অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খেলে অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে: গবেষণা

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, যারা বেশি বেশি অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার (Ultra-Processed Food বা UPF) খায়, তাদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণাটিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দ্য আমেরিকান জার্নাল অব প্রিভেন্টিভ মেডিসিন-এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।

প্রক্রিয়াজাত মাংস, বিস্কুট, কোমল পানীয়, আইসক্রিম ইত্যাদি অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিচিত উদাহরণ। আজকাল বিশ্বে বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাসে ক্রমেই এগুলো আরও বেশি জায়গা দখল করছে।

এ ধরনের খাবারের বৈশিষ্ট্য কী? বিবিসির রিপোর্ট বলছে, অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারে এমন পাঁচটি উপাদান বেশি থাকে, যেগুলো সাধারণত ঘরে রান্না করা খাবারে থাকে না। যেমন বিভিন্ন অ্যাডিটিভ (খাদ্যের মান উন্নত করা বা সংরক্ষণের জন্য যেসব রাসায়নিক মেশানো হয়), মিষ্টান্ন উপাদান এবং খাবারের গঠন বা টেক্সচার উন্নত করার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক।

গবেষণাগুলোতে আটটি দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের জরিপ এবং মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, সব দেশের সরকারের উচিৎ জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করা এবং এ ধরনের খাবার কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া।

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের সঙ্গে স্বাস্থ্যহানির কী সম্পর্ক, তা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। প্রক্রিয়াজাত করার পদ্ধতি এ জন্য দায়ী—এমন জোরালো প্রমাণ খুব বেশি পাওয়া যায়নি। সে ক্ষেত্রে, এই বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব খাবারে থাকা উচ্চ মাত্রার চর্বি, লবণ ও চিনিই সম্ভবত এর মূল কারণ।

আরও পড়ুন

কৃত্রিম উপাদান

গবেষকেরা আগের বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর হারের ওপর অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন। তবে তাঁরা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন, অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারই যে অকালমৃত্যুর কারণ, এই গবেষণা তা সরাসরি প্রমাণ করে না। কারণ কোনো ব্যক্তির অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক মানুষটির সামগ্রিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, জীবনযাপনের ধরন, আর্থিক অবস্থাসহও আরও অনেক কিছু জড়িত।

এই গবেষণাগুলোতে আটটি দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের জরিপ এবং মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র।

এ গবেষণায় যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তা মডেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ওপর অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে—যেখানে দৈনিক ক্যালরির অর্ধেকের বেশি আসে অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে—সেখানে ১৪% অকালমৃত্যু এই খাবারগুলোর কারণে হতে পারে। আর কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের মতো দেশে—যেখানে এ ধরনের খাদ্য গ্রহনের পরিমাণ কম (২০%-এরও কম ক্যালরি—সেখানে প্রায় ৪% অকালমৃত্যু এসব খাবারের কারণে হতে পারে। এই গবেষণার দাবি, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার অকালমৃত্যু এবং যুক্তরাজ্যের প্রায় ১৮ হাজার অকালমৃত্যুর জন্য এসব অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার দায়ী।

আরও পড়ুন

গবেষকেরা বলছেন, সব দেশের সরকারের উচিৎ জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করা এবং এ ধরনের খাবার কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া। বিবিসির রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্য সরকারের পুষ্টিবিশেষজ্ঞ প্যানেল বলেছে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকির জোরালো কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার কী

হয়তো ভাবছেন, অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো ঠিক কী কী? এর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংখ্যা নেই। বিবিসির রিপোর্টে এ জন্য নোভা (NOVA) শ্রেণিবিভাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসেবে অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের মধ্যে আছে কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট, প্যাকেটজাত রুটি, সসেজ, বার্গার, হট ডগ, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, নুডলস, বিভিন্ন ডেজার্ট, চিকেন নাগেটস, ফিশ ফিঙ্গার, ফলের পানীয়, ইয়োগার্ট, শিশুদের জন্য তৈরি ফর্মুলা-দুধ ইত্যাদি।

 যেসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি এখনো

এ গবেষণায় যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তা মডেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ওপর অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছে।

যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির ফলিত পরিসংখ্যানের এমেরিটাস অধ্যাপক কেভিন ম্যাককনওয়ে এ ধরনের মডেল নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর মতে, এই গবেষণায় যেহেতু অনেক গাণিতিক অনুমান ব্যবহার করা হয়েছে, তাই এর ফলাফল নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া সরাসরি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, নাকি এর কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা উপাদানের জন্য এমনটা হচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।’

বিবিসির রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্য সরকারের পুষ্টিবিশেষজ্ঞ প্যানেল বলেছে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি স্বাস্থ্যঝুঁকির জোরালো কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, ‘ভিন্ন পরিমাণে অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার ফলে মৃত্যুঝুঁকির বাড়া-কমার বিষয়টি কোনো গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।’

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির খাদ্য ও স্থূলতা বিশেষজ্ঞ ডা. নেরিস অ্যাস্টবুরিও গবেষণাটির এসব সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে একমত। তবে বেশি ক্যালরি, চর্বি ও চিনিসমৃদ্ধ খাবার যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, স্থূলতা, হৃদরোগ এবং নানা ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, তা দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা জানেন। এই সবকটিই অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুতকারকদের সংস্থা দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রিংক ফেডারেশন বলছে, ‘অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার’ বলে দই, পাস্তার মতো ভালো খাবারকেও নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু এসব খাবার এবং সব ধরনের অ্যাডিটিভই যুক্তরাজ্যের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফুড স্ট্যান্ডার্ডস এজেন্সির অনুমতি সাপেক্ষেই বাজারে ছাড়া হয়। অর্থাৎ এগুলো খাবার হিসেবে নিরাপদ।

সূত্র: দ্য আমেরিকান জার্নাল অব প্রিভেন্টিভ মেডিসিন, বিবিসি

আরও পড়ুন