আইজ্যাক নিউটন। নামটা শুনলেই আমাদের মাথায় আসে মহাকর্ষ, আপেল পড়ার গল্প আর গতির বিখ্যাত তিনটি সূত্র। আবার বইয়ের পাতায় তাঁর ছবি দেখলেই একজন গম্ভীর, ভাবুক মানুষের কথাই মনে আসে। কিন্তু সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানীর জীবনের অনেক মজার ও অদ্ভুত ঘটনা প্রচলিত আছে। অবশ্য এর মধ্যে অনেকগুলো বানানো গল্প বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন তাঁর মাথায় আপেল পড়ার বিখ্যাত গল্পটাকেও অনেকে মনে করেন বানোয়াট। প্রচলিত সেসব গল্পের কয়েকটা রইল বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।
বিড়ালের জন্য দরজা আবিষ্কার
নিউটন বিড়াল খুব ভালোবাসতেন। কথিত আছে, তাঁর একটি বড় বিড়াল ছিল। নাম স্পিটহেড। বিড়ালটা একবার বাচ্চা দিল। ছোট বিড়াল ছানাকে সঙ্গে নিয়ে স্পিটহেড সারাদিন বারবার নিউটনের ঘরে ঢুকত এবং বের হতো। নিউটন প্রতিবার উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেন। এ কারণে গবেষণার সময় তাঁর মনোযোগ বাধা পড়ত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন নিউটন।
তিনি তাঁর ঘরের দরজায় দুটি ছিদ্র করলেন—বড় বিড়ালটির জন্য একটি বড় ছিদ্র এবং ছোট ছানাটির জন্য ছোট ছিদ্র! তাঁর মতো একজন বুদ্ধিমান মানুষের মাথায় আসেনি যে বড় ছিদ্রটি দিয়েই দুটি বিড়াল সহজে যাতায়াত করতে পারত। এ ঘটনাটি প্রায়ই তাঁর অন্যমনস্কতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য এই গল্পের কোনো শক্ত প্রমাণ নেই।
নিউটনের কুকুর
শুধু বিড়ালই নয়, নিউটনের একটি কুকুরও ছিল। এর নাম ছিল ডায়মণ্ড। কুকুরটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। একদিন রসায়ন নিয়ে একটা পরীক্ষা করছিলেন নিউটন। হঠাৎ দুর্ঘটনাবশত পরীক্ষাগারে ডায়মন্ড একটি মোমবাতি ফেলে দেয়। তাতে মুহূর্তের মধ্যে নিউটনের বহু লেখা ও গবেষণার দলিল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু নিউটন কুকুরটির ওপর রাগ ঝাড়েননি। শুধু বলেছিলেন, ‘তুমি জানো না কী ক্ষতি করলে!’
তবে অনেকে মনে করেন, এ গল্পটাও বানানো। হয়তো নিউটনের একাকীত্ব আর দুঃখের প্রতীক হিসেবেই ডায়মন্ডের গল্প বানানো হয়েছে।
জানার জন্য সবকিছু বাজি
বিজ্ঞানের প্রতি নিউটনের কৌতূহল ছিল চরম পর্যায়ের। তিনি কোনো কিছু হাতে-কলমে পরীক্ষা না করে বিশ্বাস করতেন না। আলোর প্রকৃতি এবং মানুষের চোখ কীভাবে রং দেখতে পায়, তা নিয়ে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। এ বিষয়ে জানার জন্য একবার ভয়ঙ্কর কাজ করেছিলেন নিউটন।
একটি লম্বা সুচ নিয়ে নিজের চোখের কোণ দিয়ে অক্ষিগোলকের পেছন পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেন নিউটন। এরপর সুচটি দিয়ে চোখের পেছনে আলতো করে চাপ দেন। এভাবে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে এতে তাঁর দৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন আসে কি না। ভাগ্য ভালো, তিনি অন্ধ হয়ে যাননি।
মনভোলা বিজ্ঞানী ও সিদ্ধ ঘড়ি
নিউটন যখন গবেষণায় মগ্ন থাকতেন, তখন তাঁর চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে কোনো হুঁশ থাকত না। এমনই একদিনের ঘটনা। রাতের খাবারের জন্য তিনি একটি ডিম সিদ্ধ করতে চাইলেন। পাত্রে পানি গরম করতে দিয়ে গবেষণার চিন্তায় এতই ডুবে গেলেন যে, আনমনে ডিমের বদলে নিজের পকেট ঘড়িটিই ফুটন্ত পানিতে ফেলে দিলেন! কিছুক্ষণ পর তাঁর হুঁশ ফিরল। তখন আবিষ্কার করলেন যে পানিতে ডিম নয়, ঘড়ি সিদ্ধ হচ্ছে। আর ডিমটি তাঁর হাতেই ধরা আছে।
অনেক সময় তিনি খেতেও ভুলে যেতেন। তাঁর গৃহকর্মী প্রায়ই তাঁর জন্য খাবার সাজিয়ে রেখে যেতেন, কিন্তু তা খাওয়ার কথা নিউটনের মনে থাকত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন তিনি তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাটিয়ে দিতেন।
গোয়েন্দা নিউটন
জীবনের একটা বড় অংশ তিনি ব্রিটেনের রয়্যাল মিন্ট বা টাকশালের ওয়ার্ডেন হিসেবে কাজ করেছেন। আমরা তাঁকে বিজ্ঞানী হিসেবে চিনলেও, এই পদে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং গোয়েন্দা! সেই সময়ে মুদ্রা জাল করার ঘটনা খুব বেড়ে গিয়েছিল। নিউটন এই বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেন। তিনি নিজে ছদ্মবেশে বিভিন্ন সরাইখানায় গিয়ে জালিয়াত চক্রের তথ্য সংগ্রহ করতেন। এভাবে কুখ্যাত সব অপরাধীদের ধরে বিচারের আওতায় এনেছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ডের মুদ্রা ব্যবস্থা অনেকটাই সুরক্ষিত হয়েছিল।
অ্যালকেমিস্ট নিউটন
নিউটন বিজ্ঞানের পাশাপাশি অ্যালকেমির প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। অ্যালকেমি হলো লোহা বা সাধারণ ধাতুকে সোনায় পরিণত করার এক প্রাচীন ও রহস্যময় বিদ্যা। নিউটন বিশ্বাস করতেন, পরশপাথর নামে এমন কোনো বস্তু আছে যা দিয়ে এটা করা সম্ভব। এ বিষয়ে তাঁর কিছু গোপন পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। একটা পাণ্ডুলিপিতে লেখা ছিল: যদি তুমি প্রকৃতির ভাষা জানো, তবে পাথরও সোনা হয়ে উঠবে।
তাঁর হাতে লেখা আরেকটি পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গেছে একটা রেসিপি। সেখানে গরুর চর্বি, শামুক, ময়ূরের পালক, সীসা আর টিন গলিয়ে একধরনের পদার্থ বানানোর কথা লেখা আছে। এটা নাকি অলৌকিক শক্তি তৈরি করতে পারে! নিউটন একেই বলতেন পরশ পাথর।
আসলে নিউটনের শেষ জীবন ছিল কিছুটা রহস্যময়। তিনি জীবনের প্রায় ৩০ বছর এই অ্যালকেমির পেছনে ব্যয় করেছেন এবং এ নিয়ে লিখেছেন দশ লাখেরও বেশি শব্দ! নিজের একটি গোপন ল্যাবরেটরিতে তিনি রাতের পর রাত বিভিন্ন রাসায়নিক নিয়ে বিপজ্জনক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। কিন্তু এ বিষয়ে অনেক কিছু লিখলেও সেগুলো কখনো ছাপাননি। মৃত্যুর আগে এরকম বহু কাগজ ধ্বংস করে ফেলেন নিউটন।
সংসদ সদস্য নিউটন
নিউটন তাঁর জীবনে দুইবার ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না। কথিত আছে, পার্লামেন্টে তিনি তাঁর কার্যকালে মাত্র একবারই কথা বলেছিলেন। সবাই ভেবেছিল, তিনি হয়তো দেশের কোনো বড় সমস্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন।
কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পাশে বসে থাকা একজন কর্মকর্তাকে অনুরোধ করে বললেন, ‘আমার পাশের ওই জানালাটা দয়া করে বন্ধ করে দেবেন? ঠান্ডা বাতাস আসছে।’
শেয়ার বাজারে নিউটন
আমরা নিউটনকে মহাজ্ঞানী হিসেবে জানলেও, আর্থিক বিষয়ে তিনি একবার বিশাল বড় একটি ভুল করে বসেন। কথিত আছে, অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে ‘সাউথ সি কোম্পানি’ নামে একটি শেয়ার বাজারে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সবাই এই কোম্পানির শেয়ার কিনে বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল।
নিউটনও প্রথম দিকে কিছু টাকা বিনিয়োগ করে বেশ ভালো লাভ করেন। তবে সময়মতো শেয়ার বিক্রি করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি দেখলেন, তাঁর পরিচিত অনেকেই তখনো শেয়ার কিনে আরও বেশি লাভ করছে। তা দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না নিউটন। নিজের সব সঞ্চয় নিয়ে আবার সেই শেয়ারে বিনিয়োগ করলেন।
দুর্ভাগ্যবশত, এর কিছুদিন পরেই এই শেয়ার বাজারের পতন হয়। সেটা ‘সাউথ সি বাবল’ নামে পরিচিত। এই ঘটনায় নিউটন তাঁর জীবনের প্রায় সব সঞ্চয় হারান। এর পরিমাণ আজকের হিসাবে মিলিয়ন ডলারের সমান।
এই ঘটনার পর তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি গ্রহ-নক্ষত্রের গতি হিসাব করতে পারি, কিন্তু মানুষের পাগলামি হিসাব করতে পারি না।’