পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মিলল ম্যামথের দাঁতে
প্রাচীন ম্যামথের দাঁত ও হাড় বিশ্লেষণ করে দশ লাখ বছরেরও বেশি আগের জীবাণু খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেল জার্নালে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা জানান, এই নমুনাগুলো থেকে পাওয়া ডিএনএ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ। কারণ, লাখ লাখ বছর পরে কোনো জীবের ডিএনএ অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ম্যামথের মজবুত দাঁত ও হাড় এই প্রাচীন জীবাণুগুলোর ডিএনএকে রক্ষা করতে পেরেছে।
গবেষণায় আরও কিছু দারুণ তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখেছেন, বর্তমানে আফ্রিকান হাতি যেসব ব্যাকটেরিয়ার কারণে অসুস্থ হয়, হাজার হাজার বছর আগে ম্যামথরাও সেসব ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতো। এ থেকে বোঝা যায়, রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো হাজার বছর ধরে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বিজ্ঞানীরা জানান, এই আবিষ্কার প্রাণিজগতের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন ও আধুনিক প্রাণীর মধ্যে রোগের সম্পর্ক বুঝতে এই আবিষ্কার সাহায্য করবে।
এ গবেষণার অন্যতম লেখক সুইডেনের স্টকহোমের প্যালিওজেনেটিক্স সেন্টারের বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন গিনেট। তিনি জানিয়েছেন, ‘বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের মধ্যে কী ধরনের জীবাণু বা ভাইরাস বসবাস করত, সে সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে এই গবেষণা সাহায্য করবে’।
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত না যে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ম্যামথের স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল তখন। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, এই গবেষণাটি প্রাচীন প্রাণীর শরীরের ভেতরের ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আমাদের প্রথম বিশদে ধারণা দিচ্ছে।
প্যালিওমাইক্রোবায়োলজিস্ট বা প্রাচীন অণুজীববিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করে বোঝার চেষ্টা করছেন, এই জীবাণুগুলো কীভাবে প্রাচীন প্রাণীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। আর এই প্রাণীদের বিলুপ্তির পেছনে এদের কোনো ভূমিকা ছিল কিনা। আগের গবেষণাগুলো মূলত মানুষের প্রাচীন ডিএনএ এবং জীবাণুর ওপর করা হতো। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের শরীর এবং জীবাণুর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে।
গবেষকেরা ম্যামথ এবং ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য মোট ৪৮৩টি ম্যামথের দাঁত, খুলি এবং ত্বকের নমুনা বিশ্লেষণ করেছেন। এই নমুনাগুলো উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন এবং সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছিল। নমুনাগুলোর সময়কাল ছিল প্রায় দশ লাখ বছর আগে থেকে ৪ হাজার বছর আগ পর্যন্ত। তখন শেষ ম্যামথগুলো সাইবেরিয়ার র্যাঞ্জেল দ্বীপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ম্যামথের শরীরে ৩১০টি ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। তবে এর মধ্যে অনেক ব্যাকটেরিয়া ছিল, যেগুলো ম্যামথ মারা যাওয়ার পর এদের শরীরের টিস্যুতে মিশে গিয়েছিল। তাই বিজ্ঞানীরা প্রথমে সেসব জীবাণুর ডিএনএ বাদ নমুনা থেকে দেন। ফলে ম্যামথগুলো যখন জীবিত ছিল, তখন এদের শরীরের ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো নিয়ে গবেষণা করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষকরা ‘মেটাজেনমিক স্ক্রিনিং’ নামে একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ম্যামথের নমুনায় থাকা ডিএনএ বিশ্লেষণ করেছেন। এই পদ্ধতিতে তাঁরা একটি নমুনার মধ্যে থাকা বিভিন্ন জীবের ডিএনএ একসঙ্গে পরীক্ষা করতে পারেন। এরপর প্রাচীন জীবাণুগুলোর ডিএনএ-এর সঙ্গে আধুনিক জীবাণুর ডিএনএ তুলনা করেন।
এই গবেষণায় ছয়টি ব্যাকটেরিয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণে ম্যামথরা অসুস্থ হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এর মধ্যে একটি হলো অ্যাক্টিনোব্যাসিলাস (Actinobacillus) নামে একটি ব্যাকটেরিয়া। শূকরের দেহে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি ম্যামথের মুখের ভেতরেও ছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি হলো পাস্তুরেলা (Pasteurella) নামে একটি ব্যাকটেরিয়া। এটি এমন এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত যা ২০২০ সালে বতসোয়ানা এবং জিম্বাবুয়েসহ বেশ কিছু দেশে হাতি মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। এই ব্যাকটেরিয়া হাতির মুখ থেকে এদের রক্তে প্রবেশ করে এবং মারাত্মক সংক্রমণের সৃষ্টি করে শরীরে। ফলে হাতি মারা যায়।
গবেষকেরা চারটি ম্যামথ এবং ১১ লাখ বছরের পুরাতন স্টেপ ম্যামথের নমুনা থেকে এরিসিপেলোথ্রিক্স (Erysipelothrix) নামে একটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার জিনগত গঠন খুঁজে বের করেছেন। এটি এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন কোনো প্রাণীর শরীরের ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ। সাধারণত ব্যাকটেরিয়াগুলো দাঁতের মধ্যেই বসবাস করত। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ম্যামথের হাড়ের টিস্যুতেও পাওয়া গেছে।
প্যালিওমাইক্রোবায়োলজিস্ট বা প্রাচীন অণুজীববিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করে বোঝার চেষ্টা করছেন, এই জীবাণুগুলো কীভাবে প্রাচীন প্রাণীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। আর এই প্রাণীদের বিলুপ্তির পেছনে এদের কোনো ভূমিকা ছিল কিনা।
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত না যে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ম্যামথের স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল তখন। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, এই গবেষণাটি প্রাচীন প্রাণীর শরীরের ভেতরের ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আমাদের প্রথম বিশদে ধারণা দিচ্ছে।
অন্যদিকে ফ্রান্সের প্যারিসের ইনস্টিটিউট জ্যাক মনোডের একজন বিজ্ঞানী ইভা-মারিয়া গেইগল এই গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, এত পুরাতন নমুনার সঙ্গে তুলনা করার মতো আধুনিক তথ্য খুব কমই আছে। তবে তিনি এই গবেষণার প্রশংসা করেছেন।