ২০১৬ সালে কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে এই গবেষণা প্রকাশ করার পর থেকে এই পাখিগুলো আরও জনপ্রিয় হয়ে গেছে।