নতুন এই রক্ত পরীক্ষায় ক্যানসার ধরা পড়বে ১০ বছর আগে
বিশ্বে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ মাথা ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এর পেছনে দায়ী একটি ভাইরাস, যার নাম হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের মাথা ও গলার ক্যানসারের জন্য এই এইচপিভি ভাইরাসই দায়ী। ভয়ের ব্যাপার হলো, এ ধরনের ক্যানসারের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে।
জরায়ুমুখের ক্যানসার হলে তা নিয়মিত স্ক্রিনিং টেস্টের মাধ্যমে আগে থেকেই ধরা পড়ে। কিন্তু মাথা ও গলার এইচপিভি ক্যানসারের ক্ষেত্রে এমন কোনো পরীক্ষা এতদিন ছিল না। ফলে রোগীরা যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, ততক্ষণে টিউমার বিশাল আকার ধারণ করে। কোষের সংখ্যা বেড়ে পৌঁছায় কোটিতে। অনেক সময় ক্যানসার আশপাশের লিম্ফ নোডেও ছড়িয়ে পড়ে। তখনই কেবল উপসর্গ দেখা দেয় এবং রোগী তা টের পান। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে চিকিৎসা দেওয়া খুব জটিল হয়ে পড়ে। যদি এই ক্যানসার অনেক আগেই ধরা যেত, তাহলে চিকিৎসা সহজ হতো এবং সফলতার হারও বাড়ত বহুগুণ।
এবার সেই স্বপ্নই বাস্তব হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাস জেনারেল ব্রিঘাম নামে একটি স্বনামধন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা একটি বিশেষ রক্তের পরীক্ষা তৈরি করেছেন। এর নাম এইচপিভি-ডিপসিক। এই পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো উপসর্গ দেখা দেওয়ার ১০ বছর আগেই এইচপিভিজনিত মাথা ও গলার ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব। এই যুগান্তকারী গবেষণার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল অব দ্য ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট-এ প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণা চিকিৎসাজগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের মাথা ও গলার ক্যানসারের জন্য এই এইচপিভি ভাইরাসই দায়ী।ভয়ের ব্যাপার হলো, এ ধরনের ক্যানসারের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে।
গবেষণার প্রধান লেখক ড্যানিয়েল এল ফেইডেন বলেন, ‘এই প্রথমবারের মতো আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে, উপসর্গহীন মানুষের শরীরেও এইচপিভি-সংক্রান্ত ক্যানসার নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা সম্ভব; এমনকি রোগ নির্ণয়ের বহু বছর আগেই। রোগীরা যখন উপসর্গ নিয়ে আসেন, তখন এমন সব চিকিৎসা দিতে হয়, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সারাজীবন থাকে। কিন্তু নতুন এই পরীক্ষা থাকলে ক্যানসার একদম শুরুর পর্যায়েই ধরা পড়বে। ফলে চিকিৎসা যেমন কার্যকর হবে, তেমনই রোগীর জীবনযাত্রার মানও ভালো থাকবে।’
এবার জেনে নেওয়া যাক, এই বিশেষ পরীক্ষা কীভাবে কাজ করে। এইচপিভি-ডিপসিক একটি ‘লিকুইড বায়োপসি’ টেস্ট। অর্থাৎ, এটি একটি রক্ত পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় হোল-জিনোম সিকোয়েন্সিং নামে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। টিউমার থেকে যখন এইচপিভি ডিএনএর ছোট ছোট টুকরো রক্তে মিশে যায়, এই পরীক্ষা সেই চিহ্নগুলোই খুঁজে বের করে। কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও কাজটি খুব জটিল। কারণ, রক্তে এই ডিএনএর পরিমাণ খুব কম থাকে।
এই গবেষক দলের আগের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ক্যানসার নির্ণয়ের সময় এই পরীক্ষার নির্ভুলতা ছিল ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনেরই সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়। কোনো সুস্থ মানুষকে ভুল করে ‘পজিটিভ’ দেখানোর হার মাত্র ১ শতাংশ। এই হার বিদ্যমান সব পরীক্ষা পদ্ধতিকে ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, উপসর্গ দেখা দেওয়ার অনেক আগে, যখন ক্যানসার একদম প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে, তখনো কি এই পরীক্ষা কাজ করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষকেরা ম্যাস জেনারেল ব্রিঘাম বায়োব্যাংক থেকে সংরক্ষিত ৫৬টি রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে ২৮টি নমুনা ছিল এমন মানুষের, যাঁরা পরে এইচপিভি-সংক্রান্ত মাথা ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাকি ২৮টি নমুনা নেওয়া হয়েছিল সুস্থ মানুষদের কাছ থেকে।
এইচপিভি-ডিপসিক একটি ‘লিকুইড বায়োপসি’ টেস্ট। অর্থাৎ, এটি একটি রক্ত পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় হোল-জিনোম সিকোয়েন্সিং নামে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। যাঁরা পরে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই ২৮ জনের মধ্যে ২২ জনের রক্তের নমুনায় ‘এইচপিভি-ডিপসিক’ পরীক্ষাটি টিউমার ডিএনএ শনাক্ত করতে পেরেছে। অন্যদিকে, সুস্থ ২৮টি নমুনার সবগুলোই ‘নেগেটিভ’ এসেছে। অর্থাৎ, এই পরীক্ষা একজন সুস্থ মানুষকেও ভুল করে ক্যানসার রোগী বলেনি। এটাই এর সবচেয়ে বড় শক্তি। গবেষকেরা আরও দেখেছেন, রোগ নির্ণয়ের কাছাকাছি সময়ে সংগ্রহ করা নমুনায় এইচপিভি ডিএনএ শনাক্ত করা সহজ ছিল। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, রোগ নির্ণয়ের ৭ বছর ৮ মাস আগে সংগ্রহ করা একটি নমুনায় তাঁরা ক্যানসারের ডিএনএ খুঁজে পেয়েছেন।
কিন্তু গবেষকেরা এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁরা মেশিন লার্নিং বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে এই পরীক্ষার ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছেন। এই উন্নত পদ্ধতিতে ২৮ জনের মধ্যে ২৭ জনের ক্যানসার সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আর মজার ব্যাপার হলো, রোগ নির্ণয়ের পুরো ১০ বছর আগে সংগ্রহ করা রক্তের নমুনাতেও ধরা পড়েছে ক্যানসারের চিহ্ন।
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বোঝাতে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, কোনো একজন মানুষের শরীরে আজ ক্যানসারের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তিনি হয়তো গলায় ব্যথা বা ফোলা অনুভব করছেন। ডাক্তারের কাছে গেলে জানা যাবে, তাঁর শরীরে ক্যানসার কোষের সংখ্যা এখন কয়েক বিলিয়ন। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হবে রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি বা অপারেশন। এসব চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সারাজীবন থাকে। কিন্তু যদি ১০ বছর আগে একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যেত যে তাঁর শরীরে ক্যানসার শুরু হচ্ছে, তাহলে সেই প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা দেওয়া যেত। তখন হয়তো ছোট্ট একটি অপারেশনই যথেষ্ট হতো এবং রোগীর জীবনযাত্রার মানও থাকত অটুট।
গবেষকেরা দেখেছেন, রোগ নির্ণয়ের কাছাকাছি সময়ে সংগ্রহ করা নমুনায় এইচপিভি ডিএনএ শনাক্ত করা সহজ ছিল। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, রোগ নির্ণয়ের ৭ বছর ৮ মাস আগে সংগ্রহ করা একটি নমুনায়ও তাঁরা ক্যানসারের ডিএনএ খুঁজে পেয়েছেন।
গবেষকেরা এখন তাঁদের এই আবিষ্কারের সত্যতা যাচাই করছেন আরও বড় পরিসরে। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে তাঁরা আরেকটি বিশাল গবেষণা পরিচালনা করছেন। এবার তাঁরা পরীক্ষা করছেন শত শত রক্তের নমুনা। এই নমুনাগুলো ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের একটি বিশাল স্ক্রিনিং ট্রায়াল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেখানে প্রোস্টেট, ফুসফুস, কোলোরেক্টাল এবং ডিম্বাশয়ের ক্যানসার নিয়ে গবেষণা চলছিল। এই দ্বিতীয় গবেষণাটি ‘ব্লাইন্ডেড’ পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। অর্থাৎ, যারা পরীক্ষা করছেন, তাঁরা জানেন না কোন নমুনা ক্যানসার রোগীর আর কোনটা সুস্থ মানুষের। এতে ফলাফলের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
এই আবিষ্কারের তাৎপর্য শুধু আমেরিকার জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্যই অসাধারণ। কারণ, এইচপিভি ভাইরাস এখন বিশ্বব্যাপী একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের সুবিধা সীমিত, সেখানে এই ধরনের একটি সহজ রক্ত পরীক্ষা জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। এমন দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নেই, যখন নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে এই টেস্টটি অন্তর্ভুক্ত হবে; ঠিক যেমন এখন আমরা ডায়াবেটিস বা কোলেস্টেরলের পরীক্ষা করি।
তবে গবেষকেরা এখনো সতর্ক। তাঁরা জানান, এখনো অনেক কাজ বাকি। আরও বড় পরিসরে, আরও বেশি মানুষের ওপর এই পরীক্ষা চালাতে হবে। তবে প্রাথমিক ফলাফল যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই পরীক্ষা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হবে। তখন ‘ক্যানসার’ শব্দটি হয়তো আর এতটা ভীতিকর শোনাবে না। কারণ তখন অনেক আগে থেকেই ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ আমাদের জানা থাকবে।