বিষ খেয়েও কিছু প্রাণী কেন মারা যায় না
প্রকৃতিতে কিছু বিশেষ প্রাণী আছে, যারা ভয়ংকর বিষ খেয়ে হজম করে ফেলতে পারে। বিষ খেলে অনেক প্রাণী আক্রান্ত হয়, মারা যায়। তবে কিছু প্রাণী ব্যতিক্রম। এমন সব বিষ খেয়ে প্রাণীগুলো বেঁচে থাকে, যা অন্য প্রাণীর শরীরে গেলে মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রাণীগুলো কোটি বছর ধরে পরিবর্তিত হয়ে দারুণ কিছু অ্যান্টি-টক্সিন কৌশল আয়ত্ব করেছে। এই কৌশলই এদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে।
বিষ খেয়েও প্রাণীগুলো যেভাবে বেঁচে থাকে
বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য একদল গবেষক কলম্বিয়ার আমাজন বন থেকে ১০টি একই প্রজাতির সাপ ধরেছিলেন। সাপগুলোকে কয়েক দিন না খাইয়ে রাখা হয়। এরপর এদের সামনে খাবার হিসেবে দেওয়া হয় ভয়ংকর বিষাক্ত থ্রি-স্ট্রাইপড পয়জন ডার্ট ফ্রগ নামে এক ব্যাঙ। মারাত্মক বিষাক্ত এই ব্যাঙের চামড়ায় হিস্ট্রিওনিকোটক্সিন, পুমিলিওটক্সিন ও ডেকাহাইড্রোকুইনোলিনের মতো রাসায়নিক থাকে। ওসব কঠিন নামের রাসায়নিকগুলো বিষ হিসেবে কাজ করে। কোষের গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনগুলোর কাজ বন্ধ করে দেয়।
সাপগুলোর মধ্যে ছয়টি সাপ ব্যাঙ খায়নি। তবে চারটি সাপ খেয়েছে। খাওয়ার আগে খাবারটা মাটিতে ঘষে নিয়েছে যেন বিষ কিছুটা মুছে যায়। ব্যাঙ খেয়ে চারটির মধ্যে তিনটি সাপ বেঁচে যায়। গবেষকেরা বুঝতে পারেন, এসব সাপের শরীর কোনোভাবে এই ভয়ংকর বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
ভয়ংকর বিষাক্ত থ্রি-স্ট্রাইপড পয়জন ডার্ট ফ্রগ নামে ব্যাঙের চামড়ায় হিস্ট্রিওনিকোটক্সিন, পুমিলিওটক্সিন ও ডেকাহাইড্রোকুইনোলিনের মতো রাসায়নিক থাকে।
প্রাণীদেহ যেভাবে বিষ প্রতিরোধ করে
প্রকৃতিতে বহুকাল আগে থেকে বিষ পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে ব্যাকটেরিয়া অন্য জীবকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করত বিষ। পরে প্রাণীরা শিকার ধরতে বা শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় বিষ ব্যবহার করতে শুরু করে। কিছু গাছেও এমন সব বিষাক্ত রাসায়নিক তৈরি হয়, যা তৃণভোজী প্রাণীদের সেই গাছ থেকে দূরে রাখে। প্রকৃতিতে বিষ তৈরি হয়েছে অন্য প্রাণীকে ঘায়েল করতে। বিপরীত দিকে বা প্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্য প্রাণীরাও শিখে ফেলেছে এই বিষ থেকে রক্ষার কৌশল।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক রেবেকা টারভিন বলেছেন, ‘কেবল এক মিলিগ্রাম বিষাক্ত যৌগ পুরো একটি বাস্তুতন্ত্রের প্রাণীদের মধ্যকার সম্পর্ক বদলে দিতে পারে।’
প্রাণীরা কীভাবে বিষ সহ্য করে
কিছু প্রাণী নিজেরা বিষ তৈরি করে। যেমন টোড ব্যাঙ। এরা নিজের শরীরে তৈরি করে কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড নামে বিষ। এই বিষ কোষের সোডিয়াম-পটাসিয়ামের চলাচল বন্ধ করে দেয়। আবার কিছু প্রাণীর শরীরে থাকে বিষ উৎপাদক ব্যাকটেরিয়া। যেমন পাফার ফিশ। এদের শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়ার বিষ টেট্রোডোটক্সিন মানুষকে মুহূর্তে মেরে ফেলতে পারে।
আরেকদল আছে, যারা খাবার খেয়ে বিষ সংগ্রহ করে। যেমন পয়জন ডার্ট ফ্রগ বিষাক্ত পোকামাকড় খেয়ে নিজের শরীরে বিষ জমায়।
এসব প্রাণী নিজের বিষে আক্রান্ত হয় না। যেমন, আকন্দ গাছের পাতা খাওয়া কিছু পোকার শরীরের কোষের প্রোটিন এমনভাবে বদলে গিয়েছে, আকন্দর বিষ দিয়ে এরা আর আক্রান্ত হয় না।
কিছু প্রাণী নিজেরা বিষ তৈরি করে। যেমন টোড ব্যাঙ। এরা নিজের শরীরে তৈরি করে কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড নামে বিষ। এই বিষ কোষের সোডিয়াম-পটাসিয়ামের চলাচল বন্ধ করে দেয়।
বিষ প্রতিরোধের কৌশল
আকন্দর বীজ খায়, এমন প্রাণী নিয়ে কাজ করেন জার্মানির গবেষক সুজান ডবলার। মিল্কউইড বাগ নামের এক পোকা নিয়ে গবেষণা করে তিনি দেখেছেন, যে প্রোটিনটি বেশি বিষ প্রতিরোধী, সেটি তত কম কার্যকর হয়। পোকাটি নিজের শরীরে এই সমস্যার সমাধান করেছে। মস্তিষ্কে রেখেছে বিষ-সংবেদনশীল প্রোটিন, আর শরীরের অন্য অংশে রেখেছে বিষ প্রতিরোধী প্রোটিন।
গবেষক সুজান ডবলারের ধারণা, এ কাজে সহায়তা করছে এবিসিবি ট্রান্সপোর্টার নামে কিছু প্রোটিন, যেগুলো কোষের ভেতর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বাইরে ফেলে দেয়। কিছু পোকা এই প্রোটিনের সাহায্যে বিষ সরাসরি শরীর থেকে বের করে দেয়। এমনকি এদের মলও শত্রু পিঁপড়াদের জন্য ভয়ংকর প্রতিরোধক হয়ে ওঠে।
সাপ, কাঠবিড়ালি ও ব্যাঙের লড়াই
রয়েল গ্রাউন্ড সাপের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এদের যকৃৎ বা লিভার বিষ ভাঙতে বিশেষভাবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাপের লিভারের এনজাইম বিষাক্ত যৌগকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। যেমন, মানুষের লিভার অ্যালকোহল বা নিকোটিন ভাঙতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রাউন্ড স্কুয়ারেল নামে কাঠবিড়ালির রক্তে এমন প্রোটিন পাওয়া গেছে, যা র্যাটল স্নেকের বিষ প্রতিরোধ করতে পারে। স্থানীয় সাপের বিষের ধরন অনুযায়ী কাঠবিড়ালির শরীরেও সেই অনুযায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়। তবে সাপ-কাঠবিড়ালির লড়াই কখনো শেষ হয় না। কারণ, সাপ নতুন বিষ তৈরি করে, কাঠবিড়ালি নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল তৈরি করে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাপের লিভারের এনজাইম বিষাক্ত যৌগকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। যেমন, মানুষের লিভার অ্যালকোহল বা নিকোটিন ভাঙতে পারে।
বিষ থেকে অস্ত্র
কিছু প্রাণী শুধু বিষ প্রতিরোধ করে না, বরং বিষকে নিজেদের অস্ত্রে পরিণত করে। যেমন ডগবেন বিটল নামে এক পোকা গাছ থেকে পাওয়া বিষ নিজের শরীরে জমিয়ে রাখে। বিপদে পড়লে সেই বিষ ছোট ছোট ফোঁটা আকারে পিঠ থেকে ছুড়ে মারে।
বিষ জমানোর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ মনার্ক প্রজাপতি। এরা আকন্দ গাছের পাতা খেয়ে বিষ নিয়ে নিজেদের শরীরে জমা রাখে। শিকারী প্রাণী থেকে বাঁচতে এই কৌশল নেয় এরা। এমনকি কিছু পাখিও এই বিষের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। যেমন ব্ল্যাক-হেডেড গ্রসবিক। এই পাখি মেক্সিকোর পাহাড়ি অরণ্যে মনার্ক প্রজাপতি খেয়েও টিকে থাকে। তাই বিষ মানেই মৃত্যু না, কিছু প্রাণী বিষ প্রতিরোধও করতে পারে।