অতি মহাদেশ প্যানজিয়া না ভাঙলে কী হতো

প্রাচীন পৃথিবীর কাল্পনিক মানচিত্রছবি: ইয়ান ওয়েবস্টার

কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবী দেখতে অন্যরকম ছিল। বিশাল সমুদ্রের মধ্যে ছিল প্যানজিয়া নামে এক অতি মহাদেশ। গ্রহের তিন ভাগের এক ভাগই ঢেকে ছিল এ ভূখণ্ড দিয়ে। কিন্তু প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি বছর আগে এ মহাদেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তৈরি হয় আজকের সাত মহাদেশ।

কেমন হতো যদি প্যানজিয়া না ভাঙত? আমাদের দেশটা কোথায় থাকত? জীবনটাই-বা কেমন হতো আমাদের? আসুন, কল্পনার রথে চড়ে এবার অতীত থেকে ঘুরে আসা যাক। বিজ্ঞানের যুক্তিতে খোঁজা যাক উত্তর।

বর্তমানের দেশগুলো প্যানজিয়াতে হতো একেবারে ভিন্নরকম। মাঝখানে সমুদ্র না থাকায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থাকত আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে যুক্ত। এশিয়ার উত্তরে থাকত রাশিয়া। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান হতো আরও দক্ষিণে, প্রায় অ্যান্টার্কটিকার কাছাকাছি। অ্যান্টার্কটিকার অবস্থান অবশ্য বদলাত না, দক্ষিণ মেরুতেই থাকত।

বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান বিষুবীয় অঞ্চলে হওয়ায় এখানে অনেকটা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। কিন্তু প্যানজিয়ার ক্ষেত্রে ঘটনা হতো অন্যরকম। দক্ষিণ মেরুর দিকে সরে যাওয়ায় হাড় কাঁপানো শীত হতো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তুষারপাত দেখা যেত হরহামেশা। তবে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন এত অল্পতে সীমাবদ্ধ থাকত না।

আরও পড়ুন

বিষুবীয় অঞ্চলের আশপাশে অতি মহাদেশের প্রান্ত ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকত রেইনফরেস্ট। ভেতরের দিকে এগোলে দেখা মিলত মরুভূমির। এমনটা হওয়ার কারণ, প্যানজিয়ার বিশাল স্থলভাগ।

সূর্যের তাপে সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত হয়ে তৈরি করে মেঘ। সেই মেঘ থেকে নামে বৃষ্টি। প্যানজিয়ার স্থলভাগ অনেক বড় হতো, তাই মেঘ উড়ে গিয়ে পৌঁছে যেত এর মাঝ বরাবর। ফলাফল, অনাবৃষ্টির কারণে জন্ম নিত এক বিশাল ভয়ংকর মরুভূমি। মানুষ বা অন্য প্রাণীর জন্য বেঁচে থাকা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ত সেখানে।

দক্ষিণের মতো উত্তরের আবহাওয়াতেও আসত পরিবর্তন। রাশিয়ার আবহাওয়া এখনকার চেয়ে অনেক উষ্ণ হতো অতি মহাদেশের সেই পৃথিবীতে। কিন্তু জীববৈচিত্র্যের অবস্থা কেমন হতো?

বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যে তেমন প্রভাব না পড়লেও ডাঙ্গায় তৈরি হতো ভিন্ন অবস্থা। খাদ্যশৃঙ্খলের ওপরের দিকের জীবগুলো টিকে যেত কালের পরিক্রমায়। বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন হতো তখনকার বাস্তুসংস্থান। হয়তো মরুভূমিতে মানিয়ে নেওয়া শিখে যেত অনেক প্রাণী। আবার অনেকেই হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত চিরতরে। বর্তমানের মতো এত বিচিত্র বাস্তুসংস্থান হয়তো থাকত না আধুনিক প্যানাজিয়ায়।

বাংলাদেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি না দিয়েই পৌঁছানো যেত আফ্রিকা বা আমেরিকা মহাদেশে। কানাডা আর ইংল্যান্ডের মতো দেশ থাকত কয়েক ঘণ্টা গাড়ি-দূরত্বে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্রও বদলে যেত। শুনে বেশ ভালো মনে হলেও, একদিক থেকে এটা বিপজ্জনক।

আরও পড়ুন

অনেক দেশের থাকত নতুন প্রতিবেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির সঙ্গে এসব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হতো, তা বলা কঠিন। (অবশ্য, সেই একক মহাদেশের পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র আদৌ পরাশক্তি হয়ে উঠত কি না, তাই বা কে জানে!) বর্তমানে দেশটির দুপাশ জুড়ে আছে বিশাল সমুদ্র। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সমুদ্র বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নতুন মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের জায়গায় থাকত আফ্রিকা মহাদেশ। দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ বর্তমানের মতো থাকলে পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয়াবহ হতো। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বল্প দূরত্ব; সবই কাজ করত বারুদ হিসেবে।

অথবা এসবের কিছুই হতো না। বরং পুরো পৃথিবীই তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। সম্মিলিত ঐক্য মানবসভ্যতাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে নিত আরও অনেক দূর। পৃথিবীটাই হয়তো একটা দেশ হতো। নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই কিছুই।

শেষ করার আগে সবচেয়ে মজার বিষয়টা বলা যাক। বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডটি একটি ব-দ্বীপ, এটা আমরা জানি। এর বেশির ভাগটা তৈরি হয়েছে পলি পড়ে। বহুদূর থেকে ভেসে এসে ভারত মহাদেশীয় পাত প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা খেয়েছে ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে। ফলে গড়ে উঠেছে তিব্বতের পর্বতাঞ্চল। সেই পর্বত থেকে নদী হয়ে পলি এসে জমেছে সমুদ্রের পাশের অঞ্চলে। এভাবে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সেই একক মহাদেশে কি এই প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটত দুটি মহাদেশীয় পাতের মধ্যে? গড়ে উঠত কি তিব্বত? সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডটির কি আদৌ জন্ম হতো? সম্ভবত না। এভাবে ফিরে ইতিহাসের দিকে তাকালে নানা ভাবনা উঁকি দেবে মাথায়। মন ভরে উঠবে কৃতজ্ঞতায় যে ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটেছিল। ভিন্ন কিছু হয়নি।

লেখক: প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: হোয়াটইফশো ডট কম, উইকিপিডিয়া

এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন

১. ব্ল্যাকহোলে পড়ে গেলে কী হবে?

২. চাঁদ না থাকলে কী হতো?

৩. পৃথিবীর ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হলে কী হতো?

৪. পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?

৫. সূর্যের ভর অর্ধেক হলে কি হত?

৬. পৃথিবীর দুটি চাঁদ থাকলে কী হতো?

৭. মহাকর্ষ না থাকলে কী হতো?

৮. জীবাশ্ম জ্বালানী না থাকলে কী হতো?

৯. পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ হলে কী হতো?

১০. পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকলে কী হতো?

১১. সপ্তাহ ধরে চোখের পলক না ফেললে কী হবে?

১২. মানব সভ্যতা টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?

১৩. পৃথিবী আলোর গতিতে ঘুরলে কী হতো?

১৪. সূর্যে নিউক্লিয়ার বোমা ফেললে কী হবে?

১৫. পৃথিবীর সমস্ত সাপ মারা গেলে কী হতো

১৬. মানুষের ঘাম না হলে কী হতো?

১৭. সৌরজগতে আরেকটা নক্ষত্র ঢুকে পড়লে কী হতো?

১৮. পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে কী হতো?

১৯. মানুষ পরমাণুর মতো ছোট হতে পারলে কী হতো?

২০. সূর্য পালসারে পরিণত হলে পৃথিবীর কী হতো?

২১. মানব সভ্যতা টাইপ টু সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?

২২. উড়োজাহাজের ভেতর সব যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?

২৩. সমস্ত রাস্তা সোলার প্যানেলে ঢাকলে কেমন হতো?

২৪. সূর্য নীল নক্ষত্র হলে কী হতো

২৫. সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার দ্বিগুণ হলে কী হতো?

২৬. মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৃথিবীর সব ময়লা ফেললে কী হতো?

২৭. লবণ না থাকলে কী হতো?

২৮. পৃথিবী আলোর বেগে ঘুরলে কী হতো?

২৯. মহাবিশ্বের সমস্ত হিলিয়াম হারিয়ে গেলে কী হতো?

৩০. সৌরজগতে বায়ুমণ্ডল থাকলে কী হতো?

৩১. কেপলার টুটুবি সৌরজগতের গ্রহ হলে কী হতো?

৩২. এক মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল না থাকলে কী হতো

৩৩. বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে কী হতো

৩৪. চাঁদে হ্যালির ধূমকেতু আছড়ে পড়লে কী হতো

৩৫. পৃথিবীর দুটি সূর্য থাকলে কী হতো

৩৬. পৃথিবী ঘনকাকৃতির হলে কী হতো

৩৭. মহাকাশ সাদা হলে কী হতো

৩৮. পাঁচ সেকেন্ডের জন্য অক্সিজেন না থাকলে কী হতো

৩৯. মানব সভ্যতা টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশন হলে কী হতো

৪০. সৌরজগতে ব্ল্যাকহোল ঢুকে পড়লে কী হতো

৪১. মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরলে কী হতো

৪২. কেমন হতো বিড়ালহীন পৃথিবী