পৃথিবীতে না চাইতে আমরা কত কিছু পাচ্ছি, সেটা হয়তো কখনো খেয়াল করা হয় না। এই যেমন অক্সিজেনের কথাই ধরুন। পর্যায় সারণির ৮ নম্বর এ মৌল ছাড়া জীবন বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন। পৃথিবীর এই যে এত রূপ, সৌন্দর্য্য—সেসবের পেছনে রয়েছে এ মৌলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কোনো কিছুর গুরুত্ব বোঝা যায় তা না থাকলে। বাস্তবে অক্সিজেন নেই করে দেওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। কিন্তু চাইলে অক্সিজেন ছাড়া পৃথিবীর অবস্থাটা কল্পনা করতে পারি।
বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমরা অক্সিজেন সম্পর্কে এত দিনে অনেক কিছু জেনেছি। অক্সিজেন কেন গুরুত্বপূর্ণ, বুঝতে পেরেছি তা। সেই জ্ঞানের সামান্য অংশ কাজে লাগিয়ে আজকে কল্পনা করার চেষ্টা করব, মৌলটি পৃথিবীতে না থাকলে কী হতো? চিরদিনের জন্য নয়, মাত্র ৫ সেকেন্ডের জন্য। শুধু কি দম বন্ধ রাখতে হতো ৫ সেকেন্ড? বায়ুমণ্ডল বা পরিবেশে এর কী প্রভাব পড়ত?
শ্বাস নেওয়ার সময় আমরা যে বাতাস টেনে নিই, তার মাত্র ২১ শতাংশ অক্সিজেন। নাইট্রোজেন ৭৮ শতাংশ। আর একভাগ অন্য নানা উপাদান। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অনুপাত বেশি নয়। কিন্তু তার ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেন ছাড়া গাছ, পশু-পাখি, পানি কিংবা মানুষ—কিছুই টিকে থাকত না পৃথিবীতে।
৫ সেকেন্ড খুব বেশি সময় নয়। এটুকু সময় শ্বাস বন্ধ করে প্রায় সবাই থাকতে পারেন। বেশিরভাগ মানুষ ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত শ্বাস বন্ধ করে থাকতে পারেন। আমাদের জন্য পাঁচ সেকেন্ড অক্সিজেন না থাকা তাই খুব একটা সমস্যা নয়। বিষয়টি বুঝতে পারার আগে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সব কিছুর জন্য বিষয়টি এমন নয়।
অক্সিজেন ছাড়া মাত্র ৫ সেকেন্ডে পৃথিবীর অবস্থা পুরো বদলে যাবে। বড় বড় নদীর পানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে বাঁধ। এসব বাঁধ তৈরি হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। ৫ সেকেন্ড অক্সিজেন না থাকলে বাঁধগুলো ভেঙে পড়বে। কারণ, সিমেন্টের বন্ধন ধরে রাখার জন্য অক্সিজেন অতি গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেন ছাড়া সিমেন্ট আসলে শুধু ধূলা।
ধাতব পদার্থের ক্ষেত্রে ঘটবে আরও বড় বিপর্যয়। অপরিশোধিত ধাতুর ওপরে জারণের ফলে সৃষ্ট একধরনের আবরণ থাকে। ফলে সেগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে মিশতে পারে না। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া খুব সহজে ধাতব পদার্থ মিশে যাবে একটি অন্যটির সঙ্গে। মাত্র ৫ সেকেন্ডেই ঘটবে এ ঘটনা।
অক্সিজেন না থাকার অর্থ বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর হারিয়ে যাবে। তিনটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত অণুকে বলা হয় ওজোন। ভূপৃষ্ঠের ১৫ কিলোমিটার ওপর থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত এ স্তরের বিস্তৃতি। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে। ৫ সেকেন্ডের জন্য ওজোন স্তর না থাকলে পৃথিবীর বুকে সূর্যের আলোয় থাকা প্রাণিদেহগুলো একরকম ঝলসে যাবে।
এখানেই শেষ নয়। অক্সিজেন না থাকলে কমে যাবে ২১ শতাংশ বায়ুচাপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার মিটার নিচে গেলে যতটা চাপ বাড়ে, ঠিক ততটা চাপ কমে যাবে বাতাস থেকে। আমাদের কানের পর্দা বায়ুচাপের প্রতি অতি সংবেদশীল। বায়ুচাপ কমলে বা বাড়লে তার প্রভাব পড়ে। কারণ, পাতলা এ পর্দা বহাল তবিয়তে থাকার জন্য বাইরে ও ভেতরের চাপ সমান হওয়া চাই। বায়ুচাপের পরিবর্তন কানের পর্দার দুপাশে চাপের পার্থক্য তৈরি করবে। আর তাৎক্ষণিকভাবে এ পরিবর্তন আমাদের কানের পর্দা সহ্য করতে পারবে না। ফলে, বাইরের দিকে বিস্ফোরিত হবে। ভূপৃষ্ঠে থাকা বেশিরভাগ প্রাণীর ভাগ্যে নেমে আসবে এ বিপর্যয়।
আরও দুঃসংবাদ আছে। অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বলতে পারে না। পৃথিবীর সব আগুন নিভে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে গাড়ির ইঞ্জিন। বৈদ্যুতিক নয়, এমন সব যন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে। আকাশ থেকে খসে পড়বে উড়োজাহাজ। রাস্তায় থেমে যাবে সব গাড়ি।
আকাশ হয়ে যাবে পুরো কালো। কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীতে পড়ার আগে আলোর কণা বিভিন্ন কণায় বাধা পায়, প্রতিফলিত ও বিক্ষিপ্ত হয়। অক্সিজেন ছাড়া বিক্ষেপণের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে কালো হয়ে যাবে আকাশ।
এত কিছু ঘটার সময় মাটিতে ঘটবে এক অদ্ভুত ঘটনা। পুরো ভূপৃষ্ট হয়ে যাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ। কারণ, ভূত্বকের ৪৫ ভাগ গঠিত অক্সিজেন দিয়ে। অক্সিজেন নেই তো ভূপৃষ্ঠও প্রায় বিলীন হয়ে যাবে।
এসব জেনে কি দুশ্চিন্তা হচ্ছে? যদি হয়, তবে বড় করে একটা শ্বাস নিন। বুকে টেনে নিন ২১ শতাংশ অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাস। ভয়ের কিছু নেই। এটা নিছক মানস পরীক্ষা। হুট করে পৃথিবী থেকে ৫ সেকেন্ডের জন্য অক্সিজেন হারিয়ে যাবার এখন পর্যন্ত কোনো আশঙ্কা নেই।
পৃথিবীর গাছ, সামুদ্রিক শ্যাওলা—সব মিলে নিয়মিত বায়ুমণ্ডলের বাতাস পরিশোধন করে যাচ্ছে। অক্সিজেন যেমন কমছে, তেমনি প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। তবে এতে বাধা দেয় মানুষ। নিজের স্বার্থের জন্য প্রকৃতি পরিবেশের কথা চিন্তা না করে গাছ কাটি, নানাভাবে দূষিত করি বাতাস। ফলে অক্সিজেন থাকলেও দূষিত বাতাস জীবনকে হুমকিতে ফেলছে। পৃথিবীকে নতুন করে কিছু দিতে হবে না। ধরনীর যা আছে, যত্ন করলে ওতেই নিরাপদে থাকব আমরা।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, সায়েন্স এবিসি, হোয়াটইফশো
এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন
১. ব্ল্যাকহোলে পড়ে গেলে কী হবে?
৩. পৃথিবীর ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হলে কী হতো?
৪. পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?
৫. সূর্যের ভর অর্ধেক হলে কি হত?
৬. পৃথিবীর দুটি চাঁদ থাকলে কী হতো?
৮. জীবাশ্ম জ্বালানী না থাকলে কী হতো?
৯. পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ হলে কী হতো?
১০. পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকলে কী হতো?
১১. সপ্তাহ ধরে চোখের পলক না ফেললে কী হবে?
১২. মানব সভ্যতা টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?
১৩. পৃথিবী আলোর গতিতে ঘুরলে কী হতো?
১৪. সূর্যে নিউক্লিয়ার বোমা ফেললে কী হবে?
১৫. পৃথিবীর সমস্ত সাপ মারা গেলে কী হতো
১৬. মানুষের ঘাম না হলে কী হতো?
১৭. সৌরজগতে আরেকটা নক্ষত্র ঢুকে পড়লে কী হতো?
১৮. পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে কী হতো?
১৯. মানুষ পরমাণুর মতো ছোট হতে পারলে কী হতো?
২০. সূর্য পালসারে পরিণত হলে পৃথিবীর কী হতো?
২১. মানব সভ্যতা টাইপ টু সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?
২২. উড়োজাহাজের ভেতর সব যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?
২৩. সমস্ত রাস্তা সোলার প্যানেলে ঢাকলে কেমন হতো?
২৪. তেলাপোকা কি পারমাণবিক বিস্ফোরণে বাঁচতে পারে?
২৫. সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার দ্বিগুণ হলে কী হতো?
২৬. মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৃথিবীর সব ময়লা ফেললে কী হতো?
২৮. পৃথিবী আলোর বেগে ঘুরলে কী হতো?
২৯. মহাবিশ্বের সমস্ত হিলিয়াম হারিয়ে গেলে কী হতো?
৩০. সৌরজগতে বায়ুমণ্ডল থাকলে কী হতো?
৩১. কেপলার টুটুবি সৌরজগতের গ্রহ হলে কী হতো?
৩২. এক মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল না থাকলে কী হতো
৩৩. বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে কী হতো
৩৪. চাঁদে হ্যালির ধূমকেতু আছড়ে পড়লে কী হতো
৩৫. পৃথিবীর দুটি সূর্য থাকলে কী হতো