ঘাসের ওপর ইট থাকলে ঘাস হলুদ হয়ে যায় কেন
গল্পটা আমাদের সবার চেনা। শৈশবে বাগানে খেলতে গিয়ে বা বাড়ির উঠোনে অযত্নে পড়ে থাকা একটা ইট সরাতে গিয়ে হয়তো হঠাৎ চমকে উঠেছেন! ইটটা সরাতেই মাটির ওপর ফুটে ওঠে একটা নিখুঁত চারকোণা ছাপ; ফ্যাকাশে, হলুদ রঙের ঘাসের ক্যানভাস! চারপাশে সবুজ বুকে যেন এক টুকরো হলদেটে ঘাস! কেন ইটের নিচের ঘাস হলুদ হয়ে যায়?
প্রথমেই মাথায় যে উত্তরটা আসে তা হলো, সূর্যের আলো পায়নি, তাই এমন হলদেটে হয়ে গেছে। উত্তরটা ভুল নয়। কিন্তু এটা হলো মাত্র একটা কারণ। আরও কিছু কারণ আছে।
এই রহস্য সমাধানের আগে জানতে হবে, ঘাস কেন সবুজ? ঘাস সবুজ হওয়ার জন্য দায়ী একধরনের সবুজ রঞ্জক কণা। এর নাম ক্লোরোফিল। একে বলা যায় ঘাসের রান্নাঘর। সূর্যের আলো ব্যবহার করে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড আর মাটি থেকে পানি নিয়ে একটা জটিল প্রক্রিয়ায় নিজের জন্য খাবার তৈরি করে ঘাস। এই প্রক্রিয়ার নাম হলো সালোকসংশ্লেষণ।
যতক্ষণ এই রান্নাঘর চালু থাকে, ততক্ষণ ঘাস পেটপুরে খেতে পায়—অর্থাৎ সবুজ থাকে। কিন্তু ঘাসের ওপর একটা ইট রেখে দিলে কী হয়? প্রথমেই সূর্যের আলো পৌঁছানো বন্ধ হয়ে যায়। মানে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল ঘাসের খাবার তৈরিও।
সূর্যের আলো ব্যবহার করে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড আর মাটি থেকে পানি নিয়ে একটা জটিল প্রক্রিয়ায় নিজের জন্য খাবার তৈরি করে ঘাস। এই প্রক্রিয়ার নাম হলো সালোকসংশ্লেষণ।
ক্লোরোফিল অণুগুলো রাসায়নিকভাবে বেশ অস্থির। একটা সুস্থ, সবল ঘাসের ভেতরেও অনবরত লাখ লাখ ক্লোরোফিল কণা ভেঙে যেতে পারে বা নষ্ট হতে পারে। যখন সূর্যের আলো ঘাসে পৌঁছায়, তখন সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে সেই ভাঙা কণাগুলোর জায়গায় দ্রুত নতুন ক্লোরোফিল কণা তৈরি করে ফেলে ঘাস। ফলে কণাগুলোর মধ্যে ভারসাম্য থাকে। এ জন্যই ঘাস সবুজই দেখায়।
কিন্তু যখন ইটের নিচে অন্ধকারে থাকে, তখন নতুন ক্লোরোফিল তৈরির প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ক্লোরোফিল ভেঙে যাওয়ার যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেটা কিন্তু থামে না! ফলে ইটের নিচের ঘাস আগের সবুজ রংটুকু হজম করতে শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যেই সবুজের ভাণ্ডার শেষ হয়ে হলুদ হয়ে যায়!
কিন্তু কেন হলুদ হয়? অন্য কোনো রং কেন হয় না? হলুদ রংটাই-বা আসে কোথা থেকে? মজার ব্যাপার হলো, এই হলুদ রং নতুন করে তৈরি হয়নি। এটা সবসময় ঘাসের মধ্যেই ছিল!
ঘাসের পাতার কোষে শুধু ক্লোরোফিল থাকে না; পাশাপাশি আরও সাহায্যকারী রঞ্জক কণা থাকে। এদের নাম ক্যারোটিনয়েডস এবং জ্যান্থোফিলস। গাজরের কমলা রঙের জন্যও এই ক্যারোটিনয়েডস দায়ী। ক্যারোটিনয়েডসের এই হলুদ বা কমলা রং আসলে ক্লোরোফিলের তীব্র সবুজের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। ঠিক যেমন দিনের আলোয় তারারা হারিয়ে যায়, তেমন। যদিও তারারা কিন্তু আকাশেই থাকে।
ঘাসের পাতার কোষে শুধু ক্লোরোফিল থাকে না; পাশাপাশি আরও সাহায্যকারী রঞ্জক কণা থাকে। এদের নাম ক্যারোটিনয়েডস এবং জ্যান্থোফিলস। গাজরের কমলা রঙের জন্যও এই ক্যারোটিনয়েডস দায়ী।
ইটের নিচে যখন ক্লোরোফিলের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়, তখন সেই সবুজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্যারোটিনয়েডসের আসল রূপটা বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ, ঘাস হলুদ হয় না, বরং ওই হলুদ আগে থেকেই সবুজের আড়ালে ছিল। শরৎকালে গাছের পাতা ঝরার আগে পাতা হলুদ হওয়ার পেছনেও কিন্তু এই একই বিজ্ঞান কাজ করে!
কিন্তু ঘাস হলুদ হয়ে গেলে কি ওরা হাল ছেড়ে দেয়? এরপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে? না। এখানেই বিজ্ঞানের সবচেয়ে অদ্ভুত অংশটা শুরু হয়। ঘাস যখন বুঝতে পারে যে ওটা মাটির নিচে চাপা পড়েছে, তখন প্যানিক মোড বা ইটিওলেশন নামে এক বিশেষ জরুরি অবস্থায় চলে যায়। এটা হলো ঘাসের মরিয়া হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। ঘাসটা তখন সবুজ ক্লোরোফিল বানিয়ে শক্তি নষ্ট করার চেষ্টা করে না। পাতাও বেশি বড় করে না। কারণ পাতা মেলতেও শক্তি লাগে। তখন ঘাসের একমাত্র চেষ্টা থাকে, যেভাবেই হোক, আলো খুঁজে বের করা। খেয়াল করলে দেখবেন, ইটের নিচে চাপা পড়া ঘাসের পাতাগুলো সরু সুচের মতো হয়ে যায়
এই আলো খুঁজে বের করার জন্য ঘাস তার শিকড়ে জমানো শেষ শক্তিটুকু একত্র করে শুধু একটা কাজই করে—লম্বা হয়। যদি লম্বা হয়ে আলোর দেখা পায়!
ঘাস যখন বুঝতে পারে যে ওটা মাটির নিচে চাপা পড়েছে, তখন প্যানিক মোড বা ইটিওলেশন নামে এক বিশেষ জরুরি অবস্থায় চলে যায়। এটা হলো ঘাসের মরিয়া হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা।
আপনি যদি ইটটা কয়েকদিন পর সরান, দেখবেন হলুদ ঘাসগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অদ্ভুতভাবে বেশি লম্বা, সরু আর দুর্বল হয়ে গেছে। ঘাস কিন্তু বুঝতে পারে না যে ওরা ইটের নিচে চাপা পড়েছে। ভাবে, চাপা পড়েছে মাটির নিচে। ওপরের দিকে উঠতে থাকলে নিশ্চয়ই সূর্যের দেখা পাবে। তাই লম্বা হতেই থাকে।
শেষ প্রশ্ন, ইটের নিচে চাপা পড়া ঘাস কি বাঁচবে? হলুদ হওয়ার পরও যদি ইট সরিয়ে ফেলা হয়, তাতে কি গাছটাকে বাঁচানো সম্ভব? হ্যাঁ, আপনি যদি সময়মতো ইটটা সরিয়ে নেন, তাহলে ঘাস আবার সূর্যের আলোর সাহায্যে রান্নাবান্না করে বেঁচে যাবে! বন্ধ করে দেবে পাগলের মতো লম্বা হওয়া। আবার চালু হবে ওদের রান্নাঘর। নতুন করে বানানো শুরু হবে ক্লোরোফিল। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ভুতুড়ে হলুদ রংটা আবার সতেজ সবুজে ছেয়ে যাবে।
তবে খুব বেশি দেরি হয়ে হয়ে গেলে আর লাভ হবে না। ঘাস যদি আলোর খোঁজে লম্বা হতে হতে শিকড়ে জমানো সব শক্তি শেষ করে ফেলে, তখন ইট সরিয়ে ফেললেও ঘাস আর সবুজ হতে পারবে না। শক্তির অভাবে ওরা সত্যিই মারা যাবে।
