কোনো কিছু বড় হয়ে উঠলে আমরা তাকে অনেক সময় ঢোলের সঙ্গে তুলনা করি, বলি ঢোলের মতো ফুলে গেছে অথবা ফুলে ঢোল হয়েছে। আর সমুদ্র তো বিশাল। তেমনি ঢোলসমুদ্রগাছের পাতা এত বড় যে মানকচু-মৌলভিকচু ছাড়া আর খুব কম গাছের পাতাই এত বড় দেখা যায়। মনে হয় বাংলা ঢোলসমুদ্র নামটি এসেছে সংস্কৃত নাম সমুদ্রিকা থেকে। পাতা দেখতেও খানিকটা হাতির কানের মতো। এ জন্য এর আরেক নাম হস্তীকর্ণপলাশ, মারাঠি নাম গজকর্ণী। অন্য নাম হাতিকানা, ইংরেজি নাম ডিনডা। বুনো গাছ হলেও খাদ্য, ওষুধ ও রং উত্পাদনের জন্য এ গাছের চাষ করা হয়। এ গাছের পাতা সবজির মতো রান্না করে খাওয়া যায়। কাঁচা ফলও খাওয়া যায়। দুর্ভিক্ষের খাদ্য হিসেবে ঢোলসমুদ্রগাছের পরিচিতি রয়েছে। মূল থেকে রং তৈরি হয়, যা আদিবাসীরা কাপড়ে রং করতে ব্যবহার করে। প্রাচীনকালে মিসরে নিদ্রাহীনতার জন্য এ গাছের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া এ গাছের বেশ কিছু ভেষজ ব্যবহার রয়েছে। ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র–তে এ গাছের অর্থনৈতিক গুরুত্বের উল্লেখ রয়েছে। এটিই উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন বলে উল্লেখ। ভেলা সংহিতা ও চরক সংহিতা গ্রন্থেও এ গাছের ভেষজগুণ ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে এ গাছ রয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ায় এ গাছ ঔষধি হিসেবে চাষ করা হয়। সাধারণত বনজঙ্গলে জন্মে। বছর বারো আগে প্রথম এ গাছটিকে দেখেছিলাম নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে। পরে ঘুরতে গিয়ে দেখি নাটোরের খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীখোলা গ্রামে এর চাষ হচ্ছে। ঔষধি গ্রাম নামে খ্যাত সে গ্রামে এখনো এর চাষ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে এবং ঢাকা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও এ গাছ আছে। এ দেশে এ গাছ খুব কম দেখা যায়। সাধারণত শাল-সেগুনবনে এ গাছ বেশি দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে এ গাছ আছে। রাজশাহী, যশোর ও ঢাকার সাভারেও এ গাছ আছে। ঢোলসমুদ্রগাছের দেখা পাওয়া যায় দিনাজপুর ও গাজীপুরের অরণ্যে।
পাতা দেখতেও খানিকটা হাতির কানের মতো। এ জন্য এর আরেক নাম হস্তীকর্ণপলাশ, মারাঠি নাম গজকর্ণী। অন্য নাম হাতিকানা, ইংরেজি নাম ডিনডা। বুনো গাছ হলেও খাদ্য, ওষুধ ও রং উত্পাদনের জন্য এ গাছের চাষ করা হয়।
ঢোলসমুদ্র একটি বহুবর্ষজীবী গুল্ম প্রকৃতির গাছ। কন্দজ মূল। এর কাঠ নরম বা কাণ্ড কম কাষ্ঠল। গাছের উচ্চতা ১ থেকে ২ মিটার। এর বেশিও বড় হতে পারে। পাতা যতটা লম্বা, ঠিক ততটাই যেন চওড়া। পরের পাতাগুলো ছোট, নিচের পাতাগুলো বড়। নিচের পাতা ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। একটি পাতায় একটি মানুষ আসন পেতে দিব্যি বসে থাকতে পারে। পাতা বেশ বড়, ডিম্বাকার, বোঁটার কাছে হৃৎপিণ্ডের মতো খাঁজকাটা, পাতার বোঁটা শক্ত ও মোটা, পাতার কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা। পাতার এই আকার-আকৃতির জন্যই এ গাছের নাম ঢোলসমুদ্র ও হস্তীকর্ণপলাশ রাখা হয়েছে। ফুল ধূসর সবুজ, ক্ষুদ্র, খোঁপার মতো একটা থোকায় অনেকগুলো ফুল ফোটে। ফুল ও ফল হয় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে। ফল বেরি প্রকৃতির, গ্লোবাকার বা গোল, ফলের ভেতরে ছয়টি বীজ থাকে। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Leea macrophylla Roxb.ex Hornem. ও পরিবার লিয়েসি।
এ গাছের শিকড় দেহের কাটা ক্ষত ও হাড়চটা চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়। ব্যথা–বেদনারও উপশম করে। এ গাছের সংকোচক ও জীবাণুবিনাশী ধর্ম রয়েছে। বাংলাদেশি গবেষক জোবায়ের আল মাহমুদ, সীতেশ চন্দ্র বাছাড় ও তাঁদের সহযোগী গবেষকেরা প্রথম এ গাছের শিকড়ে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও ফেনোলিক যৌগের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন তাঁদের লেখা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বিএমসিতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে। এসব রাসায়নিক উপাদান, বিশেষ করে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ক্যানসার, ডায়াবেটিস, বুড়িয়ে যাওয়া ও স্নায়ুবৈকল্য প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। গবেষণায় শিকড়ে পাওয়া গেছে দুটি ট্রাইটারপিনয়েড, ওলিয়ানোলিক অ্যাসিড, ৭-, ২৮-ওলিন ও একটি স্টেরল, স্টিগমাস্টেরল।
পাতায় যথেষ্ট পরিমাণে ফেনোলিক যৌগ যেমন ফ্লাভিনয়েডস, লিউকো অ্যান্থোসায়ানাইডিনস, পি-হাইড্রোক্সিবেনজোইক অ্যাসিড, সিরিঞ্জিক অ্যাসিড ও গ্যালিক অ্যাসিড রয়েছে। এমবি ইসলাম ও তাঁর সহযোগীরা গবেষণা করে এ গাছের ভেতরে বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান পেয়েছেন। সেড়ুলো মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। ফেনোলিক যৌগ, স্যাপোনিন, গ্লাইকোসাইড, প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটের মতো কিছু যৌগ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। তাঁরা এ গাছের নির্যাসের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য একটি গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া, তিনটি গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া ও একটি ছত্রাককে বেছে নেন। গবেষণায় দেখতে পান যে গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এ গাছের নির্যাস কার্যকর না হলেও অন্য দুটি জীবাণুর বিরুদ্ধে তা কার্যকর। তাঁদের এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে জার্নাল অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ–এ। যেকোনো বাতব্যথায় পাতার রস মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়। ক্ষত সারানোয় মূলচূর্ণ নারকেল তেলের সঙ্গে মাখিয়ে মলমের ওপর ক্ষতে প্রলেপ দিলে তা সেরে যায়। আন্ত্রিক টিউমার, ঘ্যাগ বা গলগণ্ড রোগ ও টিটেনাসের লোকচিকিত্সায় এ গাছের ব্যবহার রয়েছে বলে জানা যায়।
গলগণ্ড, অন্ত্রের টিউমার, লিপোমা, টিটেনাস, ক্যানসার, ক্ষত ও ঘা ইত্যাদি সারাতে ঢোলসমুদ্রগাছের পাতা ব্যবহার করা হয়। পাতার রস বাতব্যথা সারায়, কাটা স্থানের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
ডায়াবেটিস, বিশেষ করে ডায়াবেটিস মেলিটাস বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক মহাসমস্যা। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্যানুসারে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি ৬০ লাখ। ২০৩০ সালে তা দাঁড়াবে ৫৫ কোটি ২০ লাখে। রক্তের শর্করা বা চিনির মাত্রা বেড়ে যাওয়াই এর মূল কারণ। এর কারণে হৃদ্রোগ, যকৃৎ অকার্যকর হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ঢোলসমুদ্রগাছের অ্যান্টিডায়াবেটিক ধর্ম আছে বলে গবেষণায় জানা গেছে। ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন জার্নালের ২০১৮ সালে জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে লেখক মো. আতিউর রহমান ও সহযোগীরা লিখেছেন, মূত্রাশয়ের সমস্যায় বিহারের আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা ঢোলসমুদ্রগাছ ব্যবহার করে। গলগণ্ড, অন্ত্রের টিউমার, লিপোমা, টিটেনাস, ক্যানসার, ক্ষত ও ঘা ইত্যাদি সারাতে ঢোলসমুদ্রগাছের পাতা ব্যবহার করা হয়। পাতার রস বাতব্যথা সারায়, কাটা স্থানের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য এ গাছের মূল বেটে তা ১ গ্লাস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে এক মাস খেলে জন্মনিয়ন্ত্রণ হয়। মূল বাটা ক্ষতে পুলটিস দিলে তা সারে এবং কাটা স্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। গিনিওয়ার্ম ও রিংওয়ার্ম কৃমি দমনে এ গাছের মূল ব্যবহার করা হয়। এ গাছের পাতার গুঁড়া মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে তা ক্যানসার প্রতিরোধ করে। কাণ্ডের বাকল চূর্ণ খেলেও তা ক্যানসার চিকিত্সায় কাজ করে।