লবণ না থাকলে কী হতো?

খুব সামান্য একটা জিনিস কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তার আদর্শ উদাহরণ লবণ। পৃথিবীর ইতিহাসে লবণকে ঘিরে কী হয়েছে, তার চেয়ে কী হয়নি, তা খুঁজে বের করা সহজ। লবণের নামে নামকরণ করা হয়েছে নানা দেশের শহরের। স্পেন, নরওয়ে, জর্ডান, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে রয়েছে ‘সল্ট’ নামের শহর। পাশের দেশ ভারতেও রয়েছে—সল্টলেক।

অর্থনীতি গড়ে উঠেছে লবণকে কেন্দ্র করে। হয়েছে যুদ্ধ। শুধু তাই নয়, আপনার-আমার বর্তমান জীবনটাও লবণের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। অতীতে কাজের মজুরি বা বেতন হিসেবে লবণ প্রদানের প্রচলনও ছিল। লবণ যেমন খাবার সংরক্ষণে কাজে লাগে, তেমনি সারিয়ে তুলতে পারে দেহের ক্ষত।

বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে লবণের প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি ব্যবহার আছে। খাবারের স্বাদ বাড়ানো থেকে শুরু করে বরফের গলনাঙ্ক বাড়ানো, চাষাবাদ, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পানিবিশুদ্ধ বা প্রক্রিয়াকরণ, রসায়নের বিভিন্ন গবেষণা এবং তেল ও গ্যাস শিল্পে লবণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে লবণ যেমন উপকারী, তেমনি ইতিহাসজুড়ে খলনায়ক হিসেবেও ঘুরেফিরে বারবার এসেছে লবণ।

খাবার লবণের রাসায়নিক নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। সোডিয়াম ও ক্লোরিন যুক্ত হয়ে এ লবণ তৈরি হয়। মজার বিষয় হলো, লবণ উপকারী হলেও সোডিয়াম বা ক্লোরিন আলাদাভাবে আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে ক্লোরিন। এটা মানুষের জন্য বিষাক্ত। যে লবণ ছাড়া আমরা একটা দিনও কল্পনা করতে পারি না, সেই লবণ ছাড়া আমাদের জীবন কেমন হতো, আসুন, জানার চেষ্টা করা যাক।

আরও পড়ুন

লবণ আমাদের শরীরে স্নায়বিক সংকেত পাঠাতে সাহায্য করে। ফলে মাংসপেশি সংকুচিত বা প্রসারিত হয়। আমরা কাজকর্ম করি। হৃৎপিণ্ড যে রক্ত সঞ্চালনে কার্যকর হয়, সেটাও এই লবণের কারণে। এর পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার হজম ও বিভিন্ন সংক্রামক জীবাণুর বিরুদ্ধের লড়াইয়ের কাজেও লবণ গুরুত্বপূর্ণ।

রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে গেলে শরীরে দেখা দিতে পারে ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, খিঁচুনি; এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর আমাদের জন্য সোডিয়ামের সবচেয়ে বড় উৎস খাবার লবণ। অর্থাৎ লবণ ছাড়া জীবনধারণ সহজ নয়।

একই কথা অতিরিক্ত লবণের বেলায়ও সত্যি। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যেতে পারে। আর ঘন রক্ত শরীরে ছড়িয়ে দিতে হৃৎপিণ্ডের আরও বেশি কাজ করতে হয়। তাই অতিরিক্ত লবণের কারণে ঘটতে পারে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ার মতো প্রাণঘাতী শারীরিক জটিলতা।

স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের দেহে প্রায় ৪০ চা-চামচ লবণ থাকে। পুরো দেহের প্রায় ০.৪ শতাংশই লবণ। তবে কাঁদলে, ঘামলে বা মূত্র ত্যাগ করলে এর পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে কমে যায়। যেটা পরে খাবারের মাধ্যমে আবার ঠিক করে নিতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দিনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ৩০০ মিলিগ্রাম লবণ গ্রহণ করা উচিত। এ পরিমাণ লবণ অবশ্য একটি চিপসের প্যাকেটের মধ্যেই থাকে। বুঝতেই পারছেন, বেশিরভাগই মানুষই প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করেন প্রতিদিন। এটা মোটেও উচিত নয়। তবে এসব শুনে আবার লবণ খাওয়া একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন

লবণ ছাড়া মানুষের জীবন কেমন হতে পারে, সেটা জানার জন্য ১৯৩০-এর দশকে একটি পরীক্ষা চালানো হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট ম্যাক্যানস এ পরীক্ষার জন্য ৪ জন স্বেচ্ছাসেবককে বেছে নেন। তাঁদের একটাই কাজ দেওয়া হয়, টানা ১০দিন কোনো লবণ খাওয়া যাবে না।

এজন্য প্রথমে ঘামের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরের লবণ সব বের করে নেওয়া হয়। তারপর সম্পূর্ণ লবণহীন খাবার দেওয়া হয় তাঁদের। অল্প সময়ের মধ্যেই এই স্বেচ্ছাসেবীরা বুঝতে পারেন, খাবারে আর কোনো স্বাদ পাচ্ছেন না তাঁরা।

ধীরে ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁদের দেহে। এমনকি খাবার গ্রহণও তাঁদের জন্য কঠিন পরিশ্রমের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। শরীরে দেখা যায় হাইপোনাট্রেমিয়ার লক্ষণ। শরীরে পর্যাপ্ত সোডিয়াম না থাকলে যে জটিলতা তৈরি হয়, তারই নাম হাইপোনাট্রেমিয়া। এ সময় রক্তকোষগুলো ফুলতে শুরু করে। পর্যাপ্ত লবণ না থাকায় কোষের পানি শোষণের পুরো বিষয়টি হয়ে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত। অতিরিক্ত পানি জমে কোষের আকার বেড়ে যায়। যথাসময়ে চিকিৎসা করা না হলে হাইপোনাট্রেমিয়ার ফলে খিঁচুনি, কোমা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

পরীক্ষাটি শেষে স্বেচ্ছাসেবকদের লবণাক্ত খাবার খেতে দেওয়া হয়। দেখা যায়, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁদের জিভে আবারও স্বাদ ফিরে এসেছে। শরীরেও ফিরছে শক্তি।

মাত্র ১০দিন লবণ ছাড়া মানুষের শারীরিক অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে কল্পনা করুন, লবণ না থাকলে আমাদের কী অবস্থা হতো। আক্ষরিক অর্থেই লবণ ছাড়া বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারতাম না আমরা।

আরও পড়ুন

শুধু মানুষই নয়, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্যও লবণ সমান গুরুত্বপূর্ণ। লবণ না থাকলে সমুদ্রে থাকত না কোনো উদ্ভিদ বা শৈবাল। ফলাফল হিসেবে পৃথিবীর অর্ধেক সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেত। মাটির উদ্ভিদগুলোও হতো বিপন্ন। বায়ুমণ্ডলে বেড়ে যেত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কমত অক্সিজেন। পুরো জলবায়ু হয়ে পড়ত ভীষণ চরম ভাবাপন্ন। অতিরিক্ত শীত বা গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ত ঘুর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

চরম আবহাওয়া, খাদ্যঘাটতি, অক্সিজেন স্বল্পতা—এসব প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো শারীরিক শক্তিও আমাদের থাকত না। কারণটাও সেই লবণ স্বল্পতা।

বুঝতেই পারছেন, লবণ আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। লবণ ছাড়া পুরো জীব জগতই হয়ে পড়ত বিপন্ন। অতিরিক্ত লবণ, বিশেষ করে কাঁচা লবণ শরীরের জন্য ক্ষতিকর, সে কথা যেমন সত্য; তেমনি লবণ ছাড়া পৃথিবী অচল, সেটাও আক্ষরিকভাবেই সত্য। প্রকৃতির অন্য সবকিছুর মতো লবণ ব্যবহারেও আমাদের তাই ভারসাম্য বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফ শো, উইকিপিডিয়া, জিওটারগিট ডট কম