গলতে শুরু করেছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ, যেভাবে ডুববে বিশ্বের উপকূলীয় শহর

পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বরফের ভাণ্ডার গলতে শুরু করেছে।ছবি: কানভা ডটকম

ঢাকা শহর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। সিলেট কুশিয়ারার তীরে। চট্টগ্রামে আছে কর্ণফুলি নদী। এভাবেই হাজার হাজার শহর গড়ে উঠেছে নদী বা সমুদ্রের তীরে। মূলত চলাচল ও পণ্য পরিবহনের সুবিধার জন্যই শহরগুলো এভাবে তৈরি হয়েছে। জনপদ গড়ে ওঠার নিয়মই এটি। যেমন, নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

যেখানে নদী, সেখানেই বসতি গড়ে ওঠে। পৃথিবীর সব উপকূলেই এমন শহর দেখা যায়। মানুষ সুবিধা পেয়েছে বলেই এভাবে বসবাস করেছে। তবে মানুষ কখনো জানত না যে, এই উপকূলীয় শহরগুলো একদিন অবস্থানের কারণেই বিপদে পড়বে। শত বছর আগেও সমুদ্র বা নদী উপকূল মানুষের জন্য এতটা বিপদের কারণ ছিল না। ঝড় বা টাইফুন হতো, তবে সেটা ছিল মৌসুমি ঘটনা, প্রতিদিনের নয়।

তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ এখনকার তুলনায় নিচু ছিল। ভূমি বা দেশগুলোকে সবসময়ই সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে উঁচু মনে করা হয়েছে। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই শান্তির সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বরফের ভাণ্ডার ‘ওয়েস্ট অ্যান্টার্কটিক আইস শিট’ গলতে শুরু করেছে। এই বরফের মধ্যে এত পানি আছে, যা পুরোপুরি গলে গেলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট বেড়ে যেতে পারে।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছিল, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার কিছু বড় হিমবাহ, বিশেষ করে থোয়েটস ও পাইন আইল্যান্ড হিমবাহ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এদের গলে যাওয়া আর ঠেকানো যাবে না। শুধু এই দুটি হিমবাহ গলে গেলেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ১ মিটার। এতেই ডুবে যেতে পারে পৃথিবীর প্রায় ২৩ কোটি মানুষের বাসস্থান।

ভাসমান বরফের বিশাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে বলে আইস শেলফ। আইস শেলফ অনেকটা বাঁধের মতো কাজ করে। হিমবাহগুলোকে দ্রুত সমুদ্রে গড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। তাই বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘বরফের রক্ষাকবচ’।

কীভাবে শুরু হচ্ছে গলন

অ্যান্টার্কটিকার বরফস্তরকে বলে ‘অ্যান্টার্কটিক আইস শিট’ বা অ্যান্টার্কটিকার বরফচাদর। এই বরফচাদর সবসময় একই জায়গায় থেমে থাকে না। বরফের ওজন আর চাপের কারণে সমুদ্র উপকূলের দিকে এগোতে থাকে। ভাসমান এই বরফের বিশাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে বলে আইস শেলফ। আইস শেলফ অনেকটা বাঁধের মতো কাজ করে। হিমবাহগুলোকে দ্রুত সমুদ্রে গড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। তাই বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘বরফের রক্ষাকবচ’।

অ্যান্টার্কটিকার বরফস্তরকে বলে ‘অ্যান্টার্কটিক আইস শিট’ বা অ্যান্টার্কটিকার বরফচাদর।
ছবি: গেটি ইমেজ

কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছে এখান থেকেই। সমুদ্রের নিচের তুলনামূলক উষ্ণ পানি আইস শেলফের নিচে ঢুকে বরফ গলাতে শুরু করেছে। ফলে এই বরফের বাঁধগুলো পাতলা হচ্ছে এবং ভেঙে পড়ছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো ‘গ্রাউন্ডিং লাইন’। এটি হলো সেই রেখা, যেখানে বরফ মাটি থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রের পানিতে ভাসতে শুরু করে। সমুদ্রের উষ্ণ পানি বরফ গলিয়ে দেওয়ায় এই গ্রাউন্ডিং লাইন ধীরে ধীরে স্থলের দিকে সরে যাচ্ছে।

এই পুরো প্রক্রিয়াটির বিপজ্জনক প্রভাব রয়েছে। বরফ পেছনের দিকে সরে যাওয়া, আইস শেলফ ভেঙে যাওয়া, গ্রাউন্ডিং লাইন উপকূলের দিকে সরে যাওয়া—সব মিলে এই প্রভাবের নাম মেরিন আইস শিট ইনস্ট্যাবিলিটি বা এমআইএসআই। একবার এই প্রক্রিয়া শুরু হলে থামানো প্রায় অসম্ভব। কারণ সমুদ্রের পানি যত ভেতরে ঢুকবে, তত বেশি বরফ গলতে থাকবে।

আরও পড়ুন
গ্রাউন্ডিং লাইন হলো সেই রেখা, যেখানে বরফ মাটি থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রের পানিতে ভাসতে শুরু করে।সমুদ্রের উষ্ণ পানি বরফ গলিয়ে দেওয়ায় এই গ্রাউন্ডিং লাইন ধীরে ধীরে স্থলের দিকে সরে যাচ্ছে।

বরফের খাড়া দেয়াল যেভাবে বিপদ বাড়ায়

২০১৬ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট ডিকন্টো ও ডেভিড পোলার্ড কম্পিউটার মডেলে দেখান, আইস শেলফ ভেঙে গেলে হিমবাহের পাশে ৯০ মিটারের বেশি উঁচু বরফের খাড়া দেয়াল তৈরি হয়। এই দেয়ালগুলো নিজেদের ওজন ধরে রাখতে পারে না। ফলে একটার পর একটা বরফখণ্ড সমুদ্রে ভেঙে পড়ে। এই প্রক্রিয়াকে ‘মেরিন আইস ক্লিফ ইনস্ট্যাবিলিটি’ বলা হয়। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে শুধু অ্যান্টার্কটিকা থেকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটারের বেশি বাড়তে পারে।

অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ
ফাইল ছবি

অপরদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (IPCC) সতর্ক করে বলেছে, অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড, হিমবাহ এবং সমুদ্রের তাপীয় সম্প্রসারণ মিলিয়ে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ ২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাশাপাশি, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ না থামালে ২৩০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ১৫ মিটার পর্যন্ত।

আশার কথা হলো, সব বিজ্ঞানী মেরিন এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত নন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। যেমন বরফ খসে পড়লে যে টুকরোগুলো জমা হয়, সেগুলো ‘আইস মেলাঞ্জে’ তৈরি করে। এটি নতুন বরফের দেয়ালকে কিছুটা ধরে রাখে। আবার বরফ কমলে নিচের ভূভাগ বা বেডরকের ওপর থেকে ভার কমে যায়। ফলে ভূমির উচ্চতা বাড়ে। এটিকে বলা হয় আইসোস্ট্যাটিক রিবাউন্ড। ধীরগতিতে বরফ গলতে থাকলে বরফ চাদর সমুদ্র থেকে দূরে সরে যেতে পারে। আবার খুব দ্রুত গলন হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে আরও।

আরও পড়ুন

হাতে আর কত সময় আছে

নাসা এবং স্যাটেলাইটের তথ্য বলছে, থোয়েটস ও পাইন আইল্যান্ডের গ্রাউন্ডিং লাইন ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর কয়েকশ মিটার করে পেছাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই গতি হঠাৎ বেড়ে গেলে আগামী ২০-৫০ বছরের মধ্যেই দ্রুত ভাঙন শুরু হতে পারে। আর যদি ধীরগতিতে চলতে থাকে, তবে ঘটনাটি ঘটতে লাগবে কয়েক শতাব্দী।

তাই ঠিক কবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিশ্চিতভাবে কতটুকু বাড়বে, এখনই এর নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই। তবে নিশ্চিত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে।

 

সূত্র: রয়টার্স ও কোয়ান্টাম ম্যাগাজিন

আরও পড়ুন