হিমবাহ গললে বাড়বে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, বলছে নতুন গবেষণা

গত ৭ জুলাই, সোমবার ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট লেবোতোবি লাকি-লাকি আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। অগ্ন্যুৎপাতের ছাই ১৮ কিলোমিটার ওপরে উঠেছে। একই আগ্নেয়গিরিতে গত মাসেও অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছিল। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি হওয়া ছাই উঠেছে মেঘের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি উঁচুতে। এর আগে, গত ২ জুন ইতালির সিসিলিতে অবস্থিত বিখ্যাত পর্বত মাউন্ট এটনায় ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা দেখা গেছে। এসব অগ্ন্যুৎপাতের কারণে স্থানীয়দের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগ। বিশাল উচ্চতায় ছাইয়ের মেঘ ছড়িয়ে পড়ায় বিমান চলাচলের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এর পরিবেশগত প্রভাবও কম নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বাতাসে প্রচুর কার্বন ছড়িয়ে পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিগুলোর সক্রিয় হয়ে ওঠার ঘটনা বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। উষ্ণায়নের প্রভাবে মেরু অঞ্চলে দীর্ঘকাল জমে থাকা হিমবাহ গলে যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, হিমবাহগুলো গলে গেলে উত্তর আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড এবং রাশিয়ায় আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা বাড়তে পারে। ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়িয়ে পড়বে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, হিমবাহ গলে গেলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত আরও বেশি বিস্ফোরক হবে এবং অনেক ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে। এর প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন আরও দ্রুততর হবে।

বিজ্ঞানীরা প্রথম ১৯৭০-এর দশকে বলেছিলেন, গলিত বরফ আগ্নেয়গিরিকে প্রভাবিত করতে পারে। এর পেছনের প্রক্রিয়াটি সহজ। হিমবাহের ওজন পৃথিবীর ভূত্বক এবং ম্যান্টেলের ওপর নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি করে।

অ্যান্টার্কটিকা, রাশিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকার শত শত আগ্নেয়গিরি হিমবাহের নিচে ঢাকা রয়েছে। কিন্তু পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বরফের স্তরগুলো গলে সরে যাচ্ছে। ফলে এই আগ্নেয়গিরিগুলো আরও সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি শেষ বরফ যুগে দক্ষিণ চিলির ছয়টি আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণার লেখকরা এই দাবি করেছেন। গবেষকেরা তাঁদের এই ফলাফল ৯ জুলাই, বুধবার চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে অনুষ্ঠিত ২০২৫ সালের গোল্ডস্মিথ কনফারেন্সে উপস্থাপন করেছে।

আরও পড়ুন

গবেষণার প্রধান লেখক এবং যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী পাবলো মোরেনো ইয়েগার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হিমবাহগুলো এদের নিচে থাকা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের পরিমাণকে দাবিয়ে রাখে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহগুলো সরে যাওয়ায়, আমাদের ফলাফল অনুযায়ী এই আগ্নেয়গিরিগুলো আরও ঘন ঘন এবং আরও বিস্ফোরিত হয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে।’

বিজ্ঞানীরা প্রথম ১৯৭০-এর দশকে বলেছিলেন, গলিত বরফ আগ্নেয়গিরিকে প্রভাবিত করতে পারে। এর পেছনের প্রক্রিয়াটি সহজ। হিমবাহের ওজন পৃথিবীর ভূত্বক এবং ম্যান্টেলের ওপর নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি করে। তাই বরফ যখন সরে যায়, তখন ভূগর্ভস্থ গ্যাস এবং ম্যাগমা প্রসারিত হয়। ফলে তৈরি হয় চাপ। এই চাপ অগ্ন্যুৎপাতের বিস্ফোরণে শক্তি যোগায়।

এই প্রক্রিয়ার কারণে এরই মধ্যে আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির অবস্থা বদলে গেছে। আইসল্যান্ড উত্তর আমেরিকান এবং ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের ওপরে অবস্থিত। ২০০২ সালে বিজ্ঞানীরা আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপে পরিবর্তন হিসাব করেছিলেন। প্রায় ১০ হাজার বছর আগের শেষ বরফ যুগের শেষে এর হিমবাহগুলো সরে গিয়েছিল। দ্বীপের আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের ঢেউ। এ সময় আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা ছিল শেষ বরফযুগের আগে বা পরের তুলনায় ৩০-৫০ গুণ বেশি।

ঘন ঘন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ম্যাগমা স্তরের ওপর খুব পুরু হিমবাহের আবরণ। হিমবাহগুলো সরে গেলে চাপ মুক্ত হয়ে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকার মতো জায়গায় এ ঘটনাই ঘটছে।

তবে মহাদেশীয় আগ্নেয়গিরির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিপদ নিয়ে এখনো সেভাবে গবেষণা হয়নি। এটি যাচাই করার জন্য ভূ-বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ চিলির ছয়টি আগ্নেয়গিরি পরীক্ষা করছেন। এর মধ্যে বর্তমানে নিষ্ক্রিয় মোচো-চোশেনকো আগ্নেয়গিরি রয়েছে। কয়েক হাজার বছর আগে প্যাট্যাগোনিয়ান বরফ স্তর গলে যাওয়ার ফলে এই আগ্নেয়গিরির প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আইসল্যান্ডের অগ্ন্যুৎপাতকারী আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত আর্গনের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়কে ভিত্তি করে গবেষকেরা হিসাব করেছেন। আর্গনের তেজস্ক্রিয়তাকে আইসোটোপিক ক্লক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ম্যাগমাটিক শিলার ভেতরে গঠিত ক্রিস্টালগুলোও করা হয় বিশ্লেষণ। এগুলোর মাধ্যমে গবেষকেরা এই অঞ্চলের আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের সঙ্গে ক্রমেই অদৃশ্য হওয়া বরফের সম্পর্ক ধরতে পেরেছেন।

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গবেষকেরা দেখেছেন, ২৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার বছর আগে ছিল শেষ বরফ যুগের মধ্যকার সময়। তখন বরফের আচ্ছাদন অগ্ন্যুৎপাতের পরিমাণকে দমিয়ে রেখেছিল। ফলে এই অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের নিচে বিশাল ম্যাগমার একটি আধার জমা হয়েছিল। যখন বরফ স্তর গলে গিয়েছিল, তখন এই আধারের ভেতরে চাপ বেড়ে যায়। একসময় মোচো-চোশেনকো আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়ে এই ম্যাগমা নির্গত হয়েছিল।

অগ্ন্যুৎপাতের এই হুমকি শুধু আইসল্যান্ডের জন্য নয়। ২০২০ সালের গবেষণা বলছে, বিশ্বের সম্ভাব্য সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলোর ২৪৫টি বরফের নিচে বা বরফের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। বিশ্বব্যাপী এই আগ্নেয়গিরিগুলো ছড়িয়ে আছে।

আরও পড়ুন
তবে মহাদেশীয় আগ্নেয়গিরির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিপদ নিয়ে এখনো সেভাবে গবেষণা হয়নি। এটি যাচাই করার জন্য ভূ-বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ চিলির ছয়টি আগ্নেয়গিরি পরীক্ষা করছেন। এর মধ্যে বর্তমানে নিষ্ক্রিয় মোচো-চোশেনকো আগ্নেয়গিরি রয়েছে।

ঘন ঘন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ম্যাগমা স্তরের ওপর খুব পুরু হিমবাহের আবরণ। হিমবাহগুলো সরে গেলে চাপ মুক্ত হয়ে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়। বর্তমানে অ্যান্টার্কটিকার মতো জায়গায় এ ঘটনাই ঘটছে। গবেষকরা বলছেন, উত্তর আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড এবং রাশিয়াসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে আরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধান প্রয়োজন।

আগ্নেয়গিরি
ছবি: রয়টার্স

অগ্ন্যুৎপাতে সাধারণত সালফেট অ্যারোসল নির্গত হয়, যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে মহাকাশে ফিরিয়ে দেয়। এ কারণে অতীতে অগ্ন্যুৎপাতের পর পৃথিবীতে শীতলীকরণ ঘটেছে। এভাবে ঘটেছে কিছু বড় দুর্ভিক্ষের ঘটনাও। এটি অগ্ন্যুৎপাতের স্বল্পমেয়াদি প্রতিক্রিয়া। গবেষকদের আশঙ্কা, দীর্ঘমেয়াদে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের হার দ্রুততর করবে।

এই প্রতিক্রিয়া এমন একটি চক্র তৈরি করবে, যেখানে হিমবাহ গলে গেলে অগ্ন্যুৎপাত ঘটবে। আবার অগ্ন্যুৎপাতগুলো আরও উষ্ণায়ন ঘটাবে। ফলে গলবে হিমবাহ।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন