ভারতীয় উপমহাদেশের বড় বড় নদীগুলোতে একসময় দেখা মিলত একধরনের লম্বা মুখের কুমির। এগুলোর নাম ঘড়িয়াল। কুমিরের মতো দেখতে হলেও এরা কিছুটা আলাদা—চোয়াল সরু, দাঁতগুলো চিকন, স্বভাবেও অনেকটা নিরীহ।
সংস্কৃত ‘ঘঙ্গাটিকা’ শব্দ থেকে এসেছে ঘড়িয়াল। এই নামকরণের পেছনে দুটি প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেকের মতে, এদের মাথা ও মুখের আকৃতি অনেকটা ঘোড়ার মতো, তাই ঘোড়া থেকে ‘ঘড়িয়াল’ নামের উৎপত্তি। অন্য দলের মতে, পুরুষ ঘড়িয়ালের নাকের ওপরে ঘড়ার মতো ফোলাভাব থাকে। মূলত হাড়ের গঠন থেকেই এমন ফোলাভাব। তাই অনেকের মতে, ‘ঘড়া’ শব্দ থেকেই এসেছে ‘ঘড়িয়াল’ নামটি। ঘড়িয়ালকে ইংরেজিতে বলা হয় গাভিয়াল।
ঘড়িয়াল সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী। এর বৈজ্ঞানিক নাম গাভিয়ালিস গাঙ্গেটিকাস (Gavialis gangeticus)। যেহেতু এটি গঙ্গা নদীতে বেশি দেখা যায়, তাই এর বৈজ্ঞানিক নামের সঙ্গে ‘গ্যাঙ্গেটিকাস’ (gangeticus) শব্দটি যুক্ত হয়েছে। তবে গঙ্গার পাশাপাশি বাংলাদেশের অনেক নদীসহ ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু নদ ও মহানদীতে ঘড়িয়াল পাওয়া যায়।
ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু সাধারণত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। স্ত্রী ঘড়িয়াল বালুচরে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ে। প্রতিবার ডিমের সংখ্যা হয় ৩০-৫০টি।
ঘড়িয়াল সাধারণ কুমিরের তুলনায় কিছুটা আলাদা। সাধারণত পুরুষ ঘড়িয়ালের দৈর্ঘ্য ৬.৫ মিটার এবং স্ত্রী ঘড়িয়ালের দৈর্ঘ্য ৪.৫ মিটার পর্যন্ত হয়। আকারে বিশাল হলেও এরা মানুষের জন্য হুমকি নয়। চোয়াল সরু ও দুর্বল হওয়ার কারণে বড় শিকার ধরতে পারে না। দাঁতগুলো চিকন ও ধারালো হওয়ায় বিশেষভাবে মাছ ধরতে পারে। প্রধানত মাছ, ছোট পাখি ও ব্যাঙ খেয়ে এরা বেঁচে থাকে।
পুরুষ ঘড়িয়ালের নাকের ওপর বিশেষ ঘড়ার মতো একটা অংশ থাকে, যা প্রজনন মৌসুমে শব্দ উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু সাধারণত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। স্ত্রী ঘড়িয়াল বালুচরে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ে। প্রতিবার ডিমের সংখ্যা হয় ৩০-৫০টি। প্রায় ৩ মাস পর ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। আয়ু ৫০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত হতে পারে।
একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের নদীগুলোতে অবাধ বিচরণ ছিল ঘড়িয়ালের। সিন্ধু থেকে ইরাবতী, গঙ্গা থেকে ব্রহ্মপুত্র— বড় নদীগুলোতে ঘড়িয়াল দেখা যেত। অথচ আজ এটি অতি বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশে ঘড়িয়াল বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন (IUCN) বাংলাদেশের ঘড়িয়ালকে ‘অতি বিপদাপন্ন’ তালিকায় রেখেছে।
আয়ুর্বেদিক ও কবিরাজি ওষুধের জন্য কিছু মানুষ এখনো ঘড়িয়াল শিকার করে। বড় বড় নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণের কারণে ঘড়িয়ালের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এর পাশাপাশি শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে।
একসময় পদ্মা-যমুনাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন নদীতে ঘড়িয়ালের বিচরণ ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রতিকূলতার কারণে এটি আজ বিলুপ্তির পথে। বড় নদীগুলোতে পলি জমে যাওয়ায় এবং নদীর গভীরতা কমায় ঘড়িয়ালদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর পদ্মায় ঘড়িয়াল টিকে থাকার জায়গা কমে যায়। নদীর ধারে বালু উত্তোলন করায় ডিম পাড়ার উপযোগী বালিয়াড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। অতিরিক্ত মাছ শিকারের কারণে ঘড়িয়ালের প্রধান খাদ্য মাছের সংখ্যাই কমে যাচ্ছে। নদীতে বিষাক্ত সার ও কীটনাশক মিশে মাছের প্রজনন হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। ফলে খাবারের অভাবে ঘড়িয়াল দুর্বল হয়ে পড়ছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ঘড়িয়ালকে ভয় পায় এবং দেখলেই মেরে ফেলে। অথচ এটি একেবারেই নিরীহ প্রাণী। জেলেদের জালে আটকে গেলে অনেক সময় বাঁচিয়ে না রেখে হত্যা করা হয়।
আয়ুর্বেদিক ও কবিরাজি ওষুধের জন্য কিছু মানুষ এখনো ঘড়িয়াল শিকার করে। বড় বড় নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণের কারণে ঘড়িয়ালের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এর পাশাপাশি শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে।
বন্য পরিবেশে ঘড়িয়াল প্রায় বিলুপ্ত হলেও চিড়িয়াখানায় কিছু সংরক্ষিত ঘড়িয়াল রয়েছে। ভারতের চম্বল ঘড়িয়াল অভয়ারণ্য ঘড়িয়াল সংরক্ষণের সফল একটি প্রকল্প। সেখানে বর্তমানে এই ঘড়িয়ালের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।