বিস্ময়কর পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যান

পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান কাজ প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটে, তার সঠিক কারণ খুঁজে বের করা। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বেড়েছে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব। বিংশ শতাব্দীতে এসে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক পুরোনো ধারণার যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। নিউটনের চিরায়ত গতিবিদ্যার একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করেছে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার নতুন জগৎ।

ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সের অনেক সূক্ষ্ম পরিমাপ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে করলে দেখা যাচ্ছে অনেক অনিশ্চয়তা এসে ভর করছে সেসব পরিমাপে। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে আমরা বস্তুর ভরের যে হিসেব পাই, সেই একই ভরের হিসেব পাই আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির সমীকরণ থেকে। এই দুই ভরের মধ্যে সূক্ষ্ম তারতম্য দেখা যাচ্ছে, যার ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে। কোনো তত্ত্বের প্রয়োগ করে তত্ত্বীয়ভাবে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তার অনিশ্চয়তা যত কম হয়, অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তার সঙ্গে তত্ত্বীয় ফলাফলের পার্থক্য যত কম হয়, সেই তত্ত্বটি ততটা সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়।

পদার্থের সঙ্গে পদার্থের মিথস্ক্রিয়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং উলফগ্যাং পাউলি বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের ওপর কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রয়োগ করার জন্য আবিষ্কার করলেন কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স। এ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের যত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম অনিশ্চয়তাসম্পন্ন তত্ত্ব হলো কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স। মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়ান সুইংগার এবং জাপানি পদার্থবিজ্ঞানী শিনিতিরো তোমোনাগা আলাদা আলাদাভাবে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সমস্যার সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু সেই একই সময়ে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের জটিল সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। এই আবিষ্কারের জন্য ফাইনম্যান, সুইংগার এবং তোমোনাগা ১৯৬৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং ব্যতিক্রমী পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। আইনস্টাইন যতই বলুন, তাঁর নিজের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে প্রতিভার অবদান মাত্র ১০%, বাকি ৯০% তাঁর অধ্যবসায় এবং অনুশীলন; আমরা সবাই জানি বিজ্ঞানীরা ভীষণ প্রতিভাবান। প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদেরকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এক, স্বাভাবিক প্রতিভাবান এবং দুই, জাদুকরী প্রতিভাবান। সঠিকভাবে চেষ্টা, উদ্যম, অধ্যবসায় এবং সুযোগ থাকলে অনেকেরই প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে পারে। তাঁরা কী করছেন, কীভাবে করছেন তা জানা খুব সহজ বলে তাঁদের চিন্তা ও কাজের মধ্যে তেমন কোনো রহস্য থাকে না। তাঁদের কাজ দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, এই কাজ তাঁদের পক্ষেও করা সম্ভব। কিন্তু জাদুকরী প্রতিভাবানদের কাজের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের কাজের ফলাফল দেখা যায়। কিন্তু কাজটা কীভাবে হলো তা দেখার পরেও, সব সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েও সাধারণের পক্ষে সম্ভব হয় না সেই কাজটা করা। রিচার্ড ফাইনম্যান ছিলেন বিজ্ঞানের উচ্চতম পর্যায়ের জাদুকরী প্রতিভাবান, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর পদার্থবিজ্ঞানী।

১৯১৮ সালের ১১ মে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ফার রকএওয়ে সাবার্বে জন্ম রিচার্ড ফাইনম্যানের। তাঁর বাবা মেলভিল ফাইনম্যান ও মা লুসিল ফিলিপ্‌স ইউরোপ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। তিনি কাজ করতেন একটি পোশাক তৈরির কারখানায়, সেলস ম্যানেজার হিসেবে। তাঁদের প্রথম সন্তান রিচার্ডের জন্মের পাঁচ বছর পর দ্বিতীয় সন্তান হেনরির জন্ম হয়। কিন্তু বেশিদিন বাঁচেনি হেনরি।

রিচার্ডের যখন নয় বছর বয়স, তখন তাঁদের কন্যা জোয়ানের জন্ম হয়। সীমিত আয়ের সংসার হলেও মেলভিল ছিলেন জ্ঞানপিপাসী মানুষ। তিনি তাঁর ছেলে-মেয়ে রিচার্ড ও জোয়ানের ভেতর বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার বীজ রোপণ করে দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা নিয়ে বড় হয়েছেন রিচার্ড। তাঁর স্কুল, বাড়ি সবখানেই নানারকম পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে শিখতে শিখতে মুক্ত চিন্তার স্বাধীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন রিচার্ড ফাইনম্যান।

স্কুলের নিচের ক্লাসে থাকতেই লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে নিজে নিজে শিখে ফেলেছেন বীজগণিত, ক্যালকুলাস, ত্রিকোণমিতি। ফার রকএওয়ে স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি বাড়িতে বসেই নানারকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। যে কোনো বিষয়েই তিনি বুঝতে চেষ্টা করতেন প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। ক্যালকুলাস, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতির একই সমস্যার সমাধান করতেন বিভিন্ন পদ্ধতিতে। যদি দেখতেন প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে তাঁর নিজের পদ্ধতি বেশি কার্যকর, তিনি সেটাই গ্রহণ করতেন। কিন্তু যদি দেখা যেত তাঁর নিজের পদ্ধতির চেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ভালো, তখন নির্দ্বিধায় নিজের পদ্ধতি বর্জন করতেন। বিজ্ঞান শিখতে হলে যে কোনো ধরনের আত্ম-অহংকার থাকতে নেই, তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই।

পরিচালক ভাবলেন ফাইনম্যান মজা করছেন। কিন্তু ফাইনম্যান মজা করেননি। ফাইনম্যান তাঁর নয় বছরের ছোট বোন জোয়ানাকে পদার্থবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলায় এক গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে জোয়ানাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন খোলা মাঠে অরোরা দেখাতে। জোয়ানার বয়স তখন মাত্র চার, আর ফাইনম্যান তেরো। ক্রমাগত ভাইয়ের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের খেলা খেলতে খেলতে পদার্থবিজ্ঞানকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন জোয়ানাও। সলিড স্টেট ফিজিকসে পিএইচডি শেষ করার পর জোয়ানা অরোরা সংক্রান্ত গবেষণায় উৎসাহী হয়েছেন। তিনি জানেন, তাঁর ভাই যেখানেই হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে। কিন্তু তিনি নিজে এমন একটা ক্ষেত্রে কাজ করতে চান, যেখানে তাঁর ভাই হাত দেবেন না। একদিন তিনি ফাইনম্যানকে বললেন, ‘তুমি পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছু নিয়ে নাও, কেবল মহাকাশটা আমার জন্য ছেড়ে দাও।’ ফাইনম্যান রাজি হয়েছিলেন সে কথায়।

ফাইনম্যান মহাকাশ গবেষণা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও মৃত্যুর দুই বছর আগে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে স্মার্ট বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় মহাকাশ সংক্রান্ত একটি ঘটনা। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি মার্কিন মহাকাশযান চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয়ে সাতজন নভোচারীর সবাই মারা যান। প্রেসিডেন্ট রিগান তেরো সদস্যের এক বৈজ্ঞানিক কমিশন গঠন করেন এই ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য। ফাইনম্যান সেই কমিটির মেম্বার ছিলেন।

তিনি ঘটনাস্থল, গবেষণাগার সবকিছু খুঁটিনাটি নিজের চোখে দেখে, সেখানকার সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে নিজে কথা বলে ঘটনার মূল কারণ শনাক্ত করেন। চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের আগের রাতে প্রচণ্ড তুষারপাত হয়েছিল। রকেটের ও রিংয়ের রাবার প্রচণ্ড ঠান্ডায় কার্যকারিতা হারিয়েছিল। উৎক্ষেপণের আগে সবকিছু পরীক্ষা করা হলেও বিজ্ঞানীরা এই আপাত ছোট্ট ব্যাপারটার দিকে নজর দেননি। ফাইনম্যান টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে ছোট্ট একটা পরীক্ষার সাহায্যে দেখালেন, কী সমস্যা হয়েছিল চ্যালেঞ্জারের রকেটে। তিনি বরফভর্তি কাচের গ্লাসে এক টুকরা রাবার রেখে দেখালেন, কীভাবে রাবারের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে যায়। বিজ্ঞানের জগতে আগে থেকেই বিখ্যাত ছিলেন ফাইনম্যান। কিন্তু এই ঘটনার পর রাতারাতি সবার চোখে বিখ্যাত হয়ে যান তিনি।

পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফাইনম্যানের মতো এমন ভালো শিক্ষক আর কখনো পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্লাসিক টেক্সট বইয়ের নাম ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিকস। তাঁর ক্যালটেকের ক্লাসরুমে দেয়া লেকচারগুলো থেকে এই বই রচিত হয়েছে। আইনস্টাইনের পরে ফাইনম্যানই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী।

অনেকদিন থেকেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন ফাইনম্যান। দুবার অপারেশনের পর সেরেও উঠেছিলেন। কিন্তু তৃতীয়বার অপারেশানের পর ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান বিস্ময়কর এই পদার্থবিজ্ঞানী।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ১. প্রদীপ দেব, কোয়ান্টাম ভালোবাসা

২. ক্রিস্টোফার সাইকিস, নো অর্ডিনারি জিনিয়াস

৩. জেমস গ্লেইক,  জিনিয়াস