যেভাবে বাঘ গোনা হয়

দেশের জনসংখ্যা যেমন গণনা করা হয়, তেমনি বনে বাঘের সংখ্যাও গুনতে হয়। একে বলা হয় বাঘশুমারি। এই বাঘশুমারির কাজটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেন? কী লাভ বাঘের সংখ্যা গুনে? কীভাবেই-বা হিসাব করা হয় বাঘের সংখ্যা? আলাদা করে চিহ্নিত করা হয় কীভাবে—জানুন বিশ্ব বাঘ দিবসে।

সুন্দরবনের বাঘফাইল ছবি

ধরুন, একটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল প্রতিবছর শীতকালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কে শিক্ষাসফরে যাবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলে মোট ১০০ জন। এ জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল নিজেরাই সকাল ও দুপুরের খাবার রান্না করবে, রেস্তোরাঁ বা বাইরের কোনো খাবার কিনবে না। এখানে অনেক প্রশ্ন। শিক্ষাসফরের জন্য কয়টি বাস ভাড়া করতে হবে, কখন রওনা দেবে, কয়টার সময় ফিরবে, সকাল-দুপুরে কী খাবার দেওয়া হবে, সেসব খাবার রান্না করতে কী পরিমাণ বাজার করতে হবে, পুরো শিক্ষাসফরে কত টাকার প্রয়োজন হবে ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের সমাধান করতে হলে প্রথমে জানতে হবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সহায়তাকারীসহ মোট কতজন শিক্ষাসফরে যাবেন। ব্যবস্থাপনা কমিটি অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মাধ্যমে শিক্ষাসফর সুন্দরভাবে শেষ করার চেষ্টা করবে। তারপরও কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি হলে তা শোধরানো যাবে পরের বছরের শিক্ষাসফরে।

সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রথম শর্তই হলো কোনো একটি বিষয়ে পরিমাণগত ও গুণগত ধারণা থাকা। শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষাসফরে যাওয়ার আগে যেমন জানতে হবে কোথায় নিয়ে গেলে তাদের সারাটি দিন শিক্ষামূলক হবে, তেমনি জানতে হবে তাদের পছন্দের খাবার কী কী হতে পারে? যে জায়গাটি শিক্ষাসফরের জন্য নির্বাচন করা হলো, সেখানে কতজন শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে? এসব পরিমাণগত ও গুণগত প্রশ্নের সমাধান যে যত বিশ্লেষণ করে বের করবে, তার ব্যবস্থাপনা হবে তত সহজ।

বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার—এ ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের মধ্যে লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের প্রকৃতি থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বন্য প্রাণীর সংখ্যা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের মতো এত বড় একটা বনের ব্যবস্থাপনা করতে হলে এখানকার গাছপালা, পশুপাখি, জোয়ার-ভাটা—সবকিছু সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। সুন্দরবনে বাঘের অবস্থা না জানলে দীর্ঘ মেয়াদে বাঘ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। আমাদের প্রকৃতিজগতে প্রতিটি প্রাণী খাদ্যের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য অন্য এক বা একাধিক প্রাণীর ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। পরস্পর নির্ভরশীলতাই হলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য। সুন্দরবনের ক্ষুদ্রতম প্রাণী হলো মৌমাছি, আর সবচেয়ে বড় প্রাণী বাঘ। এ বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে মৌমাছির অবদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাঘের অস্তিত্ব অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। আর পৃথিবীতে সুন্দরবনের মতো এত বড় ম্যানগ্রোভ বন আর দ্বিতীয়টি নেই। সে কারণেই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এ বনের প্রতিটি প্রাণী সংরক্ষণ করা ও বনের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বাঘ যেহেতু সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় প্রাণী, সে জন্য বাঘের সংখ্যা জেনে বাঘের বিজ্ঞানভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করা হলে সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত অন্যান্য ক্ষুদ্র বন্য প্রাণীও পরোক্ষভাবে সংরক্ষণ করা হবে।

আরও পড়ুন

বাঘ কী? কোথায় থাকে বাঘ?

বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এ অঞ্চলের মধুপুর-ভাওয়ালের গড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বন, বৃহত্তর সিলেটের প্রাকৃতিক বনসহ সুন্দরবনে বাঘের বিচরণ ছিল। একটি বনে বাঘ থাকার মানে হলো সে বনে বাঘের শিকার প্রাণী, যেমন হরিণ, শূকর, শজারু, গুইসাপ ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। বাঘ মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে বলে শিকার প্রাণীর প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে বাঘের অস্তিত্ব। সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশের সব বনাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাঘের শিকার প্রাণী না থাকায় ওসব বাঘ স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

ছবি ১: সুন্দরবনের খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার—এ ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের মধ্যে লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের প্রকৃতি থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সময়মতো বাঘের সংখ্যা না জানার কারণে বাঘ সংরক্ষণের জন্য টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এমনটা হয়েছে। বাঘের সংখ্যা জানাটা তাই যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাঘের শিকার প্রাণীর বিষয়েও ধারণা থাকা আবশ্যক। প্রকৃতিজগতে যেসব প্রাণীর অস্তিত্বের হুমকি যত বেশি, সেসব প্রাণী সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সংখ্যাগত ও আবাসস্থলের গুণগত তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। কারণ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হলে প্রাণীটিকে তার আবাসস্থলে প্রাকৃতিকভাবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না। সুন্দরবনেও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বাঘের অস্তিত্বের হুমকি সবচেয়ে বেশি বলে ন্যূনতম তিন বছর পরপর বাঘের সার্বিক অবস্থা জানা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে বছরে একাধিক ঘূর্ণিঝড় হলে, চোরা শিকারিদের মাধ্যমে বাঘ শিকার বেড়ে গেলে, বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্বের কারণে মানুষ বাঘ হত্যা করলে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সুন্দরবন থেকে বাঘের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

সুন্দরবনে বাঘের চলাচল সম্পর্কে কীভাবে জানা যায়

সুন্দরবনই পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন, যেখানে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বাঘ টিকে আছে। ম্যানগ্রোভ বনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আমাদের একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে দিনে দুবার জোয়ার হয়, সাগর থেকে লোনাপানি এসে প্লাবিত হয় সুন্দরবনের খাল-নদী। আবার দিনে দুবার ভাটা হয়, পলিযুক্ত লোনাপানি খাল-নদীর মাধ্যমে আবার সাগরে গিয়ে মেশে। সুন্দরবনের ছোট–বড় ৪৫০টি নদীর নাব্যতা প্রতিদিনের জোয়ার-ভাটার কারণে হ্রাস-বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানের উৎকর্ষের মাধ্যমে জরিপের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বনের ভেতরে-বাইরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যেত বনে বাঘের অবস্থা।

বাঘ প্রধানত এককভাবে বনে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থেকে বিচরণ করে। এটাকে বাঘের রাজ্য বলতে পারেন। একটি বাঘের রাজ্যে অন্য আরেকটি বাঘ আসুক, তা সে পছন্দ করে না। এ কারণে বাঘকে তার রাজ্য পাহারা দিতে হয়। আমাদের বাঘ অন্যান্য বনের মতো ম্যানগ্রোভ বনেও প্রতিনিয়ত নিজস্ব রাজ্যে বিচরণ করে। সুন্দরবনে বাঘের রাজ্য সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বর্গকিলোমিটার হয়। রাজ্য পাহারা দেওয়ার জন্য টহলের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য বাঘ প্রতিনিয়ত ছোট-বড় খাল সাঁতার কেটে পাড়ি দিয়ে হাঁটতে থাকে বনের মধ্যে। বাঘ যখন বন থেকে খালে নামে ও সাঁতার কেটে খাল পেরিয়ে অপর পাড়ে বনে ওঠে, তখন সে নিজের অজান্তেই খালের পাড়ের নরম কাদায় পায়ের ছাপ রেখে যায়। খালের পাড়ের কাদামাটি নরম হলে পায়ের ছাপ গভীর হয়, ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত টিকে থাকে। খালের পাড়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটি হলে পায়ের চিহ্ন হালকা হয়। বাঘ খাল পার হওয়ার সময় পাড়ে যে পায়ের চিহ্ন বা ছাপ রেখে যায়, তাকে ট্র্যাক সেট বলা হয়। এ ট্র্যাক সেট বা বাঘের পায়ের ছাপ জরিপ করে সমগ্র সুন্দরবনে বাঘের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।

ছবি ২: সুন্দরবনে বাঘের পায়ের চিহ্নের প্লাস্টার অব প্যারিসের আয়তাকার প্লেট
ছবি: প্রথম আলো

ধরা যাক, আপনারা পাঁচ বন্ধু কাঠের ছোট সাম্পান ট্রলারে বেরিয়েছেন। সুন্দরবনের একটি খালে ট্রলার চালিয়ে খালের দুই পাড় দেখতে দেখতে চার কিলোমিটার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন সবাই মিলে। চার কিলোমিটার খাল অতিক্রম করার সময় দুটি বাঘের পায়ের ছাপ বা ট্র্যাক সেট দেখতে পেলেন। তাহলে বলতে পারেন, সুন্দরবনের চার কিলোমিটার খাল জরিপ করে দুটি বাঘের পায়ের ছাপ পেয়েছেন। তাহলে প্রতি কিলোমিটার খাল জরিপ করলে বাঘের পায়ের চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে শূন্য দশমিক ৫০টি। এটাকে বলা হয় বাঘের আপেক্ষিক অবস্থা। ইংরেজিতে বলা হয় রিলেটিভ অ্যাবানডান্স অব টাইগার। সমগ্র সুন্দরবনেই বাঘ বিচরণ করে বলে সুন্দরবনকে ৬৫ ভাগে ভাগ করে খাল জরিপ করা হয়। পরিসংখ্যানের পরিভাষায় একেকটি অংশকে বলা হয় স্যাম্পল ইউনিট। প্রতিটি স্যাম্পল ইউনিটে তিনটি খাল জরিপ করে বাঘের পায়ের ছাপ জরিপ করা হয়। জরিপ শেষে প্রতি কিলোমিটার খাল জরিপ করা হলে কতটি বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া যায়, তার মাধ্যমে সুন্দরবনে বাঘের আপেক্ষিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। সুন্দরবনের ৬৫টি স্যাম্পল ইউনিটের কোন ইউনিটে বাঘের কী অবস্থা, কোন ইউনিটে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি, তার কারণ কী—এসব বের করে নিয়ে দ্রুত বাঘ সংরক্ষণবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

বিজ্ঞানের উৎকর্ষের মাধ্যমে জরিপের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বনের ভেতরে-বাইরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যেত বনে বাঘের অবস্থা। পাহাড়ি বনে বা সমতল বনে বাঘের অবস্থা যত সহজভাবে জানা যায়, জোয়ার-ভাটার ম্যানগ্রোভ বনে বাঘের অবস্থা জানা তত সহজ নয়। অত্যন্ত জটিল। বাঘ ঘন বনের মধ্যে একাকী লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। সুন্দরবনের ঘন গরান-গেওয়া বনে সহজে বাঘ দেখা যায় না। বাঘ যখন নিজের রাজত্ব পাহারা দেওয়ার জন্য খাল অতিক্রমের সময় খালের পাড়ে আসে, সৌভাগ্যক্রমে তখনই কেবল বাঘ দেখা যায়। একদল গবেষক সুন্দরবনে খালের পাড়ের কাদামাটিতে বাঘের পায়ের চিহ্নের উপাত্ত সংগ্রহ করার মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করতে শুরু করে।

আরও পড়ুন
নিখুঁতভাবে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বাঘসমৃদ্ধ দেশগুলো ক্যামেরা–ট্র্যাপিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০১৫, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বাঘ জরিপ করা হয়।

ষাটের দশকে সরোজ চৌধুরী নামের এক বন কর্মকর্তা খালের পাড়ে বাঘের পায়ের চিহ্ন পরিমাপ করে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা বের করার পদ্ধতি সবাইকে অবহিত করেন। সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অংশে বাঘের পায়ের ছাপ পরিমাপ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

২০০৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে সুন্দরবনে বাঘ জরিপ করে। সেবার সুন্দরবনে খালের পাড় ও বনের ভেতরে বাঘের পায়ের ছাপ গণনা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ জরিপের জন্য ১৬টি গ্রুপ করা হয়েছিল। প্রতিটি গ্রুপের কাজ ছিল খাল দিয়ে ছোট কাঠের সাম্পান ট্রলার চালিয়ে যাবে। এ সময় বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে বনে প্রবেশ করে সে ট্র্যাক অনুসরণ করে বাঘের পেছনের বাঁ পায়ের একটি স্পষ্ট ছাপ চিহ্নিত করবে। তারপর সে পায়ের ছাপের চারদিকে চার টুকরা কাঠ আয়তাকারভাবে রেখে, প্লাস্টার অব প্যারিস বা ক্যালসিয়াম সালফেট পাউডার পানির সঙ্গে মিশিয়ে একটি কাই বানিয়ে বাঘের পায়ের চিহ্নের ওপর কাইটি ঢেলে কিছুক্ষণ রেখে দিলে পায়ের ছাপের একটি আয়তাকার প্লেট জরিপের জন্য তৈরি করা হয় (ছবি ২)। পরবর্তী সময়ে বাঘের পায়ের ছাপের সব প্লেটের পরিমাপ নিয়ে সমগ্র সুন্দরবনের বাঘের পায়ের ছাপের পরিমাপের সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

নিখুঁতভাবে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বাঘসমৃদ্ধ দেশগুলো ক্যামেরা–ট্র্যাপিং পদ্ধতি অনুসরণ করে

সমতল বা পাহাড়ি বনে এ পদ্ধতি কিছুটা কার্যকর হলেও ম্যানগ্রোভ বনে একই বাঘের পায়ের ছাপের পরিমাপ কাদায়, শক্ত মাটিতে, বনের অভ্যন্তরে, খাল-নদীর পাড়ে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই বাঘের মোট সংখ্যা অতিরঞ্জিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য বন্য প্রাণীবিজ্ঞানী ও বাঘবিশেষজ্ঞরা বাঘের পায়ের ছাপের পরিমাপ গ্রহণের মাধ্যমে বাঘ গণনার পদ্ধতিটি অগ্রহণযোগ্য ও অবৈজ্ঞানিক হিসেবে অভিহিত করেন। বর্তমানে ক্যামেরার মাধমে বাঘের ছবি সংগ্রহ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

বাঘ গণনায় ক্যামেরা–ট্র্যাপিং পদ্ধতি

নিখুঁতভাবে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বাঘসমৃদ্ধ দেশগুলো ক্যামেরা–ট্র্যাপিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০১৫, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বাঘ জরিপ করা হয়। ভোটের সময় ব্যালট পেপারে বুড়ো আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। কারণ, একজন মানুষের আঙুলের ছাপের সঙ্গে আরেকজনের আঙুলের ছাপের কোনো মিল নেই। বাঘের শরীরের কালো ও কমলা ডোরাকাটা বিভিন্ন মাপের ও সাইজের দাগও এ রকম অনন্য। একটি বাঘের ডোরাকাটা দাগের সঙ্গে অপর আরেকটি বাঘের ডোরাকাটা দাগের কোনো মিল নেই।

আরও পড়ুন
২০ থেকে ৩০ ফুট দূরত্বে দুটি গাছে দুটি ক্যামেরা বেঁধে রাখা হয় ৪৫ দিনের জন্য। বাঘ, হরিণ বা যেকোনো বন্য প্রাণী দুটি ক্যামেরার মাঝ দিয়ে চলাচল করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরায় ছবি উঠে যায়।
ছবি ৩: বাঘের ডোরাকাটা দাগ তুলনা করা হচ্ছে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে

ওপরে ক্যামেরা–ট্র্যাপিংয়ে তোলা চারটি বাঘের ছবি—ক, খ, গ এবং ঘ দেওয়া হলো। বাঘের শরীরের ডোরাকাটা দাগ দেখে বলতে হবে এখানে কয়টি বাঘ। চারটি ছবিতে চারটি বৃত্তের ভেতরের ডোরাকাটা দাগ ভালোভাবে খেয়াল করলেই বলা যাবে। ক এবং ঘ দুটি ছবির বাঘের ডোরাকাটা দাগ একই রকম, ছবি দুটিতে ডোরাকাটা দাগের প্যাটার্ন একই ধরনের। আবার খ এবং গ বাঘের ছবির বৃত্তের ভেতরের ডোরাকাটা দাগও একই প্যাটার্নের বলে এ দুটি ছবিও একটি বাঘের। অর্থাৎ ওপরে চারটি বাঘের ছবির ডোরাকাটা দাগ প্রত্যক্ষ করলে সুস্পষ্টভাবে দুটি বাঘের ছবি চিহ্নিত করা যায়।

বর্তমানে বাঘবিশেষজ্ঞরা ক্যামেরা–ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ জরিপ করাকে সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ক্যামেরা–ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘ যে পথ দিয়ে চলাচল করে, সে পথে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা হাঁটুর উচ্চতায় গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। ২০ থেকে ৩০ ফুট দূরত্বে দুটি গাছে দুটি ক্যামেরা বেঁধে রাখা হয় ৪৫ দিনের জন্য। বাঘ, হরিণ বা যেকোনো বন্য প্রাণী দুটি ক্যামেরার মাঝ দিয়ে চলাচল করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরায় ছবি উঠে যায়। পরবর্তী সময়ে সব ক্যামেরার বাঘের ছবি বিশ্লেষণ করে একক বাঘের ছবির সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। দুটি ক্যামেরা স্থাপনের কারণে বাঘের ডান ও বাঁ দিকের ছবি পাওয়া যায়। একই বাঘের দুই দিকের ছবি থাকায় যখন কোনো বাঘের আংশিক ছবি পাওয়া যায় বা কোনো একটি ক্যামেরা কাজ না করলে অপর ক্যামেরার বাঘের ছবিটি তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একই বাঘের ছবি একাধিক ক্যামেরায় ও বারবার ছবি পাওয়া—এই দুটি বিষয় বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাঘ জরিপের সময় বনে কয়টি ক্যামেরা বসানো হবে, তা নির্ভর করে প্রধানত জরিপের বাজেট, বনের কত শতাংশ এলাকায় জরিপ করা হবে, জরিপের সময়কাল, প্রশিক্ষিত জরিপের জনবলের প্রাপ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।

বাঘের সংখ্যা জানা হয়ে গেলে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যের অভ্যন্তরে ও বাইরে বাঘের অবস্থা, ম্যানগ্রোভ বনের কোন ধরনের আবাসস্থল বাঘের পছন্দ, লিঙ্গভেদে বাঘের আনুপাতিক হার, বাঘ কোন ধরনের এলাকায় বাচ্চা লালন–পালন করে, কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আগের জরিপে বাঘের সংখ্যার সঙ্গে বর্তমান জরিপের ফলাফলের তুলনা করে বাঘ সংরক্ষণের টেকসই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।

লেখক: বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ, খুলনা

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন