অন্ধকারে কি মানুষ আসলেই ভূত দেখে, নাকি পুরোটাই চোখের ভ্রম

রাতে আমদের চোখ মাঝে মাঝে আমাদের ভুল দেখায়ছবি: ডিপোজিটফটো

১৯৯৯ সালে দ্য ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট নামে একটা মুভি মুক্তি পেয়েছিল। বাজেট ছিল মাত্র ৬০ হাজার ডলার। সিনেমায় কোনো ভয়ংকর মেকআপ করা ভূত ছিল না, কোনো গ্রাফিক্সের কারসাজিও ছিল না। ছিল শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা।

অথচ এই সিনেমা দেখেই মার্কিন হলগুলোতে দর্শকরা ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল। কেন জানেন? কারণ, পর্দায় যখন অন্ধকার থাকে, আমাদের মস্তিষ্ক তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নিজের কল্পনার সবচেয়ে ভয়ংকর ছবিটা সেখানে বসিয়ে দেয়।

বাস্তব জীবনেও ঠিক এটাই ঘটে। ছোটরা বা বড়রাও অন্ধকারে ভয় পায়। বাতি নেভানোর পর মনে হয়, ওই কোণায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে! কিংবা কী যেন একটা নড়ে উঠল! মনের ভুল ভেবে আমরা চাদর মুড়ি দিই। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, এটা শুধু মনের ভুল নয়, আমাদের চোখেরও একটা বড়সড় কারসাজি আছে এখানে।

যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের চোখের ডাক্তার এবং অধ্যাপক স্কট ই. ব্রডি আমাদের এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরা ভাবি আমাদের চোখ ক্যামেরার মতো। সামনে যা থাকে, ঠিক সেটাই দেখায়। কিন্তু ব্রডি বলছেন, ‘চোখ সবসময় বিশ্বাসযোগ্য নয়। চোখের দেখার পেছনে অনেক নিউরোলজি এবং রাসায়নিক ব্যাপার কাজ করে। তাই চোখকে সহজেই বোকা বানানো যায়।’

এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো অপটিক্যাল ইলিউশন বা চোখের ধাঁধা। ইন্টারনেটে এমন অনেক ছবি আছে যা স্থির, কিন্তু তাকালে মনে হয় নড়ছে। অন্ধকারে আমাদের চোখ অনেকটা সেই ধাঁধার মতোই কাজ করে।

আরও পড়ুন
ব্রডি বলছেন, ‘চোখ সবসময় বিশ্বাসযোগ্য নয়। চোখের দেখার পেছনে অনেক নিউরোলজি এবং রাসায়নিক ব্যাপার কাজ করে। তাই চোখকে সহজেই বোকা বানানো যায়।’

একটা ছোট্ট পরীক্ষা করা যাক। চোখ বন্ধ করুন। এবার আঙুল দিয়ে চোখের ওপরের পাতায় খুব আলতো করে একটু চাপ দিন এবং আঙুলটা নাড়ান। কী দেখছেন? অন্ধকার থাকার পরেও মনে হচ্ছে না ভেতরে আলোর একটা রিং বা বৃত্ত নড়াচড়া করছে?

অথচ বাইরে কোনো আলো নেই। ব্রডি বলেন, ‘এটা হলো রেটিনার ওপর যান্ত্রিক চাপের ফল। রেটিনার নার্ভগুলো চাপ খেয়ে মস্তিষ্কে ভুল সংকেত পাঠায় যে তারা আলো দেখছে।’

বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ফসফেনস। গ্রিক শব্দ থেকে আসা এই নামের অর্থ আলো দেখানো। ওই যে মাথায় জোরে বাড়ি খেলে আমরা বলি চোখে সর্ষে ফুল দেখছি, ওটা আসলে এই ফসফেনসের খেলা। কোনো আলো ছাড়াই আলো দেখার ভেলকি আরকি!

আপনি যখন বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে যান, আপনার রেটিনা কিন্তু তখনো কাজ থামায় না। অন্ধকারে দেখার জন্য আমাদের চোখের রড সেলগুলো জেগে ওঠে।

ব্রডি বলেন, ‘অন্ধকারেও রেটিনা সক্রিয় থাকে। সামান্যতম উত্তেজনায় চোখের নার্ভগুলো মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে থাকে। আর মস্তিষ্ক তখন অন্ধকারেও এমন সব জিনিস দেখতে শুরু করে, যা আসলে সেখানে নেই।’

এগুলোকে বলা হয় ক্লোজড-আই হ্যালুসিনেশন। অর্থাৎ, চোখ বন্ধ থাকলেও আপনি আবছা রং বা নড়াচড়া দেখতে পান। এটা ভূত-প্রেত নয়, এটা আপনার চোখের ভেতরের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া।

আরেকটা মজার তথ্য দিই। চোখ বন্ধ করলে বা অন্ধকারে থাকলে আমরা যে রঙটা দেখি, সেটা কিন্তু কুচকুচে কালো নয়। ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, ওটা আসলে একধরনের গাঢ় ধূসর রং।

আরও পড়ুন
ক্লোজড-আই হ্যালুসিনেশন বলতে বোঝায় চোখ বন্ধ থাকলেও আপনি আবছা রং বা নড়াচড়া দেখতে পান। এটা ভূত-প্রেত নয়, এটা আপনার চোখের ভেতরের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া।

জার্মান পদার্থবিদ গুস্তাভ ফেকনার ১৮০০ শতকে এর নাম দিয়েছিলেন আইগেনগ্রাউ। এর মানে হলো নিজস্ব ধূসর। কেন এমন হয়? কারণ আমাদের অপটিক নার্ভ সবসময় মস্তিষ্কে কিছু না কিছু সিগন্যাল পাঠাতেই থাকে। অনেকটা পুরনো দিনের টিভিতে চ্যানেল না থাকলে যেমন ঝিরঝির করত, আমাদের চোখের নার্ভেও তেমন ভিজুয়্যাল নয়েজ বা ঝিরঝির শব্দ হতে থাকে। দিনের আলোতে এটা বোঝা যায় না, কিন্তু রাতে এই নয়েজ বা আইগেনগ্রাউ রঙটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অন্ধকারে আমাদের বেশি ভয় পাওয়ার আরেকটা কারণ হলো অন্য ইন্দ্রিয়গুলো। চোখ যখন ঠিকমতো দেখতে পায় না, তখন কান এবং শরীরের অনুভূতি সুপার-অ্যাক্টিভ হয়ে যায়।

চোখ বন্ধ থাকলেও যে আবছা রং দেখা যায় তা ভূত নয়, বরং চোখের ভেতরের রাসায়নিক ক্রিয়া
ছবি: গেটি ইমেজ

দিনে যে শব্দটা আপনি পাত্তাই দেননি, রাতে সেই সামান্য টিকটিক শব্দ বা বাতাসের শব্দকেও মস্তিষ্ক বিশাল কোনো বিপদ বলে মনে করে। আপনি নিজের শরীরের অবস্থান সম্পর্কেও বেশি সচেতন হয়ে ওঠেন।

কিন্তু এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একে ভূত বলে ভুল করবেন না। অন্ধকারে যদি মনে হয় কিছু দেখছেন, তাহলে নিজেকে প্রথমে শান্ত করুন। কারণ, ওটা আপনার চোখের ভ্রম ছাড়া কিছুই না!

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: পপুলার সায়েন্স

আরও পড়ুন