আলফা মেলের ধারণা কতটা বাস্তব

দুটি ধূসর নেকড়ে তুষারপাতের মধ্যে একে অপরের মুখোমুখিগেটি ইমেজ

কেউ খুব আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা এবং আক্রমণাত্মক হলে তাঁকে অন্যরা মনে করে ‘আলফা মেল’। জীববিজ্ঞানে আলফা মেলের ধারণা জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এভাবেই উঠে এসেছে। ১৯৭০ সালে নেকড়ে দলের নেতাকে বোঝাতে প্রথম ব্যবহার করা হয় ‘আলফা মেল’ ধারণাটি। এরপর আলফা মেলের ধারণাটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়। নেকড়ে ছাড়িয়ে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও ব্যবহার শুরু হয় এই শব্দের। ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। তবে বর্তমানে এটি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। জীববিজ্ঞানে এই ধারণা আসলে কতটা সত্য? 

আলফা মেল তত্ত্ব প্রকাশের ২০ বছর পরের পর্যবেক্ষণগুলো বেশ বদলে গেছে। দেখা গেছে, বুনো নেকড়ের দল আসলে একটি পারিবার। এই দলের আলফা জুটি (আলফা মেল ও আলফা ফিমেল) শুধু সেই পরিবারের বাবা-মা। যে গবেষকেরা আলফ মেলের তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা স্বীকার করেছেন, শব্দটি দিয়ে বোঝায় এমন নেকড়েগুলোকে, যারা দলের শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য লড়াই করেছে, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। আসলে দলের প্রধান আলফা জুটি নির্ধারিত হয় শুধু বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে প্রজননের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে। পরে দলের বাকি সদস্যরাও স্বাভাবিকভাবে একই পদ্ধতিতে নেতা হয়।

আরও পড়ুন

অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে কি আলফা মেল আছে?

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে আলফা মেলের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অনেক প্রাণীর দলে শুধু স্ত্রী প্রজাতি নেতৃত্ব দেয়। যেমন হায়েনা, ওরকা এবং মিরক্যাট। প্রাইমেট প্রজাতিতে পুরুষ বা স্ত্রী উভয়ই নেতৃত্ব দিতে পারে। আফ্রিকান সিংহের মতো কিছু প্রজাতি জোট গঠন করে। সেখানে প্রতিটি সদস্য সমান মর্যাদা উপভোগ করে।

গবেষকেরা আলফা মেলের ধারণাটিকে প্রশ্ন করেছেন। আলফার ধারণাটি কি আদৌ প্রাসঙ্গিক বা বাস্তব? আচরণগত বাস্তুবিদ্যা অনুসারে এটি প্রাসঙ্গিক। তবে যেভাবে প্রচলিত আছে, সেভাবে নয়।

অধিকাংশ দলবদ্ধ প্রাণীদের মধ্যে কোনো না কোনো সামাজিক স্তরবিন্যাস থাকে। এই বিন্যাসের মাধ্যমে প্রতিটি সদস্য কতটুকু সম্পদ ভোগ করবে তা নির্দিষ্ট থাকে। যেমন খাবার, সঙ্গী এবং বসবাসের এলাকায় প্রবেশের অধিকার নির্ধারিত হয় এই স্তরবিন্যাসের কারণে। এভাবে দলের বিবাদ মিটিয়ে ফেলা সম্ভভ হয়। মাঝেমধ্যে সংঘাত এড়ানোও সম্ভব।

এই স্তরবিন্যাসের ধরণ আবার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে আলাদা। যেমন, মুরগির একটি রৈখিক স্তরবিন্যাস আছে। মুরগির মধ্যে মাত্র একটি আলফা স্ত্রী সবকিছুর প্রধান। কিন্তু দলের প্রতিটি মুরগির সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকে। আবার নেংটি মোল ইঁদুরের দলে একটি প্রভাবশালী জুটি থাকে। এই দলে একটি আলফা পুরুষ ও একটি আলফা স্ত্রী প্রজনন এবং কলোনি নিয়ন্ত্রণ করে। দলের অন্য সব সদস্য প্রায় সমান অবস্থানে থাকে।

নেংটি মোল ইঁদুর
গেটি ইমেজ
আরও পড়ুন
যে মানুষগুলোকে আলফা পুরুষ হিসেবে দেখা হয়, তাঁরা হয়তো সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী হতে পারেন। কিন্তু তাঁরা হয়তো হাতাহাতি লড়াইয়ে জিততে পারবেন না

আলফা দিয়ে কি শুধু শারীরিক শক্তি বোঝায়?

বেশিরভাগ সময় প্রাণীদের আধিপত্যের স্তরবিন্যাস লড়াই বা মারামারির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কার শক্তি বেশি, এর ওপর নির্ভর করে সম্পদে অগ্রাধিকার কে পাবে। তবে শক্তি ছাড়াও অন্যান্য দিক আছে। যেমন প্রতিটি দলে নেতা নির্বাচিত হয়। নেতা ঠিক করে দলটি আজ কোথায় যাবে? পাশের দলের সঙ্গে লড়াই করবে কিনা? এসব বিষয়ে শারীরিক লড়াইয়ের মাধ্যমে তৈরি হওয়া স্তরবিন্যাসের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।

বিষয়টি আসলে জটিল। কারণ, দলের এই পদগুলো স্থায়ী সামাজিক অবস্থান নয়। আলফা মর্যাদা সহজাত বৈশিষ্ট্য না হয়ে বরং অস্থায়ী একটি কাজের ভূমিকা বা দায়িত্বের মতো হয়। গবেষকেরা মনে করেন, বেশিরভাগ প্রজাতির মধ্যে পদমর্যাদা দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। কেউ যদি একটি প্রাণীর পুরো জীবনকাল দেখে, তবে সম্ভবত দেখা যাবে, প্রতিটি প্রাণীই নিজের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আলফা ছিল।

একইভাবে, যে মানুষগুলোকে আলফা পুরুষ হিসেবে দেখা হয়, তাঁরা হয়তো সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী হতে পারেন। কিন্তু তাঁরা হয়তো হাতাহাতি লড়াইয়ে জিততে পারবেন না বা অন্যরা হয়তো তাঁকে নেতা হিসেবে নির্বাচিত করবে না। আমরা প্রাণীদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে ‘শক্তি’ নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমরা জানি, ‘প্রতিপত্তি’ বলে একটি বিষয় আছে। নমনীয়তার জন্যও মানুষ অন্যকে প্রধান মনে করে। সবসময় শক্তিই মুখ্য নয়। একইভাবে নমনীয়তার বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়।

আরও পড়ুন
আলফা মেল শব্দটি খুব সরল করে দেখা হয়। বুদ্ধিমান প্রজাতির ক্ষেত্রে সামাজিক আচরণ ও অবস্থান কাঠামোর সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

জীববিজ্ঞানে ‘আলফা মেল’ ধারণা 

কিছু প্রাণীর দলে একটি পুরুষ সদস্য আধিপত্য বিস্তার করে। কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির মধ্যে এই মর্যাদা পাওয়ার পর শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। ইঁদুরের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ বড় হয় এবং প্রাণীটি আরও টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করতে শুরু করে। ফলে এরা এলাকা চিহ্নিত করতে এক জায়গায় মূত্র ত্যাগ না করে সবদিকেই করতে শুরু করে। এই পরিবর্তনগুলো আলফা মেল হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরে ঘটে। 

আলফা মেল শব্দটি খুব সরল করে দেখা হয়। বুদ্ধিমান প্রজাতির ক্ষেত্রে সামাজিক আচরণ ও অবস্থান কাঠামোর সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। মনে করা হয়, আলফা হলো এমন এক সদস্য, যার নিজ গোষ্ঠীতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আছে। এই ধারণা দিয়ে আসলে গোষ্ঠির আচরণ ব্যখ্যা করা যায় না। কারণ, দলে একটি পুরুষ সদস্য যদি সব লড়াইয়ে জেতেও, তবু সব সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে না। প্রাণী দলে ক্ষমতার বন্টন এত সহজ নয়!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স