সৌরজগতে বায়ুমণ্ডল থাকলে কী হতো?

আমরা যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শ্বাস নিই, তার প্রায় ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ২১ ভাগ অক্সিজেন আর বাকি ১ ভাগ অন্যান্য গ্যাস।

ধরুন, আপনি নভোচারী। আন্তর্জান্তিক মহাকাশ স্টেশনের বাইরের অংশে জরুরি মেরামত প্রয়োজন। এক হাতেই কাজটা করা সম্ভব। তাই আপনার কাঁধেই পড়ল দায়িত্বটা। নভোচারীর পোশাক পরে, নিরাপত্তামূলক তারের সঙ্গে তা যুক্ত করে নিয়ে ঝাঁপ দিলেন সীমাহীন মহাশূন্যে—মহাকাশে। স্পেস ওয়াকিং করে পৌঁছে গেলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। কাজ করছেন এক মনে। এমন সময় হঠাৎ হেলমেটের কাচ ভেঙ্গে চুরমার করে দিল পরিত্যক্ত কৃত্রিম উপগ্রহের ছোট্ট এক টুকরো। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার বদলে আপনি আবিষ্কার করলেন, দিব্যি শ্বাস নিতে পারছেন মহাকাশে। হঠাৎ করেই মহাশূন্য যেন ভরে গেছে বাতাসে!

হ্যাঁ, অবশ্যই ওপরের অংশটি কাল্পনিক। মহাশূন্যে বায়ুমণ্ডল থাকলে কেমন হতো, সেটাই বলছিলাম। ঠিক মহাশূন্যে নয়, সৌরজগতে। কারণ, মহাকাশ বা মহাবিশ্ব অসীম। বায়ুমণ্ডল থাকতে হবে কিছু একটাকে কেন্দ্র করে। আসুন ভেবে দেখি, সৌরজগতের চারপাশে বায়ুমণ্ডল থাকলে আসলে কী হতো।

আমরা যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে শ্বাস নিই, তার প্রায় ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন, ২১ ভাগ অক্সিজেন আর বাকি ১ ভাগ অন্যান্য গ্যাস। জীবন ধারণের জন্য অক্সিজেন গ্যাস এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের আণবিক বিস্তৃতি বেশ কম। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার ওপরে অক্সিজেন অণুর স্বাধীন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না বললেই চলে।

আরও পড়ুন

মহাকাশে অক্সিজেন ধুলিকণার সঙ্গে আবদ্ধ থাকে। হাইড্রোজেন অণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে পানি। তারপরও ধরা যাক, কোনো একভাবে মহাকাশে শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস তৈরি হলো হঠাৎ। হেলিওস্ফিয়ারজুড়ে এই পৃথিবীর মতো একই বায়ুমণ্ডল তৈরি হলো। চাঁদের বুকে অথবা গ্রহাণু বলয়ের মাঝে, যেখানেই যান না কেন, হেলমেট ছাড়াই আরামে শ্বাস নিতে পারছেন। বাস্তবে এরকম হলে কেমন হতো বিষয়টা? মহাকাশ কি আমাদের জন্য আরও সুখের জায়গা হতো? নাকি অস্তিত্বেই টান পড়ত?

হেলিওস্ফিয়ার হলো, সৌরমণ্ডলের সীমারেখা। যেখানে সূর্যের মহাকর্ষ বল আর নক্ষত্রের মতো শক্তিশালী থাকে না, সে অঞ্চলকেই হেলিওস্ফিয়ার বলে। এর ভেতরের অংশকে বলা হয় সৌরজগৎ।

সৌরজগতের নিকষ আঁধার ঘিরে বায়ুমণ্ডল গড়ে উঠলে নিঃসন্দেহে সেখানে শ্বাস নিতে সুবিধা হতো। কিন্তু এর বিনিময়ে তৈরি হতো কিছু বড় সমস্যা। যেমন আপনি সূর্য কিংবা অন্যান্য গ্রহের শব্দ শুনতে পেতেন। শূন্য মাধ্যমে শব্দ ছড়াতে পারে না। কিন্তু বায়ুমণ্ডলবিশিষ্ট এই সৌরজগতে সে সমস্যা নেই। এখানে শব্দ আসতে পারে অনেক দূর থেকে। ফলে আপনি সবকিছু শুনতে পারবেন।

আরও পড়ুন

সূর্য প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কে কাঁপছে। এই শব্দ এত বেশি যে পৃথিবীতে বসেই সূর্যের শব্দে বধির হওয়ার আশংকা আছে। পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে হলেও সূর্যের শব্দ আপনার কাছে পৌঁছাত ১২৫ ডেসিবল তীব্রতা নিয়ে। বিরামহীনভাবে। কল্পনা করুন, হাজারটা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দের মতো জোরে ঘন্টার ধ্বনি শুনছেন প্রতিমূহুর্তে। অনেকটা সেরকম।

এখানেই শেষ নয়। আরও বড় সমস্যা আছে। শূন্য মহাকাশে ঘর্ষণের কোনো ঝামেলা নেই। ফলে গ্রহ-নক্ষত্র তাদের গতিবেগ প্রায় হারায়ই না। কিন্তু এখন মহাকাশ বাতাসে পরিপূর্ণ। গ্রহ-উপগ্রহ ঘর্ষণের কারণে গতি তো হারাবেই, পাশাপাশি বিরতিহীন ঘর্ষণের ফলে পরিণত হবে অগ্নিগোলকে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রহাণু বা উল্কা ঢুকে পড়লে যেমন জ্বলতে থাকে, সেভাবে জ্বলবে এসব গ্রহ-উপগ্রহ।

এক সময় চাঁদের গতি কমতে কমতে একেবারে থেমে যাবে। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল চাঁদকে আরও কাছে টেনে আনবে। পরিণতি হবে এক প্রলয়ংকারী ধ্বংসযজ্ঞ। চাঁদ ও পৃথিবীর সংঘর্ষে টুকরো টুকরো হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবী ও চাঁদ। সৌরজগতের অন্যান্য বাসিন্দারাও এর চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকবে না। সঙ্গে চারপাশে এত বাতাস। আমাদের সৌরজগত খুব দ্রুতই ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
সৌরজগতের ভেতরটা বাতাসে ভরে গেলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী তা আর টিকত না। খুব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যেত।

এর কারণ হলো, বাতাসের ওজন আছে। হেলিওস্ফিয়ারের ব্যাসার্ধ প্রায় ৯০ এইউ (অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট)। এই পুরো স্থানজুড়ে শ্বাসযোগ্য বাতাসের বায়ুমণ্ডলের ওজন হবে অনেক অনেক বেশি। সূর্যের চেয়ে প্রায় ৫০০ কোটি গুণ। তাই সূর্য যদি তার মহাকর্ষ শক্তির মাধ্যমে এদের টেনে নেয় নিজের দিকে, তবে সৌরজগতের ঘনত্ব বাড়বে অস্বাভাবিক হারে। যদি সব বাতাস মহাকর্ষের টানে পৃথিবীর চেয়ে ছোট স্থানে জড় হয়। তাহলে চোখের সামনেই আপনি একটি ব্ল্যাকহোলের জন্ম দেখতে পাবেন। যদি ততক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকেন আরকি!

সেই ব্ল্যাকহোল হবে (পড়ুন, হতো) আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা অতিভারী ব্ল্যকহোলের চেয়েও প্রায় ১ হাজার ২০০ গুণ ভারী। আর আপনার-আমার অস্তিত্ব তো বহু আগেই এই মহাবিশ্ব থেকে বিলীন হয়ে গেছে!

সবমিলিয়ে বলা যায়, সৌরজগতের ভেতরটা বাতাসে ভরে গেলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী তা আর টিকত না। খুব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যেত। তাই প্রকৃতির অন্য সবকিছুর মতো শূন্য মহাকাশও আমাদের টিকে থাকার জন্য দরকার। প্রকৃতি যেমন আছে, সেভাবেই সুন্দর।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন