যে পাঁচ উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানীর নিজের আবিষ্কারই হয়েছে তাঁদের মৃত্যুর কারণ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যুগে যুগে মানবজাতিকে বিস্মিত করেছে। নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের নেশায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন বিজ্ঞানীরা। খুলে দিয়েছেন নতুন জ্ঞানের দুয়ার। উদ্ভাবকেরা সাধারণত নিজের উদ্ভাবনের জন্য খ্যাতি পান। কিন্তু কখনো কখনো সেই উদ্ভাবনই হয়ে দাঁড়ায় সেই উদ্ভাবকের অকাল মৃত্যুর কারণ। ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু বিজ্ঞানীর নাম লেখা আছে, যাঁদের অসাধারণ আবিষ্কারগুলো শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই জীবন কেড়ে নিয়েছিল। চলুন, জেনে নেওয়া যাক এমন পাঁচ বিজ্ঞানীর কথা।

১. হেনরি স্মোলিনস্কি

আকাশে উড়তে পারে, এমন গাড়ির কথা হয়তো পড়েছেন বিজ্ঞান কল্পগল্প তথা সায়েন্স ফিকশনে। ১৯৭০-এর দশকে এমন এক গাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রকৌশলী হেনরি স্মোলিনস্কি। ভদ্রলোক অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। মহাকাশ অভিযানের সঙ্গে জড়িত বড় বড় কোম্পানিতে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই চাকরি ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় শুরু করেন নিজের কোম্পানি, অ্যাডভান্সড ভেহিকল ইঞ্জিনিয়ার্স। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটি সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য উড়ন্ত গাড়ি তৈরি করা।

১৯৭৩ সালে স্মোলিনস্কির প্রতিষ্ঠান প্রথম উড়ন্ত গাড়ি এভিই মিজার (AVE Mizar) তৈরি করে। এটি ছিল তখনকার সময়ের এক অভিনব উদ্ভাবন। উড়ন্ত গাড়ি এভিই মিজার বানানো হয়েছিল একটি ফোর্ড পিন্টো গাড়ির সঙ্গে একটি সেসনা স্কাইমাস্টার জেটের পেছনের অংশ যুক্ত করে।

সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে এক পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময় এই আবিষ্কারই হেনরি এবং তাঁর পাইলটের জীবন কেড়ে নেয়। প্লেন-কাম-গাড়িটি হঠাৎ বিধ্বস্ত হয়ে পরিণত হয় আগুনের গোলায়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ড একই ধরনের প্রকল্পের সব ধরনের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করে।

আরও পড়ুন

২. ম্যাক্স ভ্যালিয়ার

মহাকাশ জয় করা বা রকেটে চড়ে মহাশূন্যে যাওয়ার স্বপ্ন মানুষের বহুদিনের। কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরই একজন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী ম্যাক্স ভ্যালিয়ার। তিনি ছিলেন প্রথম দিককার একজন রকেট বিজ্ঞানী। স্পেসফ্লাইট সোসাইটি নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন তিনি। এই সংস্থা পরে বিশ্বের বহু বিজ্ঞানীকে একত্র করে মহাকাশ গবেষণায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে ম্যাক্স ভ্যালিয়ার কেবল রকেট তৈরির মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখেননি। তিনি ভাবলেন, যদি রকেটের শক্তি দিয়ে মহাকাশযান চলতে পারে, তবে কেন সেটাকে গাড়িতে ব্যবহার করা যাবে না? এই ভাবনা থেকেই রকেটচালিত গাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখেন তিনি।

১৯৩০ সালের মে মাসে, তরল জ্বালানি নিয়ে বেশ কিছু সফল পরীক্ষা করার পর নিজের ল্যাবরেটরিতেই এক মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হন ম্যাক্স। তিনি যে অ্যালকোহল-ভিত্তিক জ্বালানি নিয়ে কাজ করছিলেন, তা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা যান এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন
prime

৩. জন গডফ্রে প্যারি-থমাস

পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলা গাড়ির চালকদের কথা বললেই যে নামগুলো আসে, জন গডফ্রে প্যারি-থমাস তাঁদের অন্যতম। এই প্রকৌশলী ও চালক তাঁর দুঃসাহসী জীবনের জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে আছেন। গতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অন্যরকম। আর এই ভালোবাসা থেকেই তিনি বহুবার গতির রেকর্ড ভেঙেছেন।

১৯২৬ সালে তিনি নিজের হাতে তৈরি স্পিড কার ব্যাবস (Babs) দিয়ে এক নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। এটি ‘চিটি ব্যাং ব্যাং ৪’ নামেও পরিচিত ছিল। এই গাড়ি ঘণ্টায় ২৭৪ কিলোমিটার বা ১৭০ মাইল গতিতে পৌঁছাতে পারত, যা সেই সময়ের জন্য ছিল অবিশ্বাস্য।

তবে ১৯২৭ সালে নিজের রেকর্ড ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি যখন আবার ব্যাবস নিয়ে মাঠে নামেন, তখনই ঘটে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তীব্র গতিতে ছুটে চলার সময় হঠাৎ গাড়ির একটি চেইন ভেঙে যায়। সেই চেইনটি সরাসরি তাঁর মাথায় আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন

৪. ফ্রেড ডুসেনবার্গ

ইতিহাসে এমন কিছু প্রতিভাবান ব্যক্তি আছেন, যাঁরা নিজেদের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। ফ্রেড ডুসেনবার্গ ছিলেন তেমনই একজন। এই অসাধারণ অটোমোবাইল ডিজাইনারের একমাত্র নেশা ছিল দ্রুতগতির স্পোর্টস কার তৈরি করা। ছোটবেলায় তাঁর পরিবার জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। মাত্র পনের বছর বয়সেই তিনি রেসিং সাইকেল ডিজাইন করা শুরু করেন।

প্রকৌশলী হিসেবে ফ্রেডের কর্মজীবন ছিল অত্যন্ত সফল। তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং উন্নত কিছু গাড়ি তৈরি করেছিলেন। ১৯২১ সালে তাঁর বানানো রেসিং কার ‘দ্য ডুসেনবার্গ’ লে ম্যানস গ্র্যান্ড প্রি জেতা প্রথম মার্কিন গাড়ি হিসেবে ইতিহাস গড়ে।

দুঃখের বিষয় হলো, এত সাফল্য সত্ত্বেও ফ্রেড খুব বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল নিজের উদ্ভাবনের কারণে মৃত্যু। ১৯৩২ সালে তিনি নিজের সর্বশেষ ডুসেনবার্গ গাড়িটি দ্রুত গতিতে পরীক্ষা করার সময় সেটি উল্টে যায়। এই দুর্ঘটনার আঘাত থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি তিনি। পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর এই মর্মান্তিক মৃত্যু ডুসেনবার্গ ব্র্যান্ডের পথচলা থামিয়ে দিতে পারেনি। আজও তাঁর তৈরি গাড়িগুলো বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান গাড়ির তালিকায় রয়েছে।

আরও পড়ুন

৫. আলেকজান্ডার বোগদানভ

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের অবদান অনেক বড় হলেও তাঁরা প্রায়ই আলোচনার বাইরে থেকে যান। আলেকজান্ডার বোগদানভ তেমনই একজন। তিনি সব সময় নতুন কিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।

বোগদানভই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে রক্ত সঞ্চালনকে শুধু একটি জরুরি চিকিৎসা হিসেবে দেখেননি। তিনি এটিকে মানুষের শরীরের কার্যকারিতা বাড়ানোর উপায় হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঠিক পদ্ধতিতে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে দীর্ঘায়ু এবং চিরযৌবন লাভ সম্ভব। এই বিশ্বাস থেকে ১৯২৬ সালে তিনি একটি রক্ত সঞ্চালন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করেন।

দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর এই স্বপ্ন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয়ে ওঠে তাঁর মৃত্যুর কারণ। ১৯২৮ সালে তিনি স্বেচ্ছায় যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া আক্রান্ত এক ছাত্রের রক্ত গ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়, রক্তের গ্রুপ না মেলার কারণেই তাঁর শরীর সেই রক্ত গ্রহণ করতে পারেনি। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর এই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত মৃত্যু পরে অনেক বিজ্ঞানীকে অনুপ্রাণিত করে। সেখান থেকে রাশিয়ায় একটি সুসংগঠিত জাতীয় রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, টেনেজ

আরও পড়ুন