মহাদেশগুলোর নীচের স্তর কেন ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে

ছবির বাম দিকের অংশ ম্যান্টল স্তরের প্রচণ্ড তাপকে নির্দেশ করেছবি: গেটি ইমেজ

ধরুন, আপনি ভারত মহাসাগরের মাঝখানে কোনো এক নির্জন দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছেন। আশপাশে মাইলের পর মাইল শুধু পানি। কোনো মহাদেশ বা বিশাল ভূখণ্ডের নামনিশানা নেই। অথচ সেই দ্বীপের মাটি পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, সেখানকার পাথরগুলো কোনো বিশাল মহাদেশের অংশ!

ব্যাপারটা অদ্ভুত না? মহাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরের দ্বীপে মহাদেশীয় উপাদান এল কোথা থেকে? ভূতত্ত্ববিদেরা বহু বছর ধরে এই ধাঁধার উত্তর খুঁজছিলেন। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই রহস্যের জট খুলেছেন। তাঁরা বলছেন, পৃথিবীর মহাদেশগুলো আসলে নিচ থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে!

গবেষণাটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে। সেখানে বলা হয়েছে, পৃথিবীর মাটির ১৫০-২০০ কিলোমিটার গভীরে ঘটছে এক অদ্ভুত ঘটনা।

আমরা জানি, পৃথিবী কতগুলো বিশাল প্লেটের ওপর ভেসে আছে। একে বলা হয় টেকটনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো যখন সরে যায় বা মহাদেশগুলো যখন ভেঙে আলাদা হতে থাকে, তখন মাটির গভীরে থাকা উত্তপ্ত ম্যান্টল বা লাভা স্তরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ম্যান্টল ওয়েভ।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বলছেন, পৃথিবীর মহাদেশগুলো আসলে নিচ থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে! গবেষণাটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে।

ব্যাপারটা অনেকটা কাঠ চেঁছে ফেলার মতো। টেকটনিক প্লেট সরে যাওয়ার সময় এই ম্যান্টল ওয়েভ মহাদেশের তলদেশ থেকে উপাদান চেঁছে আলাদা করে ফেলে। এই প্রক্রিয়াটি কিন্তু চোখের পলকে ঘটে না। এটি চলে অত্যন্ত ধীরগতিতে। গবেষকরা তুলনা করে বলেছেন, শামুক যে গতিতে চলে, এই প্রক্রিয়াটি তার চেয়েও দশ লাখ গুণ ধীরে কাজ করে!

কিন্তু এই অতি ধীর গতিতেই মহাদেশের তলদেশ থেকে খসে পড়া উপাদানগুলো লাভা স্রোতের সঙ্গে মিশে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে ভেসে যায়। আর এভাবেই মহাদেশের পাথর বা খনিজ উপাদান সমুদ্রের মাঝখানের আগ্নেয়গিরি বা দ্বীপে গিয়ে জমা হয়।

কোটি কোটি বছর ধরে সমৃদ্ধ ম্যান্টেল কীভাবে জমা হয় তা চিত্রে দেখানো হয়েছে
ছবি: গারনন এবং অন্যান্য, ন্যাট। জিওসি

এতদিন বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, হয়তো সাবডাকশন প্রক্রিয়ায় এমনটা হয়। মানে একটি প্লেট আরেকটির নিচে ঢুকে গিয়ে গলে যায়। অথবা মাটির গভীর থেকে উঠে আসা লাভা এর জন্য দায়ী। কিন্তু সমস্যা হলো, সব জায়গায় এই তত্ত্ব মিলছিল না।

কারণ, সমুদ্রের তলদেশের অনেক জায়গায় এমন সব পাথরের মিশ্রণ পাওয়া গেছে, যা এই দুই প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। তবে নতুন এই গবেষণার ফলাফল সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, হয়তো সাবডাকশন প্রক্রিয়ায় এমনটা হয়। মানে একটি প্লেট আরেকটির নিচে ঢুকে গিয়ে গলে যায়। অথবা মাটির গভীর থেকে উঠে আসা লাভা এর জন্য দায়ী।

গবেষকেরা এই তত্ত্ব প্রমাণের জন্য ভারত মহাসাগরের নিচে লুকিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি এবং পাহাড়ের সারি পরীক্ষা করেছেন। বিশেষ করে ক্রিসমাস আইল্যান্ডের কথা গবেষণায় বলা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে যখন বিশাল সুপারকন্টিনেন্ট গন্ডোয়ানা ভেঙে আলাদা হচ্ছিল, তখন এই পিলিং প্রক্রিয়াটি ঘটেছিল। মহাদেশ ভেঙে যাওয়ার পরেও প্রায় ৫ কোটি বছর ধরে এই ম্যান্টল ওয়েভ সক্রিয় ছিল এবং মহাদেশীয় উপাদানগুলো সমুদ্রের তলদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল।

মহাদেশের স্ফটিকের শিকড় সরিয়ে দিলে, তা সমুদ্রের ম্যান্টলে পাশাপাশি ভেসে বেড়ায়-ভূতত্ত্বের এই নতুন রহস্য ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের
ছবি: টম গারনন

শুধু সমুদ্রের দ্বীপে মহাদেশের পাথর আছে তা-ই নয়, এই ম্যান্টল ওয়েভ আরও দুটি বিশাল কাজ করেছে, যা বিজ্ঞানীরা আগে জানতেন না। প্রথমত, মাটির গভীর থেকে হীরাসমৃদ্ধ ম্যাগমা বা লাভা ওপরে উঠে আসার পেছনেও এই ঢেউয়ের ভূমিকা আছে। আর দ্বিতীয়ত, এই ঢেউগুলো মহাদেশের সমতল অংশকে নিচ থেকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচু করে দিতে পারে। পৃথিবীর বড় বড় মালভূমি বা পাহাড় তৈরির পেছনেও এই ধীরগতির ঢেউয়ের ভূমিকা রয়েছে।

আসলে পৃথিবীটা বাইরে থেকে যত শান্ত মনে হয়, গভীরে ততটা নয়। পৃথিবীর গভীরে প্রতিনিয়ত চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। এই গবেষণা তারই এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করল।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট

আরও পড়ুন